ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হাদিসের গল্প

জান্নাত-জাহান্নামের একঝলক

হুসাইন আহমদ খান
জান্নাত-জাহান্নামের একঝলক

রাসুল (সা.) ফজরের পর সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বসতেন। তাদের কেউ রাতে কোনো স্বপ্ন দেখেছেন কি-না, জিজ্ঞেস করতেন। যদি কেউ কোনো স্বপ্নের কথা বলতেন, তিনি তার ব্যাখ্যা বলে সঠিক নির্দেশনা দিতেন। একদিন তিনি সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বসলেন। রাতে কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছেন কি-না, জানতে চাইলেন। তারা কেউ কোনো স্বপ্নের কথা বললেন না। তখন নবীজি (সা.) বললেন, রাতে আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি।

কাৎ হয়ে শুয়ে থাকা লোক

নবীজি (সা.) স্বপ্নের বর্ণনা দিতে শুরু করলেন- আমি দেখলাম, আমার কাছে দু’জন আগন্তুক এলো। তারা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। এরপর বলল, চলুন। আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে তাদের সঙ্গে যেতে লাগলাম। কাৎ হয়ে শুয়ে থাকা এক লোকের কাছে এলাম আমরা। দেখলাম, অন্য এক লোক তার কাছে পাথর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে শোয়া লোকটির মাথায় পাথর নিক্ষেপ করছে। এতে তার মাথা ফেটে দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আর পাথরটি গড়িয়ে নিচে পড়ছে। এরপর লোকটি পাথর কুড়িয়ে আনছে। এরই মধ্যে আঘাতপ্রাপ্ত লোকটির মাথা আগের মতো ভালো হয়ে যাচ্ছে। ফিরে এসে আবার লোকটি তার মাথায় আঘাত করছে। ফলে আগে যা ঘটেছিল, এবারও তা-ই ঘটছে। বারবার এভাবেই চলছে তাদের কর্মকাণ্ড। আমি বিস্মিত হয়ে আমার সঙ্গীদ্বয়কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা এবং কেনই বা এমন করছে? তারা আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, চলুন, চলুন।

লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়ানো লোক

আমরা আবার যেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ চলার পর চিৎ হয়ে শোয়া এক লোকের কাছে এলাম। এখানেও দেখলাম, তার কাছে এক লোক লোহার আঁকড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা দ্বারা সে শোয়া লোকটির মুখমণ্ডলের একদিক থেকে মাথার পেছন দিক পর্যন্ত এবং অনুরূপভাবে নাসারন্ধ্র, চোখ ও মাথার পেছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলছে। সে যখন চেহারার একদিক থেকে চিড়তে চিড়তে অন্যদিকে পৌঁছে, তখন প্রথম অংশটি আবার ভালো হয়ে যায়। এরপর সে আবার প্রথম দিক থেকে চিরতে শুরু করে। এভাবেই চলতে থাকে তাদের কর্মকাণ্ড। এবারও আমি আশ্চর্যের আতিশয্যে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা এবং কেন তারা এমন করছে? এবারও তারা আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। বরং আগের মতোই তাড়া দিয়ে বলল, চলুন, চলুন।

চুলার মতো গর্তে উলঙ্গ নারী-পুরুষ

আমরা চললাম। এবার চুলার মতো একটি গর্তের কাছে পৌঁছলাম। সেখানে মানুষের শোরগোলের শব্দ শুনতে পেলাম। আমরা তাতে উঁকি মেরে দেখি, তাতে বেশ কিছু উলঙ্গ নারী ও পুরুষ রয়েছে। আর নিচ থেকে নির্গত আগুনের লেলিহান শিখা পুড়িয়ে ফেলছে তাদেরকে। যখনই লেলিহান শিখা তাদের দিকে ধেয়ে আসে, তখন তারা উচ্চ স্বরে চিৎকার করে ওঠে। এবার আমি আগের চেয়ে বেশি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা এবং কেন তাদেরকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে? কিন্তু এবারও তারা কোনো উত্তর করল না; বরং তাগাদা দিয়ে বলল, চলুন, চলুন!

রক্ত নদীতে সাঁতারকারী

আমরা একটা নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছলাম। নদীর পানি ছিল রক্তের মতো লাল। দেখলাম, নদীতে এক ব্যক্তি সাঁতার কাটছে। আর নদীর তীরে অন্য এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। সে তার কাছে অনেকগুলো পাথর একত্রিত করে রেখেছে। যখন সাঁতারকারী লোকটি বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে তীরে দাঁড়ানো লোকের কাছে পৌঁছে, তখন সাঁতারকারী ব্যক্তিটি নিজের মুখ হা করে, আর ওই লোকটি তার মুখে একটি পাথর ঢুকিয়ে দেয়। এরপর সে চলে যায়। সাঁতার কাটতে থাকে; আবার তার কাছে ফিরে আসে। যখনই সে তার কাছে ফিরে আসে, তখনই সে তার মুখ খুলে দেয়, আর ওই ব্যক্তি তার মুখে একটা পাথর ঢুকিয়ে দেয়। এটা দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা এবং কেনই বা তারা এমন আচরণ করছে? এবারও কোনো উত্তর এলো না। তারা বলল, চলুন, চলুন!

আগুন জ্বালিয়ে চারপাশে দৌড়ানো কুশ্রী লোক

আমরা চলতে চলতে এমন একজন কুশ্রী লোকের কাছে এসে পৌঁছলাম, যাকে তোমরা দেখলে সবচেয়ে কুশ্রী মনে করতে। দেখলাম, তার কাছে রয়েছে আগুন; যা সে প্রজ্বালিত করছে এবং তার চতুর্দিকে দৌড়াচ্ছে। এবারও আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, এ লোকটি কে? তারা আগের মতোই বলল, চলুন, চলুন!

অধিক উঁচু ও দীর্ঘকায় পুরুষ

এবার আমরা একটা সজীব-শ্যামল বাগানে হাজির হলাম, যেখানে বসন্তের হরেক রকম ফুলের কলি রয়েছে। আর বাগানের মাঝে আসমানের চেয়ে অধিক উঁচু ও দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রয়েছে; যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছি না। এমনিভাবে তার চারপাশে এত বিপুল সংখ্যক বালক-বালিকা দেখলাম যে, এত অধিক আর কখনও আমি দেখিনি। আমি তাদের বললাম, উনি কে? এরা কারা? তারা এবারও আমাকে বলল, চলুন, চলুন!

অর্ধেক সুন্দর অর্ধেক কুশ্রী লোক

আমরা চলতে চলতে এক বিরাট বাগানে এসে পৌঁছুলাম। এত বড় ও সুন্দর বাগান আমি আর কখনও দেখিনি। তারা আমাকে লক্ষ্য করে বলল, এ বাগানে প্রবেশ করুন। আমরা প্রবেশ করলাম। সোনা-রুপার ইটের তৈরি একটি শহরে গিয়ে হাজির হলাম। আমরা শহরের দরজায় পৌঁছে তা খুলতে বললাম। আমাদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো। আমরা তাতে প্রবেশ করলাম। তখন সেখানে আমাদের সঙ্গে এমন কিছু লোক সাক্ষাৎ করল, যাদের শরীরের অর্ধেক খুবই সুন্দর আর বাকি অর্ধেক খুবই কুশ্রী। আমার সঙ্গীদ্বয় তাদের বলল, যাও! ওই নদীতে গিয়ে নেমে পড়। আর সেটা ছিল প্রশস্ত প্রবাহিত দুধ-সাদা পানির নদী। তারা তাতে গিয়ে নেমে পড়ল। অতঃপর তারা যখন আমাদের কাছে ফিরে এলো, দেখা গেল- তাদের এ শ্রীহীনতা দূর হয়ে গেছে এবং তারা খুবই সুন্দর আকৃতির হয়ে গেছে।

সব লোকের আসল রহস্য

সঙ্গীদ্বয় আমাকে বলল, এটা চিরস্থায়ী জান্নাত। এটাই আপনার বাসস্থান। আমি বেশ ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তাতে ধবধবে সাদা মেঘের মতো একটি প্রাসাদ আছে। তারা বলল, এটা আপনার বাসগৃহ। আমি তাদের বললাম, তাহলে এবার আমাকে ছেড়ে দাও। আমি এতে প্রবেশ করি। তারা বলল, আপনি অবশ্যই এতে প্রবেশ করবেন, তবে এখন নয়; মৃত্যুর পর। আমি তাদের লক্ষ্য করে বললাম, এ রাতে যে বিস্ময়কর জিনিসগুলো দেখতে পেলাম, সেগুলোর তাৎপর্য কী? তারা এবার মুখ খুলল। বলতে লাগল, ওই যে প্রথম ব্যক্তি, যার মাথা পাথর দিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হচ্ছিল, সে হলো ওই ব্যক্তি, যে কোরআন গ্রহণ করে তা ছেড়ে দিয়েছে এবং সে ফরজ নামাজ ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে থাকত। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি, যার মুখের একভাগ থেকে মাথার পেছন দিক পর্যন্ত, এমনিভাবে নাসারন্ধ্র ও চোখ থেকে নিয়ে মাথার পেছন দিক পর্যন্ত চিরে ফেলা হচ্ছিল, সে হলো এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত, যারা মানুষের মাঝে মিথ্যা ছড়ায়। আর এসব উলঙ্গ নারী-পুরুষ, যারা চুলাসদৃশ গর্তের ভেতর আছে, তারা হলো ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীর দল। আর ওই ব্যক্তি, যে নদীতে সাঁতার কাটছে ও তার মুখে পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সে হলো সুদখোর। আর ওই কুশ্রী ব্যক্তি, যে আগুনের কাছে ছিল এবং আগুন জ্বালাচ্ছিল আর তার চারপাশে দৌড়াচ্ছিল, সে হলো জাহান্নামের দারোগা। আর এ দীর্ঘকায় ব্যক্তি, যিনি বাগানে ছিলেন, তিনি হলেন ইবরাহিম (আ.)। আর তার আশপাশের বালক-বালিকারা হলো ওইসব শিশু, যারা ছোট সময়েই স্বভাবধর্মের ওপর মৃত্যুবরণ করেছে। আর ওইসব লোক, যাদের অর্ধাংশ অতি সুন্দর ও অর্ধাংশ অতি কুশ্রী, তারা হলো ওই সম্প্রদায়, যারা সৎ-অসৎ উভয় কাজ মিশ্রিতভাবে করেছে। আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। (বোখারি : ৭০৪৭)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত