মহানবীর সংস্কারের গল্প

হুসাইন আহমাদ খান

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পৃথিবীর সূচনা থেকে যুগান্তকারী যেসব ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ববহ হলো প্রিয় রাসুল (সা.)-এর জন্ম ও তার নবুয়তপ্রাপ্তি। তাঁর বরকতময় জন্ম ও আলোকময় নবুয়তপ্রাপ্তি ছিল সময়ের বিপ্লাবত্মক ঘটনা। ঘোরতম অন্ধকারের যুগে এটা ছিল দীপ্তমান আলোকবর্তিকা। ঐশী আশিষধন্য এ প্রজ্বলিত মশাল কুফর ও শিরকের তিমির দূর করে। অন্যায়-অবিচার ও অশ্লীলতাণ্ডব্যভিচার দূর করে আনে ন্যায়-সাম্য ও সুন্দর-সুশৃঙ্খল সমাজ। তাওহিদের আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। কোরআনের আলো জ্বলে ওঠে ঘরে ঘরে। পাল্টে যায় পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। মানুষের জীবনে প্রবাহিত হতে থাকে সুখণ্ডস্বাচ্ছন্দ্য ও কল্যাণের ঝর্ণাধারা।

বিশুদ্ধ তাওহিদের প্রচার

তখনকার আরবে মূর্তিপূজার ছিল জয়জয়কার। প্রত্যেক সম্ভ্রান্ত গোত্র নিজেদের জন্য আলাদা আলাদা মূর্তি নির্ধারণ করে নিয়েছিল। ভক্তিভরে সেগুলোর পূজা-আর্চনা করত। ইবরাহিমি তাওহিদের ধর্ম তারা একেবারেই ভুলে বসেছিল। অথচ নিজেদের জাহির করত ইবরাহিম (আ.)-এর অনুসারী হিসেবে। এ সময়ে প্রিয় রাসুল (সা.) স্বচ্ছ ও বিশুদ্ধ তাওহিদের দাওয়াত নিয়ে আগমন করেন। স্মরণ করিয়ে দেন ইবরাহিম (আ.)-এর খাঁটি তাওহিদের কথা। তিনি সগৌরবে ও নির্ভীকচিত্তে ঘোষণা করলেন, ‘বলো- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই), তাহলে সফলকাম হবে।’ কুফর ও শিরকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া আরবসমাজে এটা ছিল অবিশ্বাস্য সাহসী উচ্চারণ। অবিশ্বাস্য হলেও রাসুল (সা.)-এর দাওয়াত ও তাবলিগের ফলে অল্প ক’বছরের ব্যবধানেই পুরো জাজিরাতুল আরবে তাওহিদ ও একত্ববাদের মজবুত ভিত্তি স্থাপিত হয়। প্রাধান্য লাভ করে খাঁটি তাওহিদের অনুসারীরা।

গোত্রপ্রীতির মূলোৎপাটন ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন

আরবের গোত্রপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল প্রবাদতুল্য। আপন সম্প্রদায় অন্যায়-অপরাধ করলেও তারা তারই পক্ষাবলম্বন করত। ঝাঁপিয়ে পড়ত স্বগোত্রের বিজয় ও প্রাধান্য লাভের লড়াইয়ে। এমনকি এর জন্য তারা জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হতো না। এ গোত্রপ্রীতি অধিকাংশ সময়ই তাদেরকে অনর্থক যুদ্ধে জড়িয়ে রাখত। সামান্য থেকে সামান্যতম বিষয় নিয়েও বেঁধে যেত লড়াই। আর গোত্রের সদস্য হিসেবে সবাইকেই সেখানে আবশ্যকীয়ভাবে অংশ নিতে হতো। নিজেদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে তারা সীমাতিরিক্ত গর্ব ও অহংকার করে বেড়াত। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা বয়ান করে রচনা করত শত শত পঙ্ক্তির কবিতামালা। আরবের এ গোত্রপ্রীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে অনর্থক গর্ব-অহংকারের মূলোৎপাটন করেন রাসুল (সা.)। জানিয়ে দেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের জাহেলি যুগের মিথ্যা অহংকার ও পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করার প্রথাকে বিলুপ্ত করেছেন। মোমিন হলো আল্লাহভীরু, আর পাপী হলো দুর্ভাগা। তোমরা সবাই আদম সন্তান। আর আদম (আ.) মাটির তৈরি। লোকদের উচিত, বিশেষ গোত্রের সদস্য হওয়াকে কেন্দ্র করে অহংকার না করা।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫১১৬)। এর বিপরীতে নবীজি (সা.) মানুষের মাঝে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করেন। সাম্য ও সম্প্রীতি জন্ম দেন। ঘুচিয়ে দেন বৈষম্য ও দূরত্ব। স্থাপন করেন ইসলামি ভ্রাতৃত্ব। সম্মানিত-অপদস্থের মাপকাঠি নির্ধারণ করেন তাকওয়াকে। তিনি বলেন, ‘হে লোকেরা! তোমাদের রব এক, তোমাদের পিতা এক। তোমরা সবাই আদম থেকে। আর আদম (আ.) মাটি থেকে। আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্য থেকে সে-ই সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী, যে অধিক তাকওয়াবান। তাকওয়া ছাড়া কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (কানযুল উম্মাল)। শত বছর ধরে চলে আসা মানুষে মানুষে অসাম্য ও বৈষম্য বিদূরিত হয় এভাবেই।

নারীদের যথাযথ মর্যাদা দান

সেকালে নারীদের কোনো মর্যাদা ছিল না। সমাজে ছিল না তাদের আলাদা কোনো অবস্থান। বরং তাদেরকে সমাজের ‘একজন’ বলেই গণ্য? করা হতো না। বাদী-দাসীদের মতো আচরণ করা হতো তাদের সঙ্গে। রাসুল (সা.) এ দিকটিও যত্নের সঙ্গে সংস্কার সাধন করেন। মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ সমান মর্যাদার অধিকারী বলে ঘোষণা দেন। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে। এরপর তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)। নারী-পুরুষকে এক বিন্দুতে রেখে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘পুরুষ হোক বা নারী, যে কেউ ঈমান আনার পর নেক আমল করবে, আমি তাকে অবশ্যই উত্তম জীবন দান করব এবং তাদেরকে নিজ আমলের শ্রেষ্ঠ প্রতিদান দেব।’ (সুরা নাহল : ৯৭)। এভাবে পুরুষ ও নারীর মাঝে সমতা স্থাপিত হয় সমাজে। নারীরা ফিরে পায় নিজেদের হারানো মর্যাদা। নারী-পুরুষের আলাদা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি হয় সমাজে। নবীজি (সা.) স্বামী-স্ত্রীর স্বতন্ত্র হক ও অধিকার বয়ান করেন। স্বামীকে নির্দেশ দেন স্ত্রীর সঙ্গে সম্মানজনক আচরণ করতে। এভাবে সব ক্ষেত্রে নারীদের স্বাধিকার রক্ষিত হয়। ফলে নারীরা সক্ষম হয় জ্ঞান ও শিল্প চর্চার মাধ্যমে নিজেদের আলাদা বলয় তৈরি করে নিতে।

জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন

রাসুল (সা.)-এর অন্যতম সংস্কার ছিল জ্ঞানের রাজ্যে। আরবের মূর্খতার সমাজ ভেঙে তিনি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন করেন। পবিত্র কোরআনের প্রথম অবতীর্ণ ‘ইকরা’ বাণী এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে। আরবের মূর্খতা ও অসভ্যতা দূর করে আনে জ্ঞান ও সভ্যতার পরশ। জ্ঞানার্জনকে আবশ্যক করে তিনি ঘোষণা দেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞানার্জন করা আবশ্যক।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২২৪)। এভাবে রাসুল (সা.)-এর তত্ত্বাবধানে উত্থান ঘটে যুগের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানবান ও সভ্য সমাজের। জ্ঞান-গরিমা ও আখলাক-সভ্যতায় যাদের দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি ছিল না তখনকার পৃথিবীতে। রাসুল (সা.)-এর সাহচর্যে থেকে খোদায়ি কালামের সংস্পর্শে এসে জ্ঞানবিজ্ঞানে ও আখলাক-চরিত্রে সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হন সাহাবায়ে কেরামের মোবারক দল।

যোগ্য ও বিশ্বস্ত উত্তরসূরি গঠন

প্রিয় রাসুল (সা.)-এর আনীত ইসলাম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলামের আগমনই ঘটেছিল বিজয়ী হতে, তার অনুসারীদের বিজয়ী হিসেবে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করতে। এ জন্য ইসলাম সর্বকালের সর্বজনীন ধর্ম। একমাত্র ইসলামই পারে সমগ্র বিশ্বকে একত্রে একসঙ্গে শাসন করতে। ইসলামের জাতীয়তা বৈশ্বিক জাতীয়তা। এখানে ভাষা, গোত্র, বর্ণ ও সংস্কৃতির পার্থক্য অবিবেচ্য। সবাই এক উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত। রাসুল (সা.) এ এক উম্মাহকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এমন একটি দল তৈরি করে যান, যারা ছিলেন সময়ের শ্রেষ্ঠ মানুষ। জ্ঞান-গরিমায় যাদের কোনো সমকক্ষ নেই। আখলাক-চরিত্রে যাদের কোনো উপমা নেই। ন্যায় ও ইনসাফ কায়েমে যাদের কোনো তুলনা নেই। তারা ছিলেন উম্মাহর অতন্দ্র প্রহরী। যাদের দিন কাটত রোজা রেখে, জিহাদের ময়দানে ও বিচারকের আসনে বসে; আর রাত যাপিত হতো জায়নামাজে দাঁড়িয়ে, আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করে। রাসুল (সা.)-এর উত্তম চরিত্র ও উন্নত আদর্শ তারা গ্রহণ করেছিলেন মনেপ্রাণে, কাজেকর্মে। রাসুল (সা.)-এর হাতে গড়া এ সাহাবায়ে কেরাম তার জীবনের কষ্ট-মোজাহাদা ও চেষ্টা-সাধনার শ্রেষ্ঠতম ফসল। যাদের মাধ্যমে পরবর্তী পৃথিবীর ভবিষ্যৎ পাল্টে গেছে, ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে।