নবীজির সহনশীলতা

আবদুল কাইয়ুম শেখ

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মহানবী (সা.) অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও সহনশীল ছিলেন। সহনশীলতার গুণ তাঁর মধ্যে পুরো মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। ব্যক্তিগত কারণে তিনি কারও প্রতি রাগান্বিত হতেন না। মানুষের অন্যায্য আচরণে ধৈর্য ধারণ করতেন ও সহনশীলতার পরিচয় দিতেন। কেউ যদি তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করত, তাহলে তিনি হাসিমুখে বরদাশত করতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে চলছিলাম। এ সময় তার পরনে চওড়া পাড়ওয়ালা একটি নাজরানি ডোরাদার চাদর ছিল। একজন বেদুঈন তার কাছে এলো। সে তার চাদর ধরে খুব জোরে টান দিল। এমনকি আমি দেখতে পেলাম, রাসুল (সা.)-এর কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ পড়ে গেছে! তারপর সে বলল, ‘হে মুহাম্মদ! আপনার কাছে আল্লাহ প্রদত্ত যে সম্পদ আছে, তা থেকে কিছু আমাকে দিতে বলুন।’ রাসুল (সা.) তার দিকে ফিরে তাকিয়ে হাসলেন। তাকে কিছু দান করার নির্দেশ দিলেন। (বোখারি : ৫৮০৯)।

সহনশীলতায় প্রবাদপ্রতীম

মহানবী (সা.)-এর সহনশীলতা প্রবাদপ্রতীম ছিল। আজকের যুগে সুস্থ কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মসজিদে এসে প্রস্রাব করে, আর ইমাম সাহেব বিষয়টি দেখতে পান, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি তার দিকে তেড়ে আসবেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দু-চারটি কটু কথ শোনাবেন। প্রয়োজনে তাকে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা নেবেন। ময়লা পরিষ্কার করতে বাধ্য করবেন। কিন্তু রাসুল (সা.)-এর যুগে এক বেদুঈন মসজিদে নববিতে এসে প্রস্রাব করল। সাহাবায়ে কেরাম রাগান্বিত হয়ে তাকে ধমকাতে লাগলেন। মহানবী (সা.) তাদের বারণ করলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, ‘তোমরা এক বালতি পানি এনে প্রস্রাবের ওপর ঢেলে দাও।’ এরপর বেদুঈনকে লক্ষ্য করে স্নেহভরে বললেন, ‘এ মসজিদ প্রস্রাব করার জন্য নয়, এটা ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য। আগামী দিনে বিষয়টি মনে রাখবে।’ এ ছিল মহানবী (সা.)-এর সহনশীলতার সমুজ্জ্বল উদাহরণ। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক বেদুঈন মসজিদে এসে প্রস্রাব করল। লোকেরা তাকে ধমক দিতে লাগল। রাসুল (সা.) তাদের বললেন, ‘তোমরা তাকে ছেড়ে দাও এবং তার প্রস্রাবের ওপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কেননা, তোমরা নম্র ব্যবহারের জন্য প্রেরিত হয়েছ, কঠোর ও রূঢ় আচরণের জন্য নয়।’ (সুনানে নাসাঈ : ৫৬)।

নির্যাতনের ক্ষেত্রে সবরে অম্লান বদন

মহানবী (সা.)-এর জীবনে বহু দুঃখণ্ডকষ্ট এসেছে। কাফেরদের পক্ষ থেকে তাকে বহু অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি কাফেরদের সব নির্যাতন ও নিপীড়ন অম্লান বদনে সহ্য করেছেন। আবু তালিবের ঘাঁটিতে তাকে পরিবার-পরিজন ও গোত্রসহ তিন বছর বন্দি জীবন পার করতে হয়েছে। ওহুদের ময়দানে বিশ্বনবী (সা.)-এর দন্ত মোবারককে শহীদ করা হয়েছে। তায়েফের ভূমিতে মহানবী (সা.)-কে রক্তাক্ত হতে হয়েছে। এসব অবস্থায় যদি তিনি কাফেরদের বিরুদ্ধে বদদোয়া করতেন, তাহলে কাফেররা বিনাশ হয়ে যেত। তাদের নামণ্ডনিশানা পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে যেত। কিন্তু রাসুল (সা.) সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে কোনো কাফেরের বিরুদ্ধে বদদোয়া করেননি। আয়েশা (রা.) বলেন, একবার তিনি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ওহুদের দিনের চেয়ে কঠিন কোনো দিন কি আপনার ওপর এসেছিল? তিনি বললেন, আমি তোমার কওম থেকে যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, তা তো হয়েছি। তাদের হতে অধিক কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি আকাবার দিন, যখন আমি নিজেকে ইবনে আবদে ইয়ালিল ইবনে আবদে কলালের কাছে পেশ করেছিলাম। আমি যা চেয়েছিলাম, সে তার জবাব দেয়নি। তখন আমি এমনভাবে বিষণ্ন চেহারা নিয়ে ফিরে এলাম যে, কারনুস সাআলিবে পৌঁছা পর্যন্ত আমার চিন্তা দূর হয়নি। তখন আমি মাথা ওপরে তুললাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম, এক টুকরো মেঘ আমাকে ছায়া দিচ্ছে। আমি সেদিকে তাকালাম। তার মধ্যে ছিলেন জিবরাইল (আ.)। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘আপনার কওম আপনাকে যা বলেছে এবং তারা উত্তরে যা বলেছে, তার সবই আল্লাহ শুনেছেন। তিনি আপনার কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। এদের সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছা আপনি তাকে হুকুম দিতে পারেন।’ তখন পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে ডাকলেন এবং সালাম দিলেন। অতঃপর বললেন, ‘হে মুহাম্মদ! এসব ব্যাপার আপনার ইচ্ছাধীন। আপনি যদি চান, তাহলে আমি তাদের ওপর কঠিন শিলার দুই পাহাড়কে চাপিয়ে দেব।’ উত্তরে নবীজি (সা.) বললেন, ‘আশা করি, মহান আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন সন্তান জন্ম দেবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে; আর তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না।’ (বোখারি : ৩২৩১)।

আত্মমর্যাদাবোধ রক্ষায় সহনশীলতার পাহাড়

কোনো ব্যক্তির একাধিক স্ত্রী থাকলে স্ত্রীদের মধ্যে স্বভাবজাত মনোমালিন্য, তর্কাতর্কি, কলহ-বিবাদ ও ঝগড়াঝাটি হয়েই থাকে। স্ত্রীদের এমন আচরণ স্বামীকে বরদাশত করতে হয়। অনেক সময় একাধিক বিবাহকারী ব্যক্তি এ ক্ষেত্রে সহনশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন। কিন্তু রাসুল (সা.) এমন ছিলেন না। তিনি স্ত্রীদের আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন এমন আচরণ সহ্য করে নিতেন। একবার উম্মে সালামা (রা.) মহানবী (সা.)-এর কাছে একটি পাত্রে খাবার পাঠালে আয়েশা (রা.) রাগান্বিত হয়ে পাত্রটি ভেঙে ফেলেন। এতে মহানবী (সা.) বিন্দুমাত্র রাগান্বিত হননি। তিনি সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে আয়েশা (রা.)-কে ক্ষমা করে দেন। উম্মে সালামা (রা.) বলেন, তিনি একবার থালায় করে কিছু খাবার রাসুল (সা.) এবং তার সাহাবায়ে কেরামের কাছে পেশ করলেন। এ সময় আয়েশা (রা.) চাদর জড়িয়ে এলেন। তার হাতে একটি পাথর ছিল। পাথরটি দিয়ে সেই থালা ভেঙে দিলেন। রাসুল (সা.) থালার ভাঙা টুকরো দুটি এক করলেন। এরপর বললেন, ‘তোমরা খাও। তোমাদের মায়ের আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লেগেছে।’ এ কথাটি দু’বার বললেন। এরপর রাসুল (সা.) আয়েশা (রা.)-এর থালা নিয়ে উম্মে সালামা (রা.)-এর কাছে পাঠালেন। উম্মে সালামা (রা.)-এর ভাঙা থালাটি আয়েশা (রা.)-কে দিয়ে দিলেন।’ (সুনানে নাসাঈ : ৩৯৫৬)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া

ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা