ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাহাবিদের নবীভক্তি

আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি
সাহাবিদের নবীভক্তি

রাসুল (সা.)-এর প্রতি উম্মতের অন্যতম করণীয় হলো, হৃদয়ের গভীর থেকে তাকে সম্মান-সমীহ ও ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করা। এটাই আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি নির্দেশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! নিঃসন্দেহে আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছি। যাতে (হে বান্দারা!) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান রাখো, রাসুলকে সম্মান-শ্রদ্ধা কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা কর।’ (সুরা ফাতহ : ৮-৯)। বস্তুত রাসুল (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনা এবং তার ওপর অবতীর্ণ কিতাবের অনুসরণ করার পাশাপাশি রাসুল (সা.)-এর পক্ষে থাকা এবং হৃদয়ে তার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা পোষণ করাই প্রকৃত সফলতা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা তার প্রতি ঈমান এনেছে, তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করেছে, তাকে সমর্থন দান করেছে এবং তার সঙ্গে যে আলোক অবতীর্ণ হয়েছে, তার অনুসরণ করেছে, তারাই সফল।’ (সুরা আরাফ : ১৫৭)।

বিরল ভক্তি-শ্রদ্ধা

নবীজি (সা.)-এর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনে সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠতর আদর্শ। তারা প্রাণাধিক প্রিয় নবীজি (সা.)-এর প্রতি হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশ থেকে সম্মান-শ্রদ্ধার অমূল্য সওগাত নিবেদন করেছেন। সেই অতুলনীয় ভক্তি-ভালোবাসা ও সম্মান-শ্রদ্ধার একটিমাত্র নমুনা আজকের পৃথিবীর কোনো রাজা-প্রজা, অনুসারী-অনুসৃতদের গোটা ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। উরওয়া ইবনে মাসউদ (রা.) তখনও ইসলাম গ্রহণে ধন্য হননি। হোদাইবিয়ার সন্ধি প্রসঙ্গে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে কথোপকথনের পর কোরাইশের কাছে গিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! কসম খোদার! আমি বহু রাজা-বাদশার দরবারে গেছি; কায়সার, কিসরা ও নাজাশির দরবারেও গেছি। কিন্তু সত্য হলো, মুহাম্মদকে মুহাম্মদের অনুসারীরা যে পরিমাণ ভক্তি-শ্রদ্ধা করে, সে পরিমাণ ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে কোনো রাজা-বাদশার অনুসারীদের দেখিনি। যখন তিনি থুথু ফেলেন, তখন তা তাদের কারও না কারও প্রসারিত হাতে গিয়ে পড়ে। আর সে আপন চেহারা ও শরীরে মেখে নেয়। যখন তিনি তাদের কোনো আদেশ করেন, তখন তারা আদেশ পালনে ছুটে যায়। অজু করার সময় তার অজুর পানি নিয়ে তারা রীতিমতো প্রতিযোগিতা আরম্ভ করে। তার কথা বলার সময় তারা ক্ষীণস্বরে কথা বলে। মুহাম্মদের প্রতি তাদের সমীহ ও শ্রদ্ধা এতই প্রবল যে, তারা তার দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকাতে পারে না।’ (বোখারি : ২৭৩২)।

ওপর থেকে নিচতলায়

রাসুল (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় পৌঁছেন, তখন আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) তাকে মেহমানরূপে বরণ করেন। তাদের যত্ন-আত্তি ও আতিথেয়তায় নবীজি (সা.)-এর প্রতি তাদের অকৃত্রিম প্রেমণ্ডভালোবাসা ও ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর ক্রীতদাস আফলাহ সূত্রে বর্ণিত; তিনি আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন, নবীজি (সা.) তার কাছে মেহমান হন। তিনি বাড়ির নিচতলায় অবতরণ করেন, আর আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) ওপর তলায় গিয়ে ওঠেন। হঠাৎ রাতের বেলায় আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) জাগলেন। বললেন, ‘এ কেমন কথা, আমরা নবীজি (সা.)-এর মাথার ওপর চলাফেরা করব!’ পরিবারের লোকদের বললেন, ‘তোমরা একপাশে গুটিয়ে যাও।’ ফলে সারারাত তারা একপাশে অবস্থান করলেন। পরে বিষয়টি তিনি নবীজি (সা.)-কে বললেন। নবীজি (সা.) বললেন, ‘নিচে থাকাটাই বেশি আরামদায়ক।’ আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) বললেন, ‘না, এমন ছাদের ওপর ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব, যার নিচে আপনি রয়েছেন।’ তখন নবীজি (সা.) ওপরে আর আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) নিচে চলে এলেন। (মুসলিম : ২০৫৩)।

দেখা হয়নি দৃষ্টি মেলে

অত্যধিক সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভক্তির কারণে অনেক সাহাবি রাসুল (সা.)-এর চোখে চোখ রাখতে পারতেন না। তার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেও পারতেন না। সব সময় তার সামনে অবনত থাকতেন। দৃষ্টি নিচু রাখতেন। ওমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-ই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় এবং আমার দৃষ্টিতে শ্রদ্ধার পাত্র। তার প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার কারণে আমি কখনও তার দিয়ে চোখ মেলে তাকাতে পারতাম না। যদি তার বিবরণ দিতে বলা হয়, তাহলে তার বিবরণ দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ, আমি তাকে কখনোই ভালো করে চোখ মেলে দেখিনি। এ অবস্থা নিয়ে যদি আমার মৃত্যু হতো, তাহলে আমার আশা ছিল, আমি জান্নাতি হব। তারপর তো আমি অনেক দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। জানি না, এসবে আমার কী অবস্থা হবে?’ (মুসলিম : ২১২)।

পাশ থেকে পেছনে

নামাজে রাসুল (সা.)-এর পাশে দাঁড়ানোকেও সাহাবিদের কেউ কেউ নবীজি (সা.)-এর নববি সম্মান ও মর্যাদার পরিপন্থি ভাবতেন। তাই পাশে দাঁড়ানোর পরেও পিছিয়ে আসতেন কখনও কখনও। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে এলাম। তখন তিনি রাতের শেষ প্রহরের নামাজ আদায় করছিলেন। আমি তার পেছনে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি আমার হাত ধরে তার পাশে দাঁড় করালেন। যখন তিনি নামাজে মনোযোগী হলেন, তখন আমি পিছিয়ে এলাম। নামাজ শেষে নবীজি (সা.) বললেন, ‘কী ব্যাপার, পেছনে চলে গেলে যে?’ আমি বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! কারও জন্য কি আপনার বরাবর দাঁড়ানো সমীচীন? অথচ আপনি তো হলেন আল্লাহর রাসুল। আল্লাহতায়ালা আপনাকে অনেক কিছু দান করেছেন।’ তার এ শ্রদ্ধা-ভালোবাসাপূর্ণ কথা নবীজি (সা.)-এর ভালো লাগল। তিনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য ইলম বাড়িয়ে দেয়ার দোয়া করলেন। (মুসনাদে আহমদ : ৩০৬০)।

চুলও মাটিতে পড়তে না দেয়া

সাহাবায়ে কেরাম (রা.) প্রিয়নবী সা.)-এর প্রতিটি জিনিসই সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। এমনকি তার মাথা মু-ানো চুলের প্রতিও ছিল সেই সম্মান ও শ্রদ্ধা। তাই নবীজি (সা.)-এর চুল মাটিতে পড়াও তারা বরদাশত করতেন না। আনাস (রা.) বলেন, আমি দেখেছি, একজন নাপিত রাসুল (সা.)-এর মাথা মু-াচ্ছে আর সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। তারা চাচ্ছিলেন, নবীজি (সা.)-এর মাথার প্রতিটি চুল যেন কোনো না কোনো ব্যক্তির হাতে পড়ে। (মুসলিম : ২৩২৫)।

নবীজির কারণে তওয়াফ না করা

হোদাইবিয়ায় পৌঁছার পর রাসুল (সা.) ওসমান (রা.)-কে এই বার্তা পৌঁছানোর জন্য পাঠালেন যে, তাদের উদ্দেশ্য শুধু ওমরা করা; অন্য কিছু নয়। ওসমান (রা.) যখন মক্কাবাসীর কাছে নবীজি (সা.)-এর বার্তা পৌঁছে দিলেন, তখন তারা বলল, ‘চাইলে তুমি বাইতুল্লাহ তওয়াফ করতে পার।’ ওসমান (রা.) বললেন, ‘রাসুল (সা.)-এর তওয়াফের আগে কিছুতেই আমি তওয়াফ করতে পারি না।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম : ২/৩১৫)। মক্কা থেকে ফিরে আসার পর মুসলমানরা তাকে বলল, ‘হে আবু আবদিল্লাহ! তুমি তো প্রাণভরে বাইতুল্লাহ তওয়াফ করে এসেছ?’ তখন ওসমান (রা.) বললেন, ‘তোমরা আমার ব্যাপারে বড় মন্দ ধারণা পোষণ করেছ। আল্লাহর কসম! আল্লাহর রাসুলের হোদাইবিয়ায় থাকাবস্থায় আমি যদি মক্কায় এক বছরও থাকতাম, তবুও বাইতুল্লাহ তওয়াফ করতাম না, যতক্ষণ না রাসুল (সা.) তওয়াফ করতেন। কোরাইশরা আমাকে তওয়াফ করার কথা বলেছিল, কিন্তু আমি তা অস্বীকার করেছি।’ (যাদুল মাআদ : ১/৩৮২)।

নবীভক্তের কারণে নির্দেশ না মানা

হোদাইবিয়ায় মুসলমান ও মুশরিকদের মাঝে ১০ বছরের জন্য সন্ধি হয়েছিল। সন্ধির ধারা-উপধারাগুলো স্থির হওয়ার পর নবীজি (সা.) আলী (রা.)-কে বললেন, ‘লেখ! এ সন্ধিপত্রের ওপর আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ সম্মত হয়েছেন।’ তখন মুশরিকদের প্রতিনিধি সুহাইল বলে উঠল, ‘আমরা যদি জানতামই, আপনি আল্লাহর রাসুল, তাহলে বাইতুল্লাহর পথে বাঁধাও দিতাম না, যুদ্ধবিগ্রহও করতাম না। সুতরাং আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ না লিখে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ লিখুন।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমি আল্লাহর রাসুল, যদিও তোমরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন কর।’ তারপর আলী (রা.)-কে বললেন, ‘আল্লাহর রাসুল কেটে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ লেখ।’ নবীপ্রেমে আপ্লুত আলী (রা.) নবীজি (সা.)-এর প্রতি যার পর নয় ভক্তি ও ভালোবাসার কারণে বলে দিলেন, ‘আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ রাসুল (সা.) তখন নিজ হাতে তা মুছে দিলেন। (মুসনাদে আবু আওয়ানা : ৬৭৯৩)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত