মহানবীর বদান্যতা

আবদুল কাইয়ুম শেখ

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বনবী (সা.)-এর মধ্যে বদান্যতার গুণ পুরোপুরিভাবে বিদ্যমান ছিল। নবী করিম (সা.) অত্যন্ত মহানুভব, দানশীল ও বদান্য ছিলেন। আল্লাহর ওপর নির্ভর করে অভাবের ভয় ছাড়া প্রচুর পরিমাণে দান করতেন। যদি কোনো ব্যক্তি তাঁর কাছে কিছু চাইত, তাহলে তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না। প্রার্থনাকারীকে ফিরিয়ে দেওয়া তার অভ্যাস ছিল না। যাচ্ঞাকারীকে নিরাশ করা তার অভিধানে ছিল না। তিনি নিজের পছন্দনীয় এবং প্রয়োজনীয় বস্তুও মানুষকে অকাতরে দান করতেন। যদি কেউ কোনো বস্তু তাঁর কাছে চাইত, তাহলে তিনি তাকে কাঙ্ক্ষিত বস্তু দিয়ে দিতেন। সাহল ইবনে সাদ (রা.) বলেন, এক নারী মহানবী (সা.)-এর কাছে একখানা বুরদা নিয়ে এলো। সাহল (রা.) লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি জানেন, বুরদা কী?’ তারা বললেন, ‘তা ডোরাকাটা চাদর।’ সাহল (রা.) বললেন, ‘এটি এমন চাদর, যা ঝালরসহ বোনা।’ এরপর সেই নারী আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনাকে এটি পরার জন্য দিলাম।’ নবীজি (সা.) চাদরখানা এমনভাবে গ্রহণ করলেন, যেন তার এটির দরকার ছিল। তিনি তা পরলেন। এরপর সাহাবিদের মধ্যে এক ব্যক্তি সেটি তার দেহে দেখে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা কতই না সুন্দর! আপনি এটি আমাকে দিয়ে দিন।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘হ্যাঁ, দিয়ে দেব।’ নবীজি (সা.) উঠে চলে গেলেন। অন্যান্য সাহাবিরা তাকে দোষারোপ করে বললেন, ‘তুমি ভালো কাজ করনি। যখন তুমি দেখলে যে, এটি তার প্রয়োজন ছিল বলেই তিনি এমনভাবে গ্রহণ করেছেন। এরপরও তুমি সেটা চাইলে? অথচ তুমি অবশ্যই জানো যে, তার কাছে কোনো জিনিস চাওয়া হলে তিনি কাউকে কখনও বিমুখ করেন না।’ তখন সেই ব্যক্তি বললেন, ‘যখন নবীজি (সা.) এটি পরেছেন, তখন তার বরকত লাভের জন্যই আমি এ কাজ করেছি; যাতে এ চাদরে আমার কাফন হয়।’ (বোখারি : ৬০৩৬)।

অভাবের আশঙ্কা না করেই দান

মহানবী (সা.)-এর মহানুভবতা প্রবাদপ্রতীম ছিল। সাধারণ লোকদের জানা ছিল, বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে প্রার্থনা করা হলে তিনি খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। তাই আরবের লোকেরা মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে নিজেদের অভাব-অভিযোগ পেশ করত। বিশ্বনবী (সা.) তাদের অভাব-অভিযোগ শুনে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। প্রার্থীকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী দান করতেন। আনাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করার পর কেউ কিছু চাইলে তিনি অবশ্যই তা দিয়ে দিতেন। এক লোক তাঁর কাছে এলো। তিনি তাকে এত বেশি ছাগল দিলেন, যাতে উপত্যকার মাঝামাঝি স্থান পূর্ণ হয়ে যাবে। এরপর সে লোক তার গোত্রের কাছে গিয়ে বলল, হে আমার জাতি ভাইয়েরা! তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। কারণ, মুহাম্মদ (সা.) অভাবের আশঙ্কা না করে দান করতেই থাকেন।’ (মুসলিম : ২৩১২)।

কাঁটাদার গাছের পরিমাণ পশু হলেও দান করে দিতাম

একবার কয়েকজন বেদুঈন লোক মহানবী (সা.)-এর কাছে কিছুটা অশিষ্ট পন্থায় গনিমতের মাল প্রার্থনা করল। কিন্তু তারপরও মহানবী (সা.) এসব লোকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেননি। তিনি সুন্দর পন্থায় তাদের কাছে অপারগতা প্রকাশ করেন। যুবাইর ইবনে মুতঈম (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলেন। আর তখন তার সঙ্গে আরও লোক ছিল। রাসুল (সা.) হুনাইন থেকে ফিরছিলেন। বেদুঈন লোকেরা তার কাছে গনিমতের মাল নেওয়ার জন্য তাঁকে আঁকড়ে ধরল। এমনকি তারা তাঁকে একটি বাবলা গাছের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিল। কাঁটা তাঁর চাদর আটকে ধরল। তখন রাসুল (সা.) থামলেন। বললেন, ‘আমার চাদরটি দাও। আমার কাছে যদি এসব কাঁটাদার বুনো গাছের পরিমাণ পশু থাকত, তবে সেগুলো তোমাদের মাঝে বণ্টন করে দিতাম। এরপরও আমাকে তোমরা কখনও কৃপণ, মিথ্যাচারী এবং কাপুরুষ পাবে না।’ (বোখারি : ৩১৪৮)।

রহমতের বায়ু অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন

বিশ্বনবী (সা.)-এর মহানুভবতা, বদান্যতা ও দানশীলতার কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। বাতাসের দান যেমন ব্যাপক ও বিস্তৃত, বাতাস যেমন বিশ্বের প্রতিটি প্রাণীকে অকাতরে ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিমাণে দান করে যাচ্ছে, ঠিক তেমনিভাবে বিশ্ববাসীর ওপর মহানবী (সা.)-এর দানও ব্যাপক, বিস্তৃত ও সর্বব্যাপী। বাতাসের দান থেকে পৃথিবীর কোনো প্রাণী মুক্ত নয়। ঠিক তেমনিভাবে মহানবী (সা.)-এর মহানুভবতা ও দানশীলতা থেকেও বিশ্বের কোনো ব্যক্তি মুক্ত নয়। এ কারণেই হাদিস শরিফে মহানবী (সা.)-এর বদান্যতাকে বাতাসের দানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ দানশীল ছিলেন। রমজানে তিনি আরও অধিক দানশীল হতেন, যখন জিবরাঈল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমজানের প্রতিটি রাতেই জিবরাঈল (আ.) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। তাঁরা একে অপরকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসুল (সা.) রহমতের বায়ু অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন।’ (বোখারি : ৬)। এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আমার কাছে যদি ওহুদ পরিমাণ সোনাও থাকে, তাহলে সেই বিপুল পরিমাণ সোনা তিনদিনের অধিক আমার হাতে থাকুক, সেটা আমার পছন্দ নয়। অবশ্য আমার ওপর যদি কোনো ঋণ থাকে, তাহলে সেই ঋণ আদায় করার পরিমাণ সোনা আমি রেখে দেব। এরপর যতটুকু অবশিষ্ট থাকবে, সবটুকু আল্লাহর রাস্তায় অকাতরে বিলিয়ে দেব।’ এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার যদি ওহুদ পরিমাণ সোনাও হয়, আর তার কিছু অংশ তিন দিন পার হওয়ার পরও আমার কাছে থাকবে, তা আমাকে খুশি করবে না। তবে যদি ঋণ পরিশোধের জন্য হয়, তবে ভিন্ন কথা।’ (বোখারি : ৬৪৪৫)।

অনুসারীদেরও দানে উৎসাহিত করতেন

মহানবী (সা.) শুধু নিজে দান করতেন, তা নয়; বরং তাঁর অনুসারী ব্যক্তিদেরও দান করার জন্য উৎসাহিত করতেন। তিনি লোকদের দান করার জন্য উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘যেসব লোক দান করে, তাদেরকে আল্লাহতায়ালা প্রতিদান প্রদান করেন। পক্ষান্তরে যেসব লোক কৃপণতা অবলম্বন করে, আল্লাহতায়ালা তাদেরকে সংকোচিত করে দেন।’ একদিকে দান করতে থাকলে অন্যদিকে আল্লাহতায়ালাও প্রদান করতে থাকেন। পক্ষান্তরে দান করা থেকে বিরত থাকলে আল্লাহতায়ালাও এমন ব্যক্তিকে প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান প্রদান করুন। আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।’ (বোখারি : ১৪৪২)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া

ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা