ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহানবীর ন্যায়বিচার

আবদুল কাইয়ুম শেখ
মহানবীর ন্যায়বিচার

মহানবী (সা.) ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচারক ছিলেন। তিনি সর্বদা ন্যায়বিচার করতেন। অন্যায্য বিচার কখনও করতেন না। বিচারের ক্ষেত্রে আপন-পর ও শত্রু-মিত্র সবাই তার দৃষ্টিতে সমান ছিল। আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান দর্শন তার বিচারের মূলনীতি ছিল। একবার কোরাইশ গোত্রের এক নারী চুরি করল। তার হাত কাটা নিয়ে কোরাইশের লোকেরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। তারা ভাবতে লাগল, এটা কোরাইশের জন্য লাঞ্ছনাকর ও অসম্মানজনক। এ জন্য তারা এ নারীর দণ্ড মওকুফ করার ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে কথা বলতে পারে, এমন একজন ব্যক্তি খোঁজ করল। এরপর পরস্পরে পরামর্শ করে উসামা বিন যায়েদ (রা.)-কে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য নির্বাচিত করল। তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে নারীর হাত না কাটার বা তার দণ্ড মওকুফ করার সুপারিশ করলেন। এতে রাগে রাসুল (সা.)-এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। ঘটনাক্রমে চোর নারীর নাম ছিল ফাতেমা। রাসুল (সা.) উসামা বিন যায়েদ (রা.)-কে বললেন, ‘যদি আমার মেয়ে ফাতেমাও চুরি করত, তাহলেও আমি তার হাত কেটে দিতাম।’ ঘটনাটি বোখারি শরিফে একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, মাখজুম গোত্রের এক চোর নারীর ঘটনা কোরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল, এ ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে কে আলাপ করতে পারে? তার বলল, একমাত্র রাসুল (সা.)-এর প্রিয়তম উসামা বিন যায়েদ (রা.) এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন। উসামা (রা.) নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে কথা বললেন। মহানবী (সা.) বললেন, ‘তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘকারিণীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ?’ এরপর মহানবী (সা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমাদের আগের জাতিগুলোকে এ কারণেই ধ্বংস করা হয়েছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে যখন কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা ফাতেমাও চুরি করত, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম!’ (বোখারি : ৩৪৭৫)।

সম্পদ বণ্টনে ন্যায়পরায়ণতা ও সমতা বিধান

কিছু লোক আপন সন্তানদের মাঝে নিজের সম্পদ বণ্টন করে দেয়। এ ক্ষেত্রে তারা বৈষম্যমূলক আচরণ করে। কাউকে বেশি দেয়, আবার কাউকে কম দেয়। এমনটি করা সমীচীন নয়। মহানবী (সা.) এমন বৈষম্যমূলক বণ্টন পছন্দ করতেন না। তাঁর দরবারে এমন একটি অভিযোগ উত্থাপিত হলে তিনি কৃত বণ্টন প্রত্যাখ্যান করেন। আমির (রহ.) বলেন, আমি নোমান ইবনে বশির (রা.)-কে মিম্বরে বলতে শুনেছি, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন আমার মা আমরা বিনতে রাওয়াহা (রা.) বললেন, রাসুল (সা.)-কে সাক্ষী রাখা ছাড়া সম্মত নই। তখন তিনি রাসুল (সা.)-এর কাছে এলেন। বললেন, ‘আমরা বিনতে রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসুল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে।’ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম দিয়েছ?’ তিনি বললেন, ‘না।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর।’ (বোখারি : ২৫৮৭)।

জান্নাতি ও জাহান্নামি বিচারকের পরিচয়

মানুষ নির্যাতন-নিপীড়ন বা অধিকার বঞ্চিত হয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়। বিচারকের শরণাপন্ন হয়। কিন্তু অনেক সময় বিচারক ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ করে সঠিক রায় প্রদান করে না। অধিকারবঞ্চিত মানুষ আদালত পাড়ায় ঘুরতে ঘুরতে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। অনেক সময় হয়ে যায় সর্বস্বান্ত। যেসব বিচারক প্রকৃত বিষয় তদন্ত করে ন্যায়বিচার করে না কিংবা ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণ করার পর পক্ষপাতমূলক রায় প্রদান করে, মহানবী (সা.) তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ইবনে বুরাইদা (রা.) তার পিতার সূত্রে বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘বিচারক তিন প্রকার। এক প্রকার বিচারক জান্নাতি এবং অপর দুই প্রকার বিচারক জাহান্নামি। জান্নাতি বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে সে অনুযায়ী ফয়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পর স্বীয় বিচারে জুলুম করে, সে জাহান্নামি এবং যে বিচারক অজ্ঞতাপ্রসূত ফয়সালা দেয়, সেও জাহান্নামি।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৫৭৩)।

স্ত্রীদের সঙ্গে সমতা রক্ষা

আপন স্ত্রীদের সঙ্গে সমতা বজায় রাখা মহানবী (সা.)-এর আদর্শ ছিল। একজনকে কাপড় একটি দেবেন, আর অপরজনকে দুটি দেবেন, একজনকে ভালো মানের খাবার দেবেন এবং অপরজনকে মন্দ মানের খাবার দেবেন, এমনটি তিনি কখনও করতেন না। স্ত্রীদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করার অভ্যাস তার ছিল না। এমনকি রাসুল (সা.) রাত্রিযাপনের ক্ষেত্রেও প্রত্যেক স্ত্রীর সঙ্গে সমতা বজায় রেখে চলতেন। এটা ছিল তার ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতার অনন্য নিদর্শন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) সফরের মনস্থ করলে স্ত্রীদের মধ্যে লটারির ব্যবস্থা করতেন। যার নাম আসত, তিনি তাকে নিয়েই সফরে বেরুতেন। এ ছাড়া প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য একদিন একরাত নির্দিষ্ট করে দিতেন। তবে সাওদা বিনতে জামআ (রা.) নিজের দিন ও রাত নবীজি (সা.)-এর স্ত্রী আয়েশা (রা.)-কে দান করেছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি রাসুল (সা.)-এর সন্তুষ্টি কামনা করতেন। (বোখারি : ২৫৯৩)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত