মহানবী (সা.) অত্যন্ত ক্ষমাশীল ছিলেন। তার ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে কেউ কোনো অপরাধ করলে তিনি তাকে ক্ষমা করে দিতেন। কেউ তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করলে তাকে ক্ষমা করতে পিছপা হতেন না। শক্তি থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধ নিতেন না। লোকদের কটূ কথায় ধৈর্য ধারণ করতেন। নিজে পাল্টা কটূ কথা বলতেন না। শরয়ি বিষয় ছাড়া ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে যদি কোনো ব্যক্তি তার সঙ্গে অপরাধ করত, তাহলে তিনি মার্জনা করে দিতেন। তার জীবনে বহু অপরাধী ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দেয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তার নিজ হাতে কোনোদিন কাউকে আঘাত করেননি; কোনো নারীকেও না, কোনো সেবককেও না। আর যে তার অনিষ্ট করেছে, তার থেকেও তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। তবে আল্লাহর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়, এমন বিষয়ে তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন।’ (মুসলিম : ৫৯৪৪)। অন্য আরেকটি হাদিসে এসেছে, আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে চলছিলাম। এ সময় তার পরনে চওড়া পাড়ওয়ালা একটি নাজরানি ডোরাদার চাদর ছিল। একজন বেদুঈন তার কাছে এলো। সে তার চাদর ধরে খুব জোরে টান দিল। এমনকি আমি দেখতে পেলাম রাসুল (সা.)-এর কাঁধে চাদরের পাড়ের দাগ পড়ে গেছে। তারপর সে বলল, ‘হে মুহাম্মদ! আপনার কাছে আল্লাহপ্রদত্ত যে সম্পদ আছে, তা থেকে কিছু আমাকে দিতে বলুন।’ রাসুল (সা.) তার দিকে ফিরে তাকিয়ে হাসলেন এবং তাকে কিছু দান করার নির্দেশ দিলেন। (বোখারি : ৫৮০৯)। উল্লিখিত হাদিসের আলোকে প্রতীয়মান হয়, মহানবী (সা.)-এর চাদরে টান দিয়ে বেদুঈন বেয়াদবি করা সত্ত্বেও রাসুল (সা.) তাকে ক্ষমা করে দেন।
শত্রুকে তরবারির নিচে পেয়েও মুক্তিদান
তৃতীয় হিজরিতে সাড়ে চারশত লোক নিয়ে দাসুর ইবনুল হারিস মুহারেবি মদিনা শরিফে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসে। রাসুল (সা.) শত্রুর মোকাবিলা করতে মদিনার বাইরে এলে শত্রুসৈন্য সবাই দৌড়ে পালিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। রাসুল (সা.) নিশ্চিন্ত হয়ে ময়দান থেকে ফিরে এলেন। সে সময় ঘটনাক্রমে বিশ্বনবী (সা.)-এর জামা বৃষ্টিতে ভিজে যায়। রাসুল (সা.) জামাটি শুকানোর জন্য একটি গাছের ওপর ছড়িয়ে দেন। নিজে সেই গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়েন। এদিকে দাসুর পাহাড়ের ওপর থেকে সবকিছুই দেখছিল। যখন সে দেখল, রাসুল (সা.) নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়েছেন, তখন তার কাছে এসে উপস্থিত হয়ে তরবারি মাথা বরাবর উঁচু করে ধরে বলল, ‘বল দেখি! এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে?’ রাসুল (সা.) এ অবস্থা দেখেও কোনো প্রকার ভীতবিহ্বল না হয়ে নির্ভীক মনে উত্তর দেন, ‘আল্লাহতায়ালা আমাকে বাঁচাবেন।’ এ কথা শুনে দাসুরের শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়। তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে যায়। তখন রাসুল (সা.) তরবারি হাতে নিয়ে বললেন, ‘তুমি বলো! এখন তোমাকে কে বাঁচাবে?’ তার কাছে ‘কেউ নয়’ বলা ছাড়া আর কোনো জবাব ছিল না। রাসুল (সা.) তার অসহায় অবস্থা দেখে ক্ষমা করে দেন। (সিরাতে মোগলতাই : ৪৯)।
উবাইয়ের বেআদবি ও রাসুলের ক্ষমা
আল্লাহতায়ালার একত্ববাদের বাণী প্রচার করতে গিয়ে মহানবী (সা.)-কে বহু বাঁধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ পথে তাকে বহু ভর্ৎসনা ও তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি বিরক্ত না হয়ে দ্বীন ইসলামের প্রচার প্রসারে অটল-অবিচল থেকেছেন। আল্লাহর দ্বীন প্রচার করার সময় যেসব লোক মহানবী (সা.)-কে কষ্ট দিয়েছে, তিনি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। ওসামা ইবনে যায়েদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) একটি গাধায় আরোহণ করলেন; যার ওপর বসার গদি ছিল। তার নিচে একটি ফাদাকি মখমল বিছানো ছিল। তিনি তার পেছনে ওসামা (রা.)-কে বসালেন। বনি হারিস ইবনে খাযরাজ গোত্রের এলাকায় তিনি সাদ ইবনে ওবাদা (রা.)-কে (অসুস্থ অবস্থায়) দেখতে যাচ্ছিলেন। এটি ছিল বদর যুদ্ধের আগের ঘটনা। তিনি এমন একটি মজলিস অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন, যেখানে মুসলমান, মুশরিক, পৌত্তলিক ও ইহুদিরা একত্রে বসা ছিল। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই এবং আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.)-ও ছিলেন। যখন মজলিসটি সওয়ারির ধূলায় আচ্ছন্ন হলো, তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার নাক চাদর দিয়ে ঢেকে নিল। এরপর বলল, ‘আপনারা আমাদের ওপর ধূলি তুলবেন না।’ তখন মহানবী (সা.) তাদের সালাম দিলেন। তারপর তিনি সেখানে থামলেন ও নামলেন। আর তাদের আল্লাহর পথে দাওয়াত দিলেন। তাদের সামনে কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করলেন। তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলে উঠল, ‘ওহে লোক! আপনি যা বলছেন, তা যদি সত্য হয়, তবে এর চেয়ে উত্তম আর কিছু নয়; তবে আমার মজলিসে এসে আপনি আমাদের কষ্ট দেবেন না। আপনি আপনার বাসস্থানে ফিরে যান। সেখানে আমাদের মধ্যকার যে ব্যক্তি যায়, তার কাছে আপনি এসব উপদেশ পরিবেশন করবেন।’ তখন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা (রা.) বলে উঠলেন, ‘(হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের মজলিসে যত খুশি) ধূলি উড়াবেন। কেননা, আমরা তা পছন্দ করি। তখন মুসলমান, মুশরিক, ইহুদিরা পরস্পরে বাদানুবাদ ও গালাগালিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল। এমনকি রীতিমতো একটি দাঙ্গা বাঁধার উপক্রম হলো। মহানবী (সা.) তাদের নিবৃত করতে লাগলেন। তারপর তার বাহনে সওয়ার হয়ে সাদ ইবনে ওবাদা (রা.)-এর বাড়ি গিয়ে প্রবেশ করলেন। এরপর বললেন, ‘হে সাদ! তুমি কি শোননি আবু হুবাব অর্থাৎ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই কী বলেছে? সে এরূপ এরূপ কথা বলেছে।’ সাদ (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! ওকে ক্ষমা করে দিন এবং উপেক্ষা করুন। আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন, তা তো দিয়েছেনই। (কিন্তু তার ব্যাপার?) এ জনপদের লোকজন স্থির করেছিল যে, তাকে রাজমুকুট ও পাগড়ি পরাবে। (অর্থাৎ তাকে তাদের বাদশা বানাবে)। কিন্তু আল্লাহতায়ালা আপনাকে যে সত্য দান করেছেন, তা দিয়ে যখন আল্লাহতায়ালা তার চাওয়া-পাওয়াকে রুদ্ধ করে দিলেন, তাতে বিদ্বেষপ্রবণ হয়ে পড়ে। তাই সে এরূপ আচরণ করেছে, যা আপনি দেখছেন।’ এতে মহানবী (সা.) তাকে ক্ষমা করে দিলেন। (মুসলিম : ৪৫৫১)।
স্বগোত্রীয় লোকদের জুলুমে ক্ষমাশীলতার পরিচয়
দ্বীন ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে মহানবী (সা.)-কে বহু জুলুমণ্ডনির্যাতন, অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে; বহু কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করতে হয়েছে। পরিবার-পরিজনসহ তাকে আবু তালিবের ঘাঁটিতে তিন বছরের দুঃসহ বন্দি জীবন অতিক্রম করতে হয়েছে। আপন জন্মভূমি মক্কা হতে বিতাড়িত হতে হয়েছে। মক্কার কোরাইশের কাফেররা তাকে অমানবিক কষ্ট দিয়েছে ও পাশবিক নির্যাতন করেছে। এত সব অপরাধ করা সত্ত্বেও মহানবী (সা.) তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, একবার তিনি নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহুদের দিনের চেয়ে কঠিন কোনোদিন কি আপনার ওপর এসেছিল?’ তিনি বললেন, আমি তোমার কওম হতে যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, তা তো হয়েছি। তাদের হতে অধিক কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি আকাবার দিন, যখন আমি নিজেকে ইবনে আবদে ইয়ালিল ইবনে আবদে কলালের কাছে পেশ করেছিলাম। আমি যা চেয়েছিলাম, সে তার জবাব দেয়নি। তখন আমি এমনভাবে বিষণ্ন চেহারা নিয়ে ফিরে এলাম যে, কারনুস সাআলিবে পৌঁছা পর্যন্ত আমার চিন্তা দূর হয়নি। তখন আমি মাথা ওপরে তুললাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম, এক টুকরো মেঘ আমাকে ছায়া দিচ্ছে। আমি সেদিকে তাকালাম। তার মধ্যে ছিলেন জিবরাইল (আ.)। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘আপনার কওম আপনাকে যা বলেছে এবং তারা উত্তরে যা বলেছে, তার সবই আল্লাহ শুনেছেন। তিনি আপনার কাছে পাহাড়ের ফেরেশতাকে পাঠিয়েছেন। এদের সম্পর্কে আপনার যা ইচ্ছা আপনি তাকে হুকুম দিতে পারেন।’ তখন পাহাড়ের ফেরেশতা আমাকে ডাকলেন এবং সালাম দিলেন। অতঃপর বললেন, ‘হে মুহাম্মদ! এসব ব্যাপার আপনার ইচ্ছাধীন। আপনি যদি চান, তাহলে আমি তাদের ওপর কঠিন শিলার দুই পাহাড়কে চাপিয়ে দেব।’ উত্তরে নবীজি (সা.) বললেন, ‘না, বরং আশা করি, মহান আল্লাহ তাদের বংশধরদের থেকে এমন সন্তান জন্ম দেবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে; আর তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না।’ (বোখারি : ৩২৩১)।
সেবককে দিনের পর দিন ক্ষমা করতেন
আমরা যদি নিজের খেদমতের জন্য কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ দিই কিংবা ঘরের কাজকর্ম আঞ্জাম দেওয়ার জন্য যদি কোনো ব্যক্তিকে নিয়োজিত করি, তাহলে সকাল-সন্ধ্যায় তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনি। পান থেকে চুন খসলেই বলি, কাজটি এভাবে কেন করলে? এভাবে কেন করলে না? অনেক সময় নিজের সেবককে মারধর করি, হুমকি-ধমকি দিই। কাজের লোককে হত্যা করার সংবাদও মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উঠে আসে। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর আদর্শ এমন ছিল না। তিনি নিজের সেবককে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এবং বছরের পর বছর ক্ষমা করতেন। সেবকের কাজে বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি দশ বছর রাসুল (সা.)-এর খেদমত করেছি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে কখনও উফ শব্দটি পর্যন্ত বলেননি। কোনো কাজের জন্য এ কথা বলেননি, তুমি এ কাজ কেন করলে এবং এটা কেন করলে না?’ (মুসলিম : ২৩০৯)। উল্লিখিত হাদিসের মাধ্যমে প্রতীয়মান হয়, আনাস (রা.) দীর্ঘ দশ বছর সময় মহানবী (সা.)-এর খেদমত করেছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই, এ দীর্ঘ সময়ে তিনি হাজারো ভুল করেছেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও মহানবী (সা.) ক্ষমার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। এ সুদীর্ঘ সময়ে তিনি তার খাদেমকে লক্ষ্য করে উফ শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি। কোনো কাজে বিরক্তি প্রকাশ করেননি। এটা ক্ষমাশীলতার নববি চরিত্র বৈ কিছু নয়। বিশ্বনবী (সা.) তার সেবককে দৈনিক কতবার ক্ষমা করতেন, তা বিভিন্ন হাদিসের মাধ্যমেও অনুমেয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা কাজের লোককে প্রতিদিন কতবার ক্ষমা করব?’ তিনি চুপ থাকলেন। লোকটি আবার একই প্রশ্ন করলে এবারও তিনি চুপ থাকলেন। তৃতীয়বার প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, ‘প্রতিদিন সত্তর বার।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫১৬৪)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া
ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা