ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শত্রুর হাতে ভালোবাসার ফুল

আবদুল্লাহ হাসান কসেমি
শত্রুর হাতে ভালোবাসার ফুল

বিশ্বনবী (সা.) ছিলেন সত্য ও সত্যবাদিতার সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ আধার। আপন-পর, শত্রু-মিত্র, নিকটবর্তী-দূরবর্তী, স্ত্রী-প্রতিবেশী-পরদেশী সবার সঙ্গে সর্বাবস্থায় তিনি সত্য সঠিক কথা বলতেন। মিথ্যা থেকে যোজন যোজন দূরে থাকতেন। বস্তুত সত্য ও সত্যবাদিতা ছিল তার আত্মার আত্মীয় ও হৃদয়ের স্পন্দন। এ জন্যই হুনাইন যুদ্ধের পর পরাস্ত হওয়া জিন গোত্রের প্রতিনিধিদল যখন মুসলমান হয়ে উপস্থিত হয়েছিল এবং গনিমতরূপে মুসলমানদের হস্তগত তাদের সম্পদ ও যুদ্ধবন্দিদের প্রত্যার্পণের দাবি জানিয়েছিল, তখন নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ও পছন্দনীয় হলো, সত্যকথন।’ অসাধারণ এ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে জাহেলি যুগের জাহেলি মানুষদের মাঝেও তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন সত্যবাদী নামে। নবুয়ত লাভের পর যখন তিনি দ্বীনের প্রচার শুরু করেন এবং মানুষকে তাওহিদের বাণী শোনাতে থাকেন, তখন আপন-পর সবাই তার বিরুদ্ধে জ্বলে উঠেছিল। চরম শত্রুতে পরিণত হয়েছিল তারা। তারপরও কোরাইশরা নবীজি (সা.)-এর সত্যবাদিতার মহৎ গুণটিকে অস্বীকার করতে পারেনি; বরং ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বিভিন্ন সময় তারা অকপটে স্বীকার করেছে তার সত্যবাদিতা।

নবীজি (সা.) কখনও মিথ্যা বলেননি

আবু সুফিয়ান শুরুতে ছিলেন ইসলামের ঘোর দুশমন। ইসলাম গ্রহণের আগে সব যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে থাকত আগে আগে প্রথম সারিতে। ইসলাম গ্রহণ করার আগেও রোমসম্রাটের দরবারে নির্দ্বিধায় সে স্বীকার করেছিল নববি চরিত্রের অতুল সৌন্দর্যের কথা। সম্রাট তাকে নবীজি (সা.)-এর সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকেন। একপর্যায়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা, তোমাদের জানামতে তিনি কি কখনও মিথ্যা বলেছেন?’ আবু সুফিয়ান বলল, ‘না।’ সম্রাট পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘তিনি কি কখনও তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন?’ আবু সুফিয়ান বলল, ‘এখনও করেননি। সামনে দেখা যাবে।’ সম্রাট আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তিনি কী শিক্ষা দেন?’ আবু সুফিয়ান বলল, ‘তিনি বলেন- এক আল্লাহর ইবাদত কর, সালাত আদায় কর, চারিত্রিক পবিত্রতা অর্জন কর, সত্য কথা বল এবং আত্মীয়-স্বজনকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দাও।’ (বোখারি : ৭)।

কখনও মিথ্যা বলতে শুনিনি

মিসওয়ার ইবনে মাখরামা আবু জাহেলকে বলল, ‘মামা! আপনারা কি কখনও মুহাম্মদকে তার বাণী প্রচারের আগে মিথ্যা বলতে দেখেছেন?’ আবু জাহেল বলল, ‘ভাগিনা! মুহাম্মদ তো যৌবনে আমাদের মাঝেই ছিল। তাকে আল আমিন বলে ডাকা হতো। কিন্তু কখনও আমরা তাকে মিথ্যা বলতে দেখিনি।’ মিসওয়ার বলল, ‘মামা! তাহলে কেন আপনারা তার কথা মানতে পারছেন না?’ আবু জাহেল বলল, ‘ভাগিনা! বরাবর আমাদের মাঝে এবং বনি হাশেমের মাঝে মর্যাদার দ্বন্দ্ব-প্রতিযোগিতা ছিল। যখনই তারা খাবার খাইয়েছে, আমরাও খাবার খাইয়েছি। যখনই তারা পানি পান করিয়েছে, আমরাও পানি পান করিয়েছি। যখনই তারা আশ্রয় দান করেছে, আমরাও আশ্রয় দান করেছি। এমনকি যখন আমরা গৌরব ও মর্যাদায় সমান সমান হয়ে গেলাম, তখন তারা বলতে শুরু করল, আমাদের মধ্যে একজন নবীর আগমন ঘটেছে। তো বলো, কীভাবে আমরা এ মর্যাদা লাভ করব?’ (হেদায়াতুল হায়ারা : ১/৪১)।

নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ সত্যবাদী

বদর যুদ্ধের দিন আখনাস ইবনে শুরায়িক আবু জাহেলকে বলল, ‘হে আবুল হাকাম! আমাকে মুহাম্মদ সম্পর্কে একটু বলুন তো, তিনি সত্যবাদী নাকি মিথ্যাবাদী? সত্য সত্য বলুন, কোনো ভয় নেই। কারণ, এখানে আমি আর আপনি ছাড়া কোরাইশের কেউ নেই। কেউ আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে না।’ আবু জাহেল বলল, ‘ধুর! কী বলো। আল্লাহর কসম! নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ সত্যবাদী। সে জীবনে কখনও মিথ্যা বলেনি। কিন্তু বনু কুসাই যখন ঝান্ডা, কাবার তত্ত্বাবধান, পানি পান করানো এবং নবুয়তের মতো মর্যাদাশীল দায়িত্বগুলো নিয়ে নিল, তখন বাকি কোরাইশদের জন্য আর কী থাকল?’ (হেদায়াতুল হায়ারা : ১/৪১-৪২)।

সদা সত্য বলতে দেখেছি

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, যখন আয়াত অবতীর্ণ হলো, আপনি আপনার নিকটাত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন করুন, তখন নবীজি (সা.) সাফা পর্বতে আরোহন করলেন। কোরাইশের বিভিন্ন শাখাগোত্র বনি আদি, বনি ফিহর ইত্যাদির নাম ধরে ডাকতে থাকলেন। ফলে সবাই সমবেত হলো। এমনকি যে আসতে পারল না, সেও তার প্রতিনিধি পাঠাল প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য। কোরাইশের মধ্যে আবু লাহাবও ছিল। নবীজি (সা.) সবাইকে সম্বোধন করে বললেন, ‘বল তো, যদি বলি উপত্যকার মাঝে একটি অশ্বারোহী বাহিনী অপেক্ষমাণ; যারা তোমাদের ওপর আক্রমণ করতে উদ্যত, তাহলে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে?’ সবাই একবাক্যে বলল, ‘অবশ্যই, আমরা কখনও আপনাকে মিথ্যা বলতে দেখিনি, সদা সত্য বলতেই দেখেছি।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি তোমাদের আসন্ন এক ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করছি।’ আবু লাহাব বলল, ‘ধ্বংস হোক তোমার সারাটা দিন! এ জন্যই বুঝি তুমি আমাদের এখানে দেখেছো?’ আল্লাহতায়ালা এর উত্তরে আয়াত অবতীর্ণ করলেন, ‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের উভয় হাত এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।’ (বোখারি : ৪৪৯২)।

আমি তাকে সত্যবাদীই মনে করি

হারেস ইবনে আমির প্রকাশ্যে নবীজি (সা.)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করত এবং তাকে মিথ্যাবাদী বলত, কিন্তু যখন পরিবারের লোকদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হলে বলত, যারা মিথ্যা বলে, মুহাম্মদ তাদের অন্তর্ভুক্ত নয়; তাকে আমি সত্যবাদীই মনে করি। (দালাইলুন নবুওয়াহ : ৪১)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ করলেন, ‘আমি অবশ্যই জানি, তারা যে কথা বলে, তা আপনাকে বেদনাভারাক্রান্ত করে; কিন্তু আসল কথা হলো, তারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলে না, বরং জালেমরা আল্লাহর আয়াতগুলোকে অস্বীকার করে।’ (সুরা আনআম : ৩৩)।

আল্লাহর কসম! সে জাদুকর নয়

নজর ইবনে হারেস কোরাইশকে বলল, ‘মুহাম্মদ তরুণ বয়সে তোমাদের মধ্যেই ছিল। সে-ই সবচেয়ে বড় সন্তোষভাজন, সত্যবাদী ও আমানত রক্ষাকারী। কিন্তু যখনই তোমরা তার মাঝে বার্ধক্যের চিহ্ন দেখতে পেলে, আর সে তোমাদের কাছে নতুন বিষয় নিয়ে উপস্থিত হলো, তখন তোমরা বলতে শুরু করলে, সে জাদুকর। আল্লাহর কসম! সে জাদুকর হতে পারে না।’ (দালাইলুন নবুওয়াহ : ৪১)।

আপনি মিথ্যাবাদী আর মুহাম্মদ সত্যবাদী

তালহা নুমাইরি নামক এক ব্যক্তি লোকজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘মুসাইলামা কোথায়?’ তারা বলল, ‘আস্তে, তিনি তো অল্লাহর রাসুল।’ তালহা বলল, না, দেখার আগে আমি তাকে মানতে পারছি না। যখন সে মুসাইলামার কাছে পৌঁছুল, তখন জিজ্ঞেস করলে, ‘আপনি কি মুসাইলামা?’ উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, আমি মুসাইলামা।’ আপনার কাছে কে আসে? মুসাইলামা বলল, ‘রহমান।’ তালহা আবার জিজ্ঞেসা করল, ‘তিনি কি আলোতে আসেন না অন্ধকারে?’ মুসাইলামা বলল, ‘অন্ধকারে।’ তালহার বুঝতে বাকি থাকল না যে, মুসাইলামা একজন ডাহা মিথ্যাবাদী। তাই সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি মিথ্যাবাদী আর মুহাম্মদ সত্যবাদী। তবে মুজরের সত্যবাদী থেকে রবিয়ার বড় মিথ্যাবাদীও আমাদের কাছে প্রিয়। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩৬০)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত