মহানবীর বিনয় ও নম্রতা

আবদুল কাইয়ুম শেখ

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মহানবী (সা.) সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন; তিনি একজন মহামানব, বিশ্বনবী, সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল ও শেষ নবী। এ পৃথিবীতে এমন মহামনীষী তার আগেও আগমন করেনি এবং পরেও তার সমপর্যায়ের সম্মানিত কোনো ব্যক্তি আগমন করবে না। বিশ্বে মানব আগমনের সূচনাকাল থেকে এ পর্যন্ত যে কোনো মানুষকে তার সমান্তরালে দাঁড় করানো হলে নিঃসন্দেহে তিনি শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হবেন। বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী হওয়া সত্ত্বেও মহানবী (সা.)-এর জীবনাচার ছিল অত্যন্ত সাধারণ। তিনি অত্যন্ত নম্র, বিনয়ী ও নিরহংকার ছিলেন। দম্ভ, অহংকার ও আত্মগরিমার লেশমাত্র তার মাঝে ছিল না। বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করার কারণে নবাগন্তুকের জন্য তাকে চেনা কষ্টকর হতো।

নবীজি সাধারণত সাহাবিদের মাঝে বসতেন

আবু যর ও আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এসে সাধারণত সাহাবিদের মাঝেই বসতেন। ফলে কোনো অপরিচিত ব্যক্তি এলে প্রশ্ন না করা পর্যন্ত বলতে পারতেন না, কোন ব্যক্তি মহানবী (সা.)। অতএব, আমরা রাসুল (সা.)-এর কাছে আবেদন করলাম, আমরা তার জন্য একটা বিশেষ স্থান নির্দিষ্ট করব; যেন আগন্তুকরা দেখেই তাঁকে চিনতে পারে। বর্ণনাকারী বলেন, তাই আমরা তাঁর জন্য মাটি দিয়ে একটি বসার স্থান বানালাম। তিনি তার ওপর বসলেন। আমরা তাঁর পাশে বসলাম। বর্ণনাকারী বলেন, এমন সময় এক ব্যক্তি এসে উপস্থিত হলো। সে উপস্থিত জনতার এক প্রান্ত থেকে সালাম দিল। এরপর বলল, ‘হে মুহাম্মদ! আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।’ বর্ণনাকারী বলেন, রাসুল (সা.) তার সালামের জবাব দিলেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৬৯৮)।

তোমাদের মাঝে মুহাম্মদ কে!

বিশ্বনবী (সা.)-এর সাধারণ জীবনযাপনের অবস্থা এ ছিল যে, নতুন কোনো আগন্তুক এলে তাকে চিনতে পারত না। অন্য আরেক হাদিসে এসেছে, আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, একবার আমরা মসজিদে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে বসা ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি সওয়ার অবস্থায় প্রবেশ করল। মসজিদের প্রাঙ্গণে সে তার উটটি বসিয়ে দিল। এরপর সাহাবিদের লক্ষ্য করে বলল, ‘তোমাদের মাঝে মুহাম্মদ (সা.) কে?’ রাসুল (সা.) তখন তাদের সামনেই হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। আমরা বললাম, ‘হেলান দিয়ে বসা সমুজ্জ্বল এ ব্যক্তিই হলেন তিনি।’ (বোখারি : ৬৩)।

গোলামের মতো আহার করি

মহানবী (সা.)-এর বিনয়, নম্রতা ও দর্পশূন্যতার অবস্থা এ ছিল যে, তিনি নিজেকে অত্যন্ত সাধারণ বলে পরিচয় দিতেন। বিশ্বনবী (সা.)-এর সামনে এসে তার ভাবগাম্ভীর্যের কারণে কিছু মানুষ কাঁপতে থাকত। মহানবী (সা.) এমন লোকদের অভয় দিয়ে নিজের পরিচয় খুবই সাধারণভাবে তুলে ধরতেন। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এলো। তিনি লোকটির সঙ্গে কথা বললেন। তার কাঁধের গোশত ভয়ে কাঁপছিল। তিনি তাকে বললেন, ‘তুমি শান্ত হও, স্বাভাবিক হও। কারণ, আমি কোনো রাজা-বাদশাহ নই; বরং আমি শুকনো গোশত খেয়ে জীবনধারিণী এক নারীর সন্তান।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৩১২)। সাধারণ কোনো ব্যক্তির জন্যও নিজেকে গোলাম, কিঙ্কর বা দাস বলে পরিচয় দেওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। কিন্তু এ কঠিন ব্যাপারটিই রাসুল (সা.)-এর জন্য অত্যন্ত সহজ ছিল। তিনি নিজেকে গোলাম বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। মহানবী (সা.) নিজেকে অত্যন্ত সাধারণ ভাবতেন। একটি হাদিসে বিশ্বনবী (সা.) নিজেকে একজন সাধারণ মানুষ ও আল্লাহর গোলাম বলে অভিহিত করেছেন। ইয়াহইয়া ইবনে আবি কাসির (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন গোলাম যেভাবে আহার করে, আমিও ঠিক সাধারণ একজন গোলামের মতো আহার করি। একজন সাধারণ মানুষ যেভাবে বসে, আমিও ঠিক সেভাবে বসি। কেননা, আমি আল্লাহর গোলাম।’ (শুআবুল ঈমান লিল বাইহাকি : ৫৫৭২)।

আমি আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ

একবার এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে নিজের সর্দার বলে অভিহিত করে। সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বনবী (সা.)-এর পিতাকেও সরদার বলে আখ্যায়িত করে। সেই ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি বলে উপাধি দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর পিতাকেও শ্রেষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করে। আজকের পৃথিবী উপাধি পেলে খুশি হয়। কাউকে ভালো উপাধি দিলে সে অত্যন্ত আনন্দিত হয়। কিন্তু মহানবী (সা.) এসব উপাধি শুনে আনন্দিত হননি; বরং তিনি বিনয়ের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। আনাস (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি বলল, ‘হে মুহাম্মদ! হে আমাদের সরদার! আমাদের সরদারের ছেলে! আমাদের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি! আমাদের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির ছেলে!’ কথাগুলো শুনে মহানবী (সা.) বললেন, ‘মানবসকল! তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর। শয়তান যেন তোমাদের বিভ্রান্ত করতে না পারে। আমি আবদুল্লাহর ছেলে মুহাম্মদ। আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আল্লাহর কসম! আমার যে মর্যাদা রয়েছে, তার চেয়ে আরও অধিক মর্যাদায় তোমরা আমাকে অধিষ্ঠিত করবে, তা আমি চাই না।’ (মুসনাদে আহমদ : ১২৫৫১)।

সম্মানার্থে মূর্তির মতো দাঁড়ানো জাহান্নামের কারণ

আজ যদি কোনো ব্যক্তি সাধারণ কোনো পদে আসীন হয় কিংবা সম্মানজনক কোনো পদে সমাসীন হয় অথবা রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়, তাহলে সে কামনা করে, তাকে দেখে যেন অন্যরা দাঁড়িয়ে যায়; তার আগমনে দাঁড়িয়ে যেন সম্মান জানায়। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) এভাবে সম্মান প্রদর্শন করাকে পছন্দ করতেন না। তার সম্মানার্থে কেউ দাঁড়িয়ে যাবে, এমনটি তিনি মেনে নিতে পারতেন না। যদি কেউ তাকে সম্মান প্রদর্শন করার জন্য দাঁড়াত, তাহলে তিনি তাকে ধমক দিতেন ও নিষেধ করতেন। কারও সম্মানার্থে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকাকে জাহান্নামে যাওয়ার কারণ বলে মহানবী (সা.) এক হাদিসে উল্লেখ করেছেন। আবু মিজলায (রহ.) বলেন, মুআবিয়া (রা.) বাইরে বেরুলে তাকে দেখে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ও ইবনে সাফওয়ান (রা.) দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি বললেন, তোমরা দু’জনেই বস। আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে লোক আনন্দিত হয় যে, মানুষ তার জন্য মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকুক, সে যেন জাহান্নামে তার বাসস্থান নির্দিষ্ট করে নেয়।’ (তিরমিজি : ২৭৫৫)।

আমার সম্মানার্থে এভাবে দাঁড়াবে না

একবার কিছু সাহাবি এক স্থানে বসা ছিলেন। এমন সময় রাসুল (সা.) লাঠিতে ভর দেওয়া অবস্থায় তাদের সামনে এলেন। তখন উপস্থিত সাহাবিরা মহানবী (সা.)-এর সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিষয়টি দেখে মহানবী (সা.) তাদেরকে এভাবে দাঁড়াতে বারণ করলেন। এ সম্পর্কে আবু উমামা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) একটি লাঠিতে ভর দেওয়া অবস্থায় আমাদের কাছে এলেন। এ সময় আমরা তার সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে গেলাম। তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার সম্মানার্থে এভাবে দাঁড়াবে না, যেভাবে অনারবরা দাঁড়িয়ে থাকে। তারা এভাবে একে অপরকে সম্মান জানিয়ে থাকে।’ (মুসনাদে বাজ্জার : ৬৬৪২)।

সাধারণ মুসলমানদের জানাজায় অংশ নিতেন

আজকাল কোনো ব্যক্তি ধনী বা সম্পদশালী হলে কিংবা উচ্চতম কোনো মর্যাদায় আসীন হলে অথবা মর্যাদাপূর্ণ কোনো পদে সমাসীন হলে গরিব ও অসহায় লোকদের কাছে যেতে চায় না। তাদের খোঁজখবর নিতে আগ্রহবোধ করে না। অনেক সময় নিজের গরিব আত্মীয়-স্বজনের কাছে যাওয়াকে অসম্মানজনক মনে করে। যতদূর পারা যায়, গরিব, অসহায় ও দুর্বল লোকদের এড়িয়ে চলে। কিন্তু মহানবী (সা.) ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি শুধু আত্মীয়-স্বজন নয়, বরং সাধারণ মুসলমানদের খোঁজখবরও নিতেন। সহায়-সম্বলহীন লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করতেন। তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনতেন। সম্ভব হলে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। রোগীদের দেখতে যেতেন। কারও মৃত্যু হলে তার কাফন-দাফন বা জানাজায় অংশগ্রহণ করতেন। এ প্রসঙ্গে আবু উমামা ইবনে সাহল ইবনে হানিফ তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) গরিব ও অসহায় মুসলমানদের কাছে আগমন করতেন। তিনি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন ও তাদের রোগীদের খোঁজখবর নিতেন। সাধারণ মুসলমানদের জানাজায় অংশ নিতেন। (মুস্তাদরাকে হাকেম : ৩৭৩৫)।

সাধারণ কাজ আঞ্জাম দিতেন

মহানবী (সা.) অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবনযাপন করতেন। তার মধ্যে আমিত্ব, বড়ত্ব, দম্ভ ও অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। অতি সাধারণ লোকদের মতো জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। প্রাত্যহিক কাজকর্ম আঞ্জাম দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করতেন না। নিজের কাজ নিজের হাতে করতেন। যদি কখনও তার জুতা নষ্ট হয়ে যেত, তাহলে নিজ হাতে তালি দিতেন। কাপড় ছিঁড়ে গেলে নিজেই সেলাই করে নিতেন। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঘরের কাজকর্মে যোগদান করতেন। এসব সাধারণ কাজকর্ম আঞ্জাম দিতে তার অহংবোধ প্রতিবন্ধক হতো না। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও এ সাধারণ কাজগুলো অনায়াসেই আঞ্জাম দিতেন। একজন সাধারণ মানুষ তার ঘরের কাজকর্ম যেভাবে আঞ্জাম দিয়ে থাকে, অসাধারণ হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার ঘরের কাজকর্ম সেভাবেই আঞ্জাম দিতেন। এ ব্যাপারে আয়েশা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাসুল (সা.) তার ঘরে কোনো কাজ করতেন?’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘মহানবী (সা.) তার জুতা তালি দিতেন, কাপড় সেলাই করতেন এবং ঘরে তোমরা যেমন কাজ কর, তেমন সাধারণ কাজ আঞ্জাম দিতেন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৬৪৪০)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা