বালকদের বাতিঘর

মুহাম্মদ শেখ মুসা

প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘ওই সুদর্শন চেহারা থেকে বৃষ্টি বর্ষণের করুণা প্রত্যাশা করা হয়। তার চেহারায় খেলা করে এতিমদের আশ্রয়, বিধবাদের প্রশ্রয়।’ আবু তালেব কথাটি বলছিলেন আর আনন্দে আপ্লুত হচ্ছিলেন। তার দরদমাখা কণ্ঠে উচ্ছ্বসিত স্বর বেগ পোহানো ছাড়াই বেরুচ্ছিল, কীসের এত আনন্দ আবু তালেবের মুখে সগৌরবে ভেসে বেড়াচ্ছে? ইবনে আসাকির জালহুমা ইবনে অরফুতাহর বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন, মক্কায় তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল। চারদিকে ক্ষুধার্তের হাহাকার ছড়িয়ে পড়েছে। ঘরে খাদ্য-পানি নেই। এদিকে বৃষ্টির আশা নেই। নেই মেঘের ছিটেফোঁটাও। কোরাইশ বংশের লোকেরা দল বেঁধে ছুটে এলো আবু তালেবের কাছে। আবেদন জানাল, ‘হে আমাদের নেতা! আপনি বৃষ্টি বর্ষণের দোয়া করুন।’

আঙুলের ছোঁয়ায় আকাশজুড়ে মেঘমালা

আবু তালেব উপস্থিত বালকদের মাঝ থেকে একজনকে সঙ্গে করে বেরুলেন। কাবাঘরের সামনে হাজির। লোকেরা একে অপরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তাদের কৌতূহল যেন সময়ের সঙ্গে বেড়েই চলছে। কিচ্ছুটি বুঝে ওঠার আগেই বালকটির পিঠ কাবার দেয়ালের সঙ্গে ঠেকিয়ে দিলেন আবু তালেব। বালক তার আঙুল মোবারক তাতে রাখল। তখনও আকাশে মেঘের কোনো আনাগোনা নেই। কিন্তু অল্পক্ষণ গড়াতেই আকাশজুড়ে মেঘমালা ছেয়ে গেল। শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। লোকেরা থ’ বনে গেল। সে কী লীলা! সেই বালক আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় রাসুল (সা.)। (মুখতাসারুস সিরাত : ১৫-১৬)।

বুহাইরার চিনে ফেলার অবাক কাহিনি

সমগ্র মক্কা তখনও বালক মুহাম্মদকে পূর্ণরূপে চিনতে পারেনি; কিন্তু প্রথম সাক্ষাতেই চিনে গিয়েছিল জারজিস নামক পাদ্রি; যিনি বুহায়রা নামে বিখ্যাত। মুহাম্মদের বয়স তখন বারো বছর দু’মাস দশ দিন। ব্যবসার উদ্দেশে আবু তালেব সিরিয়ায় রওনা হলেন। সফরসঙ্গী হিসেবে নিলেন মুহাম্মদকে। পথিমধ্যে বলরা নামক স্থানে যাত্রাবিরতি দেন। বসরা তখন শামের অন্তর্ভুক্ত ইরানদের উপশহর। আর শাম তখনকার রোম শাসিত আরব রাজ্যগুলোর একটি কসবা। কাফেলা তাঁবু স্থাপনের পর বুহায়রা পাদ্রি গির্জা থেকে বেরিয়ে কাফেলার লোকদের কাছে গিয়ে তাদের সম্ভাষণ জানালেন এবং মেহমানদারি করালেন। বুহায়রা কখনও গির্জা থেকে বেরুতেন না। আবু তালেবের বিশেষ সফরসঙ্গী মুহাম্মদকে প্রথম দর্শনেই চিনে ফেললেন। নবীজি (সা.)-এর হাত ধরে বললেন, ‘এ তো সাইয়্যিদুল আলামিন। আল্লাহতায়ালা একে জগতের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। এ কোনো সাধারণ বালক নয়।’

সতর্কতাবশত সফর থেকে ফেরত পাঠানো

আবু তালেব বুহায়রাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কীভাবে বুঝলেন?’ বুহায়রা প্রতিত্তোরে বললেন, ‘আপনারা এখানে আসামাত্রই এখানকার গাছপালা, লতাগুল্ম এবং পাথর তার সম্মানে সেজদায় নুয়ে পড়ল। নবী-রাসুল ছাড়া এরা কারও সম্মানে নত হয় না। পূর্ববর্তী কিতাবে বর্ণিত মোহরে নবুয়ত দেখে আমি তাকে চিনতে পেরেছি।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি আবু তালেবকে আরও একটি বিস্ময়কর নিদর্শন সম্পর্কে অবগত করলেন। তিনি বললেন, ‘এ বালকের কাঁধের নিচে নরম হাড়ের পাশে সেব ফলের মতো এটি বিদ্যমান রয়েছে। তার পূর্ণাঙ্গ সুরত ও নিদর্শনাবলি আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থে লেখা আছে; যা আমি স্পষ্টরূপে এর মাঝে দেখতে পাচ্ছি।’ তারপর বুহায়রা আবু তালেবকে অনুনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আপনি তাকে কোনোমতেই সিরিয়া নেবেন না। এ মুহূর্তে মক্কায় পাঠিয়ে দেওয়াই সমীচীন। আমার ভয় হয়, সিরিয়ার ইহুদিরা তাকে চিনতে পেরে হত্যা করে ফেলবে।’ আবু তালেব রাসুল (সা.)-এর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তৎক্ষণাৎ কয়েকজন লোকের সঙ্গে তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। (তিরমিজি : ৩৬৪০)।