মহানবীর লজ্জাশীলতা
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
লজ্জাশীলতা এক সমুন্নত ও মহিমান্বিত চারিত্রিক গুণ। যে ব্যক্তি এ চারিত্রিক গুণে গুণান্বিত হয়, সে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা ও অশালীনতা থেৃেক দূরে থাকতে পারে। লজ্জাহীন ব্যক্তি যা ইচ্ছে করতে পারে। শালীনতা বর্জিত অশিষ্ট আচরণ করতে সে কুণ্ঠাবোধ করে না। পক্ষান্তরে লজ্জাশীল ব্যক্তি অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনা থেকে দূরে থাকে। এ জন্যই মহানবী (সা.) লজ্জাশীলতাকে ঈমানের একটি শাখা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানের সত্তরের অধিক শাখা রয়েছে। এর সর্বোত্তমটি হলো, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা। আর সর্বনিম্নটি হলো, রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জা-শরমও ঈমানের একটি শাখা।’ (সুনানে নাসাঈ : ৫০০৫)। যেহেতু ইসলামে লজ্জাশীলতার অবস্থান এত সমুচ্চ, লজ্জা-শরমকে ঈমানের শাখা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, তাই মহানবী (সা.) যদি এ গুণে সবচেয়ে বেশি গুণান্বিত হন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর প্রকৃত অর্থেই মহানবী (সা.) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লজ্জাশীল ছিলেন। বিশ্বনবী (সা.) লজ্জাশীল হওয়ার সমর্থনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া না হলে তোমরা খাওয়ার জন্য আহার্য রান্নার অপেক্ষা না করে নবীর ঘরে প্রবেশ করো না। তবে তোমরা আহূত হলে প্রবেশ কর। এরপর খাওয়া শেষে আপনাআপনি চলে যেও, কথাবার্তায় মশগুল হয়ো না। নিশ্চয় এটা নবীর জন্য পীড়াদায়ক। তিনি তোমাদের কাছে লজ্জাবোধ করেন; কিন্তু আল্লাহ সত্য কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন না।’ (সুরা আহজাব : ৫৩)।
লজ্জায়-সংকোচে অতিথিদের বলতে না পারা
বিভিন্ন হাদিসেও মহানবী (সা.)-এর লাজুকতার বিবরণ উঠে এসেছে। একবার কয়েকজন সাহাবিকে মহানবী (সা.)-এর ঘরে খাবারের দাওয়াত দেওয়া হয়। দাওয়াত খাওয়া শেষ হলে তিনজন সাহাবি বিশ্বনবী (সা.)-এর ঘরে দীর্ঘ সময় ধরে কথাবার্তা বলতে থাকেন। মহানবী (সা.) মনে মনে চাচ্ছিলেন, তারা যেন চলে যান; কিন্তু লজ্জার খাতিরে তিনি তাদের বলতে পারছিলেন না, তোমরা এবার যেতে পার। আনাস (রা.) বলেন, জয়নাব বিনতে জাহশের সঙ্গে রাসুল (সা.)-এর বাসর যাপন উপলক্ষে কিছু গোশত ও রুটির ব্যবস্থা করা হয়। তারপর খাবার খাওয়ানোর জন্য আমাকে লোকদের ডেকে আনতে পাঠালেন। একদল লোক এসে খেয়ে চলে গেল। তারপর আরেক দল এসে খেয়ে চলে গেল। এরপর আবার আমি ডাকতে গেলাম; কিন্তু কাউকে আর ডেকে পেলাম না। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আর কাউকে ডেকে পাচ্ছি না।’ তিনি বললেন, ‘খাবার তুলে রাখ।’ তখন তিন ব্যক্তি ঘরে রয়ে গেল, তারা কথাবার্তা বলছিল। এ সময় নবীজি (সা.) বেরিয়ে আয়েশা (রা.)-এর ঘরের দিকে গেলেন এবং বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল বাইত ওয়ারহমাতুল্লাহ!’ আয়েশা (রা.) বললেন, ‘ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়ারহমাতুল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে বরকত দিন, আপনার স্ত্রীকে কেমন পেলেন?’ এভাবে তিনি পর্যায়ক্রমে সব স্ত্রীর ঘরে গেলেন। আয়েশা (রা.)-কে যেমন বলেছিলেন, তাদেরও তেমনি বললেন। আর তারা তাকে সে জবাবই দিয়েছিলেন, যেমন আয়েশা (রা.) দিয়েছিলেন। তারপর নবীজি (সা.) ফিরে এসে সে তিন ব্যক্তিকেই ঘরে কথাবার্তা বলতে দেখতে পেলেন। নবীজি (সা.) খুব লাজুক ছিলেন। (লজ্জা পেয়ে) আবার আয়েশা (রা.)-এর ঘরের দিকে গেলেন। আমি স্মরণ করতে পারছি না, তখন অন্য কেউ না আমি তাকে লোকদের বেরিয়ে যাওয়ার খবর দিলাম। তিনি ফিরে এসে দরজার চৌকাঠের ভেতরে এক পা ও বাইরে এক পা রেখে আমার ও তার মধ্যে পর্দা ঝুলিয়ে দিলেন এবং আল্লাহতায়ালা পর্দার আয়াত অবতীর্ণ করলেন।’ (বোখারি : ৪৭৯৩)।
মেরাজের রাতে বিশ্বনবী (সা.) যখন আল্লাহতায়ালার সাক্ষাৎ লাভ করে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ নিয়ে ফিরে আসছিলেন, তখন পথিমধ্যে মুসা (আ.)-এর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। মুসা (আ.) জিজ্ঞেস করেন, ‘আল্লাহতায়ালা আপনার উম্মতের ওপর কত ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন?’ মহানবী (সা.) বললেন, ‘পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ তিনি আমার উম্মতের ওপর ফরজ করেছেন।’ মুসা (আ.) বললেন, ‘আপনি আপনার পালনকর্তার কাছে ফিরে যান। কেননা, আপনার উম্মত এত পরিমাণ নামাজ আদায় করতে সক্ষম হবে না।’ মহানবী (সা.) বেশ কয়েকবার আল্লাহতায়ালার কাছে যাওয়ার পর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে এসে টেকে। আল্লাহতায়ালা বলে দেন, এ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের সমান বলে গণ্য হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হলে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার সওয়াব পাওয়া যাবে। এ সময় যখন মহানবী (সা.) আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে ফিরে আসেন, তখন মুসা (আ.) আবার আল্লাহতায়ালার দরবারে যাওয়ার জন্য নিবেদন করলে বিশ্বনবী (সা.) বলেন, ‘আমার পক্ষে আল্লাহতায়ালার কাছে আর যাওয়া সম্ভব নয়। আমি এখন লজ্জাবোধ করছি।’ আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, এরপর আল্লাহ আমার উম্মতের ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দেন। তারপর তা নিয়ে আমি ফিরে আসি। অবশেষে যখন মুসা (আ.)-এর পাশ কেটে অতিক্রম করি, তখন তিনি বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা আপনার উম্মতের ওপর কী ফরজ করেছেন?’ আমি বললাম, ‘পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন।’ তিনি বললেন, ‘আপনি আপনার পালনকর্তার কাছে ফিরে যান। কেননা, আপনার উম্মত তা পালন করতে পারবে না।’ আমি ফিরে গেলাম। আল্লাহতায়ালা কিছু অংশ কমিয়ে দিলেন। আমি মুসা (আ.)-এর কাছে আবার গেলাম আর বললাম, ‘কিছু অংশ কমিয়ে দিয়েছেন।’ তিনি বললেন, ‘আপনি আবার আপনার রবের কাছে ফিরে যান। কারণ, আপনার উম্মত এটিও আদায় করতে পারবে না।’ আমি ফিরে গেলাম। তখন আরও কিছু অংশ কমিয়ে দেওয়া হলো। আবারও মুসা (আ.)-এর কাছে গেলাম, এবারও তিনি বললেন, ‘আপনি আবার আপনার প্রতিপালকের কাছে যান। কারণ, আপনার উম্মত এটিও আদায় করতে সক্ষম হবে না।’ তখন আমি আবার গেলাম, তখন আল্লাহতায়ালা বললেন, ‘এই পাঁচই (নেকির দিক দিয়ে) পঞ্চাশ (বলে গণ্য হবে)। আমার কথার কোনো রদবদল হয় না।’ আমি মুসা (আ.)-এর কাছে এলে তিনি আমাকে আবারও বললেন, ‘আপনার প্রতিপালকের কাছে আবার যান।’ আমি বললাম, ‘আমার প্রতিপালকের কাছে আর যেতে লজ্জাবোধ করছি।’ (বোখারি : ৩৪৯)।
গোপনীয় জিজ্ঞাসায় লাজুকতা রক্ষা
প্রিয়নবী (সা.) ছিলেন বিশ্বনবী, পুরুষ ও নারীদের নবী, জিন ও মানুষের নবী। শরিয়তের বিধিবিধান বর্ণনা করা তাঁর দায়িত্ব ছিল। ফলে তার জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরাম (রা.) তাঁর কাছে গিয়েই দ্বীন ইসলামের বিধিবিধান জেনে নিতেন। এরই ধারাবাহিকতায় নারীরাও রাসুল (সা.)-এর কাছে তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন মাসআলা জেনে নিতেন। মহানবী (সা.) তাদের সঙ্গে লজ্জাজনক মাসআলা বলার ক্ষেত্রে লাজুকতার কারণে শালীনতার পরিচয় দিতেন। পারতপক্ষে খোলামেলাভাবে মাসআলা বর্ণনা করতেন না। অবশ্য দ্বীনের ক্ষতি হবে মনে করলে খোলামেলাভাবেই বলে দিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, এক নারী রাসুল (সা.)-কে হায়েজের গোসল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তিনি তাকে গোসলের নিয়ম বলে দিলেন যে, ‘এক টুকরো কস্তুরি লাগানো নেকড়া নিয়ে পবিত্রতা হাসিল কর।’ নারীটি বলল, ‘কীভাবে পবিত্রতা হাসিল করব?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তা দিয়ে পবিত্রতা হাসিল কর।’ নারীটি (তৃতীয়বার) বলল, ‘কীভাবে?’ রাসুল (সা.) লজ্জায় (মুখ ঢেকে) বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ! তা দিয়ে তুমি পবিত্রতা হাসিল কর।’ আয়েশা (রা.) বলেন, তখন আমি তাকে টেনে আমার কাছে নিয়ে এলাম। এরপর বললাম, ‘তা দিয়ে রক্তের চিহ্ন বিশেষভাবে মুছে ফেল।’ (বোখারি : ৩১৪)।
ব্যক্তি বিশেষের কথা না বলে সবার সতর্কতা
বহু সাহাবি রাসুল (সা.) লাজুক হওয়ার বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। মহানবী (সা.)-এর আচার-আচরণে অনেক সময় লজ্জাবতী কুমারীর লাজুকতা পরিলক্ষিত হতো। মহানবী (সা.) এত লাজুক ছিলেন, পর্দানশীন কিশোরীর চেয়েও তার মধ্যে অধিক লজ্জাশীলতা দৃষ্টিগোচর হতো। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, পর্দার অন্তরালের কুমারীদের চেয়েও নবীজি (সা.) অধিক লজ্জাশীল ছিলেন। যখন তিনি তার কাছে অপছন্দনীয় কিছু দেখতেন, তখন আমরা তার চেহারা দেখেই তা বুঝতে পারতাম। (বোখারি : ৬১০২)। যদি কখনও বিশ্বনবী (সা.)-এর কাছে কোনো সাহাবির ব্যাপারে কোনো ধরনের অভিযোগ আসত, তখন আভিজাত্য, ভদ্রতা, শালীনতা ও লজ্জাশীলতার কারণে মহানবী (সা.) সেই সাহাবির নাম উল্লেখ না করে ব্যাপকভাবে সব লোককে সে সম্পর্কে সতর্ক করে দিতেন। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে অন্য লোকেরাও সতর্ক হয়ে যেত। আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.)-কে কোনো ব্যক্তির কোনো বিষয়ে জানানো হলে তিনি এভাবে বলতেন না, তার কি হলো যে, সে এ কথা বলে? বরং বলতেন, লোকজনের কি হলো যে, তারা এই এই বলে? (সুনানে আবি দাউদ : ৪৭৮৮)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা