ঢাকা ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহানবীর বীরত্ব

আবদুল কাইয়ুম শেখ
মহানবীর বীরত্ব

মহানবী (সা.) অত্যন্ত শক্তিমান, বীরপুরুষ ও সমরনায়ক ছিলেন। মাদানি জীবনের ১০ বছরে সংঘটিত সব জিহাদ ও গাজওয়ার সর্বাধিনায়ক ছিলেন বিশ্বনবী (সা.)। হিজরতের পর জিহাদ ও গাজওয়ার ধারা শুরু হয়। এগুলোর কোনো কোনোটিতে মহানবী (সা.) নিজে অংশগ্রহণ করেন, আবার কোনো কোনোটিতে বিশিষ্ট কোনো সাহাবির নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন। ঐতিহাসিকদের পরিভাষায় প্রথম প্রকার জিহাদকে গাজওয়া এবং দ্বিতীয় প্রকার জিহাদকে সারিয়া বলা হয়।

সিরাতে মোগলতাঈয়ের ভাষ্যমতে মহানবী (সা.)-এর অধিনায়কত্বে তেইশটি গাজওয়া পরিচালিত হয়েছিল। এগুলোর নয়টিতে বিশ্বনবী (সা.) সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ও সশরীরে অংশগ্রহণ করেছিলেন। আর সাহাবায়ে কেরামের নেতৃত্বে ৪৩টি অভিযান প্রেরণ করেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব গাজওয়া ও সারিয়াতে মুসলমানদের সহায়-সম্বলহীন অবস্থা এবং সংখ্যায় স্বল্পতা সত্ত্বেও সব সময় বিজয় ও আল্লাহর সাহায্য মুসলমানদের ভাগ্যে জুটেছিল। অবশ্য ওহুদের যুদ্ধে প্রথম জয়লাভ করার পর আবার মুসলমানদের পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল।

সেটাও হয়েছিল সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাসুল (সা.)-এর নির্দেশের বিপরীত কাজ করার কারণে। এর দ্বারা বোঝা যায়, মহানবী (সা.) কত বড় বীর বাহাদুর, সমরনায়ক ও যুদ্ধবিশারদ ছিলেন! বিশ্বনবী (সা.)-কে বীরপুরুষ আখ্যা দিয়ে বারা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! যুদ্ধের উত্তেজনা যখন ঘোরতর হয়ে উঠত, তখন আমরা তার মাধ্যমে আত্মরক্ষা করতাম। নিশ্চয় আমাদের মাঝে বীরপুরুষ তিনিই, যাকে যুদ্ধে তার সামনে রাখা হয়; অর্থাৎ মহানবী (সা.)।’ (মুসলিম : ৪৫০৮)।

অন্য একটি হাদিসেও মহানবী (সা.)-কে নির্ভীক বীরপুরুষ বলে আখ্যায়িত করে আনাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে দানশীল ও সবচেয়ে শৌর্যবীর্যের অধিকারী বীরপুরুষ ছিলেন।’ বর্ণনাকারী বলেন, একবার এমন হয়েছিল, মদিনাবাসী রাতের বেলায় একটি আওয়াজ শুনে ভীতশঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল। তখন নবীজি (সা.) আবু তালহা (রা.)-এর গদিবিহীন ঘোড়ায় আরোহণ করে তলোয়ার ঝুলিয়ে তাদের সামনে এলেন। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমরা ভয় করো না, তোমরা ভয় করো না।’ এর পর বললেন, ‘আমি এ ঘোড়াটিকে সমুদ্রের মতো দ্রুতগামী পেয়েছি।’ (বোখারি : ৩০৪০)।

মিথ্যা নবী নই, আবদুল মুত্তালিবের বংশধর

মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানদের সঙ্গে কাফেরদের যুদ্ধ করার আগ্রহ কমে যায়; কিন্তু হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্র অতি আত্মমর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য মক্কা অভিমুখে এগিয়ে আসে। বিষয়টি জানতে পেরে মহানবী (সা.) ১০ হাজার মুহাজির ও আনসার এবং ২ হাজার নওমুসলিমকে সঙ্গে নিয়ে হুনাইন প্রান্তরে উপস্থিত হন। হুনাইনে উপস্থিত হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামের মনে কাজ করছিল, আজ আমরা সংখ্যায় অনেক। তাই কোনোক্রমেই পরাজয় বরণ করতে পারি না। এ সময় হাওয়াজিন ও সাকিফ গোত্রের লোকেরা পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। হুনাইন প্রান্তরে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সাহাবায়ে কেরামের ওপর অতর্কিতে হামলা করে। ফলে বহু সাহাবি ছোটাছুটি করে এদিক-সেদিক চলে যেতে থাকেন। কিন্তু মহানবী (সা.) অটল ধৈর্য ও অসীম সৌর্য নিয়ে আপন স্থানে অবিচল থেকে অসম বীরত্বের পরিচয় দেন। তিনি দীপ্ত কণ্ঠে বলবীর্যের সঙ্গে ঘোষণা করেন, ‘আমি সত্য নবী। আমি আবদুল মুত্তালিবের বংশধর। আমি পালিয়ে যেতে পারি না।’ বারা ইবনে আজেব (রা.)-কে কোনো এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আবু উমারা! আপনারা হুনাইনের দিন পলায়ন করেছিলেন?’ তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! না। নবীজি (সা.) কখনও পলায়ন করেননি; বরং অতি উৎসাহী অগ্রবর্তী ক’জন ব্যক্তি হাওয়াজিনদের তীর নিক্ষেপের ফলে পালিয়েছিলেন। আর নবীজি (সা.) তার সাদা খচ্চরটির ওপর উপবিষ্ট ছিলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস (রা.)-এর লাগাম ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। তখন নবীজি (সা.) বলেছিলেন, ‘আমি মিথ্যা নবী নই, আমি আবদুল মুত্তালিবের বংশধর।’ (বোখারি : ২৮৭৪)।

মাতাপিতা কোরবান হোক, তুমি তির চালাতে থাক

ওহুদের ময়দানে মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হলে মুসলমান সাহাবিদের বীরদর্পী আক্রমণে কাফেররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সময় মুসলমানরা ময়দানের গনিমত সংগ্রহ করতে শুরু করেন। গনিমত সংগ্রহ করতে দেখে ময়দানের পেছন দিকে যেসব সাহাবিকে পাহারা দেওয়ার জন্য দাঁড় করানো হয়েছিল, তারা নিজ স্থান ত্যাগ করে চলে আসেন। একে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে খালিদ বিন ওয়ালিদ তার বাহিনী নিয়ে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করেন। ফলে যুদ্ধের মোড় পাল্টে যায়। মুসলমানদের জয় পরাজয়ে রূপ নেয়। তখন সাহাবায়ে কেরাম এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। কিন্তু মহানবী (সা.) আপন স্থানে অটল পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। এ ব্যাপারে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) বলেন, ওহুদের দিন নবীজি (সা.) আমার জন্য তার তিরাধার খুলে দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য আমার মাতাপিতা কোরবান হোক, তুমি তির চালাতে থাক।’ (বোখারি : ৪০৫৫)।

বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন

মহানবী (সা.) নির্ভয়, নিঃশঙ্ক, নির্ভীক, চৌকস ও সাহসী পুরুষ ছিলেন। হিজরত করার সময় বিশ্বনবী (সা.) যখন আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে একটি গুহায় অবস্থান করছিলেন, তখন কাফেররা খুঁজতে খুঁজতে একদম তাদের কাছে চলে যায়। এ সময় আবু বকর (রা.) উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। কিন্তু মহানবী (সা.) ছিলেন একদম নির্বিকার। তার মধ্যে শঙ্কার লেশমাত্র ছিল না। তিনি আবু বকর (রা.)-কে আশ্বস্ত করছিলেন, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিশ্চয় মহান আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। তিনি আমাদের হেফাজত করবেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘যদি তোমরা তাকে (রাসুলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখ, আল্লাহ তার সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল, তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহায় ছিলেন। তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা তওবা : ৪০)।

আল্লাহতায়ালা আমাকে বাঁচাবেন

তৃতীয় হিজরিতে সাড়ে ৪০০ লোক নিয়ে দাসুর ইবনুল হারেস মুহারেবি মদিনা মুনাওয়ারায় আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো। রাসুল (সা.) শত্রুর মোকাবিলা করতে মদিনার বাইরে এলে শত্রুসৈন্য সবাই দৌড়ে পালিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় গ্রহণ করল। নবীজি (সা.) নিশ্চিন্ত হয়ে ময়দান থেকে ফিরে এলেন। সে সময় ঘটনাক্রমে বিশ্বনবী (সা.)-এর জামা বৃষ্টিতে ভিজে যায়। নবীজি (সা.) জামাটি শুকানোর জন্য একটি গাছের ওপর ছড়িয়ে দেন। নিজে সেই গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়েন। এদিকে দাসুর পাহাড়ের ওপর থেকে সবকিছুই দেখছিল। যখন সে দেখল, রাসুল (সা.) নিশ্চিন্ত হয়ে শুয়ে পড়েছেন, তখন সে তার কাছে এসে তরবারি মাথা বরাবর উঁচু করে ধরে বলল, ‘বল দেখি! এখন তোমাকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে?’ রাসুল (সা.) এ অবস্থা দেখেও কোনো প্রকার ভীতবিহ্বল না হয়ে নির্ভীক মনে উত্তর দেন, ‘আল্লাহতায়ালা আমাকে বাঁচাবেন।’ এ কথা শুনে দাসুরের শরীরে কম্পন সৃষ্টি হলো। তার হাত থেকে তলোয়ার পড়ে গেল। তখন নবীজি (সা.) তরবারি হাতে নিয়ে বললেন, ‘তুমি বল! এখন তোমাকে কে বাঁচাবে?’ তার কাছে ‘কেউ নয়’ বলা ছাড়া আর কোনো জবাব ছিল না। রাসুল (সা.) তার অসহায় অবস্থা দেখে ক্ষমা করে দিলেন। (সিরাতে মোগলতাই : ৪৯)।

পবিত্র হাতের আঘাতে পাথর খণ্ড-বিখণ্ড

পঞ্চম হিজরির জিলকদ মাসে কাফেরদের সবাই নিজ নিজ পূর্ণ ক্ষমতা সঞ্চয় করে একযোগে মদিনা মুনাওয়ারায় আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১০ হাজার সজ্জিত বাহিনী মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার উদ্দেশে মদিনার দিকে অগ্রসর হলো। নবীজি (সা.)-এর কাছে এ সংবাদ পৌঁছাল। তিনি সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। সালমান ফারসি (রা.) ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করা সংগত নয় বলে মত দেন। তিনি বললেন, কাফেরদের যেদিক দিয়ে মদিনায় প্রবেশ করার আশঙ্কা রয়েছে, সেদিকে পরিখা খনন করা হোক। সে মতে রাসুল (সা.) তিন হাজার সাহাবিকে নিয়ে পরিখা খনন করতে লেগে যান। মাত্র ছয় দিনের মধ্যে পরিখা তৈরি হয়ে যায়। পরিখা খনন করার সময় একবার এক প্রকাণ্ড পাথর খণ্ড বেরুলে তা সরাতে সবাই ব্যর্থ হন। তখন নবীজি (সা.) তার পবিত্র হাতে এত জোরে আঘাত করেন যে, তা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যায়।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ

চকবাজার, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত