ঊর্ধ্বলোকের বাতায়ন খুলে চাঁদমামা মিটিমিটি হাসছে। দুধে ধোয়া জোছনার আলোয় মরুভূমিতে সোনালি আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মরীচিকার মতো ঝকমক করছে বালু। খেলা করছে নক্ষত্ররাজি। সহস্র-কোটি নক্ষত্র অবিরাম ছুটে চলছে। যেন একে অপরকে ডিঙিয়ে আগে ভাসার উদগ্র বাসনা কাজ করছে তাদের মাঝে। আলোর ফুল জোনাকি কাফেলা ওড়াউড়ি করছে। ব্যাকুল হয়ে ছুটছে এদিক-সেদিক। খেজুর গাছের লম্বা পাতার ফাঁক গলে বেরিয়ে এসেছে আলোর বিচ্ছুরণ। পথের দু-ধারে গাছপালা দাঁড়িয়ে আছে সতেজ অঙ্গে। পাখির দল নীড় ছেড়ে গাছের শাখা-প্রশাখায় বসেছে। থেকে থেকে গান গেয়ে উঠছে বিহঙ্গের ঝাঁক। প্রিয়জন আগমনের ব্যাকুল প্রতীক্ষার তর সইছে না তাদের মন-মাজারে। প্রিয়জনের অপেক্ষা, প্রিয়তমের প্রতীক্ষা, এক মহান অতিথির আগমন ঘটবে স্বল্পক্ষণের মধ্যেই। প্রকৃতির সাজসজ্জার উতরোল এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি!
সত্যিই এলেন! সুবহে সাদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে আগমন হলো এক মহান শিশুর। আজকের এ পৃথিবীজুড়ে সব আয়োজন যাকে নিয়ে, তিনি এলেন। ধন্য হলো মরুভূমির আরব। ধন্য হলো বিশ্বজাহান। পৃথিবীর সব পুষ্পকলিরা যেন হাসির মুক্তা ঝরিয়ে সমস্বরে গাইল- তলাআল বাদরু আলাইনা। নবীজি (সা.) যখন ভূমিষ্ঠ হন, তখন তিনি নিজের হাতের ওপর ভর দেওয়া অবস্থায় ছিলেন। এরপর একমুষ্ঠি মাটি তুলে আকাশের দিকে তাকান। (মাওয়াহিবে লাদুন্নিয়্যাহ)। দাদা বৃদ্ধ আবদুল মুত্তালিবের কাছে পৌত্রের জন্মের সুসংবাদ পৌঁছাল। নবজীবন ফিরে পেলেন আবদুল মুত্তালিব। নবীজি (সা.)-এর পরশে স্নিগ্ধতার নতুন ছোঁয়া পেলেন তিনি। তার বৃদ্ধ শতবর্ষ নিষ্প্রভ চোখে আলো নেমে এলো। তিনি মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলেন। আহা, কেমন দৃষ্টিকাড়া চাহনি! সারা মুখে ছেয়ে আছে নুরের অপূর্ব দীপ্তি। ঠোঁটে সেটে আছে আদর তোলা হাসির ঝিলিক। আবদুল মুত্তালিব অপলক চেয়ে আছেন। শতায়ু বৃদ্ধের জরাজীর্ণ মুখাবয়বে যেন বিগত তারুণ্যের সজীব উদ্ভাস খেলে গেল।
হালিমা সাদিয়ার ঘরে কদম
জন্মের আগেই মহানবী (সা.)-এর মাথার ওপর থেকে পিতৃস্নেহছায়া মিলিয়ে গেল ভূপৃষ্ঠে। আদরের দুলালকে পেয়ে বিবি আমিনার হৃদয় থেকে স্বামীর মৃত্যুর শোকসন্তাপ দূর হলো। শিশু মুহাম্মদ কয়েকদিন মাত্র মা আমিনার দুধ পান করলেন। তারপর আবু লাহাবের দাসী সুহাইবার দুধ পান করেন। এরপর এ সৌভাগ্যলিপি দুধমা হালিমার ললাটে জ্বলজ্বল করে উঠল। আরবের সম্ভ্রান্ত পরিবারের প্রথা অনুযায়ী তাকে সোপর্দ করা হলো তায়েফবাসিনী দুধমা হালিমা সাদিয়ার হাতে। তার ঘর আলোকিত হলো। যখন তিনি শিশু মুহাম্মদকে দুধ পান করাতে বসলেন, তখন একের পর এক বরকত প্রকাশিত হতে লাগল। ছোট্টকাল থেকেই তার প্রীতিসুলভ আচরণ ভেসে উঠল। শিশু মুহাম্মদ হালিমার ডান স্তনের দুধ পান করেন, আর অপরটি দুধ ভাই আবদুল্লাহর জন্য রেখে দেন।
শৈশবের মুগ্ধকর সাম্য-চেতনা
দু’বছর কেটে গেল হালিমার ঘরে। তখনকার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। ঘটনাক্রমে সে বছর মক্কায় মহামারির আবহাওয়া চলছিল। বিবি হালিমা এ অজুহাত দেখিয়ে ফের সঙ্গে নিয়ে এলেন তাঁকে। এবার তিনি ঘর থেকে বের হওয়া শুরু করলেন। পাড়ার ছেলেদের খেলাধুলা দেখেন। কিন্তু নিজে কখনও খেলেন না। সব সময় চুপচাপ থাকা পছন্দ করতেন তিনি। একদিন হালিমাকে বললেন, ‘আমার ভাই আবদুল্লাহ সারাদিন কোথায় থাকে? ওকে তো দিনে তেমন একটা দেখা যায় না?’ হালিমা প্রতি উত্তরে বললেন, ‘ও মাঠে ছাগল চরাতে যায়।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘আমাকেও আগামীকাল থেকে ওর সঙ্গে পাঠাবেন।’ নবীজি (সা.)-এর শৈশবের সাম্য-চেতনা ছিল মুগ্ধকর। এরপর থেকে রোজ বকরি চরাতে মাঠে আসা-যাওয়া করেন। একদিনের ঘটনা। আবদুল্লাহ হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি এসে পিতাকে বললেন, ‘আমার কোরাইশি ভাইকে সাদা পোশাক পরিহিত দু’জন লোক মাটিতে শুইয়ে তার পেট চিরে ফেলেছে।’ এ কথা শুনে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখলেন, মুহাম্মদ শান্তশিষ্ট বসে আছে। তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ ছড়িয়ে আছে। হালিমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’ জবাবে ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বললেন। নবীজি (সা.)-এর জীবদ্দশায় বক্ষ বিদারণ চারবার হয়েছে। এটাই সর্বপ্রথম। এ ঘটনার পর হালিমা তাঁর মায়ের কাছে আবার তাঁকে পাঠিয়ে দেন।
নিষ্পাপ চেহারায় বিষাদের ছায়া
মা-ছেলের পুনর্মিলন দু’বছরের বেশি স্থায়ী হলো না। ফুলের পাপড়ির মতো কোমল নিষ্পাপ চেহারায় বিষাদের ছায়া নেমে এলো। এ কেমন লীলাখেলা! আজন্ম পিতৃহীন শিশু এবার মাতৃমমতার সুশীতল পরশ থেকেও হলো বঞ্চিত। নবীজি (সা.)-এর বয়স যখন চার কিংবা ছয় বছর, তখন মা আমিনা মদিনার সফরে গেলেন। ফেরার পথে ‘আবওয়া’ নামক স্থানে এসে পরপারের ঠিকানায় পাড়ি জমান। পিতামাতার অন্তর্ধানের পর এবার তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিবের কাছে থাকতে লাগলেন। কিন্তু এ আদরের দুলালকে পিতৃমাতৃহীন এতিম, নিঃসঙ্গ করার পেছনে মহামহিমের নিগূঢ় কোনো হেকমত ও রহস্য রয়েছে। তাই আট বছর দু’মাস দশ দিন হতেই দাদার স্নেহছায়াঘেরা আশ্রয়ও হারাতে হলো তাকে। জগতসংসারে এখন তার আপন একমাত্র দয়াময় মাবুদ ছাড়া আর কেউ নেই। তার ভাগ্য-পেয়ালায় যেন বিষাদ পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ল।
শৈশব থেকেই যিনি গুণবান
জাগতিক সর্বহারা এ এতিম শিশুকে পরম সমাদরে গ্রহণ করে নিলেন চাচা আবু তালেব। চাচার কাছেই নবীজি (সা.) বড় হতে লাগলেন। আবু তালেবের তত্ত্বাবধানে ব্যবসা-বাণিজ্যে তাঁর হাতেখড়ি হলো। নবীজি (সা.)-কে নিয়ে আবু তালেব সিরিয়ার উদ্দেশে রওনা হন। পথে ‘তায়মা’ নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। ঘটনাক্রমে এক ইহুদি পণ্ডিত বুহায়রা রাহেব নবীজি (সা.)-কে দেখামাত্রই থমকে দাঁড়ালেন। কাছে গিয়ে আবু তালেবকে জিজ্ঞেস করেন, ‘বালকটি কে? আপনি যদি তার পূর্ণরূপে হেফাজত করতে চান, তাহলে আল্লাহর শপথ! একে সিরিয়ায় নেবেন না। এ-ই আগামীর ধ্রুবতারা। আখেরি জমানার নবী হবেন। যিনি তাওরাতকে রহিত করে দেবেন। ইহুদি ধর্মজাযকদের রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটাবেন। আমার আশঙ্কা হয়, সেখানকার ইহুদিরা তাঁকে চিনতে পেরে হত্যা করে ফেলবে।’ আবু তালেব বুহায়রার কথা শুনে তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। ব্যবসার কারণে তার সততা, বিশ্বস্ততা, সত্যবাদিতা ও উন্নত চরিত্রের মাধুর্যতা ‘আল আমিন’ হয়ে আকাশে-বাতাসে, মক্কার গলিঘিঞ্জিরে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি প্রত্যেকেরই আস্থাভাজন হয়ে গেলেন। সবখানেই গুঞ্জরিত হতে লাগল, ‘আল আমিন’। (সিরাতে মোগলতাঈ : ১০)।