জড়জীবের ভালোবাসায় সিক্ত নবী
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সৃষ্টির ভালোবাসা পাওয়ার শর্ত হলো- সচ্চরিত্র, পরোপকার, দয়া, অনুকম্পা, নীতি-নৈতিকতা, মহানুভবতা, আদর্শ ও কল্যাণ কামনা বিদ্যমান থাকা। মানুষ তাকেই ভালোবাসে, যার মধ্যে এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে। যার মধ্যে ভালোবাসার মতো কোনো গুণ ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকে না, সে কারও ভালোবাসা পায় না। সৃষ্টির ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তির মধ্যে যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকা জরুরি, সেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য মহানবী (সা.)-এর মধ্যে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এজন্য বিশ্বনবী (সা.) মানব-দানব ও জন্তু-জানোয়ারসহ জড়জীবের অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
সাহাবিদের ভালোবাসা
রাসুল (সা.)-কে তার সাহাবায়ে কেরাম হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। মহানবী (সা.)-কে তারা নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয় মনে করতেন। যুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে সাহাবায়ে কেরাম প্রাণ দিয়ে মহানবী (সা.)-কে রক্ষা করে তাঁকে ভালোবাসার অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। ওহুদের যুদ্ধে বিশ্বনবী (সা.)-কে বাঁচাতে গিয়ে বেশ কয়েকজন সাহাবি নিজের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.)-কে তার সাহাবায়ে কেরাম যে পরিমাণ ভালোবাসতেন, বিশ্বের অন্য কোনো নেতাকে তার সঙ্গীরা তত পরিমাণ ভালো না বাসার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! কেয়ামত কবে হবে?’ তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এর জন্য কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছ?’ সে বলল, ‘আমি এর জন্য অধিক নামাজ, রোজা ও সদকা আদায় করতে পারিনি। কিন্তু আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভালোবাসি।’ তিনি বললেন, ‘তুমি যাকে ভালোবাস, তার সঙ্গেই থাকবে।’ (বোখারি : ৬১৭১)।
উটের ভালোবাসা
যদি কেউ বেদনাহত হয়, তাহলে সে তার ভালোবাসা ও আস্থার জায়গায় গিয়ে নিজের দুঃখ শেয়ার করে সান্ত¡না ও প্রতিকার লাভ করতে চায়। এ সান্ত¡না ও প্রতিকার লাভ করতে চাওয়া প্রকারান্তরে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। মহানবী (সা.)-এর যুগে একটি উটের মালিক তাকে কষ্ট দিল। সে রাসুল (সা.)-কে ভালোবেসে তাঁর কাছে অভিযোগ দায়ের করে প্রতিকার কামনা করল। মহানবী (সা.) উটের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন। মালিককে কষ্ট না দেওয়ার নির্দেশ দেন। আবদুল্লাহ ইবনে জাফর (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.) আমাকে তার খচ্চরের পিঠে তার পেছনে বসালেন। তিনি আমাকে গোপনে কিছু কথা বলে এ মর্মে সতর্ক করে দিলেন, আমি যেন কাউকে না বলি। রাসুল (সা.) তার প্রাকৃতিক প্রয়োজনের সময় গোপনীয়তা রক্ষার্থে উঁচু জায়গা অথবা ঘন খেজুরকুঞ্জ পছন্দ করতেন। তিনি এক আনসারির খেজুর বাগানে প্রবেশ করলে হঠাৎ একটি উট তার দৃষ্টিগোচর হয়। উটটি মহানবী (সা.)-কে দেখে কাঁদতে লাগল। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। নবীজি (সা.) উটটির কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। এতে উটটি কান্না থামাল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ উটের মালিক কে?’ তিনি আবারও ডাকলেন, ‘উটটি কার?’ এক আনসারি যুবক এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার।’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ যে তোমাকে এ নিরীহ প্রাণীর মালিক বানালেন, এর অধিকারের ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? উটটি আমার কাছে অভিযোগ করেছে, তুমি তাকে ক্ষুধার্ত রাখ ও কষ্ট দাও।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৫৪৯)।
খেজুরকাণ্ডের ভালোবাসা
একটা সময় এমন ছিল, যখন মহানবী (সা.)-এর জন্য মিম্বর তৈরি করা হয়নি। মিম্বর তৈরির আগ পর্যন্ত বিশ্বনবী (সা.) খেজুরকাণ্ডের ওপর ভর করে খুতবা দিতেন। খেজুরকাণ্ডটি রাসুল (সা.)-কে অত্যন্ত ভালোবাসত। বিশ্বনবী (সা.) তার ওপর দাঁড়িয়ে খুতবা দেওয়ার কারণে সে অত্যন্ত আনন্দিত ছিল। এরপর যখন খুতবা দেওয়ার প্রয়োজনে মহানবী (সা.)-এর জন্য মিম্বর তৈরি করা হয়, তখন রাসুল (সা.) মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে খুতবা দিতে শুরু করেন। বিষয়টি দেখে মহানবী (সা.)-এর বিরহে খেজুরকাণ্ডটি কাঁদতে শুরু করল। বিশ্বনবী (সা.) কাণ্ডটির গায়ে হাত বুলিয়ে আদর প্রকাশ করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) খেজুরের একটি কাণ্ডের ওপর ভর করে খুতবা প্রদান করতেন। যখন মিম্বর তৈরি করে দেওয়া হলো, তখন তিনি মিম্বরে চড়ে খুতবা দিতে লাগলেন। কাণ্ডটি তখন কাঁদতে শুরু করল। নবীজি (সা.) কাণ্ডটির কাছে গিয়ে হাত বুলাতে লাগলেন। (বোখারি : ৩৫৮৩)।
পাথরের ভালোবাসা
নবী হিসেবে প্রেরিত হওয়ার পর বিশ্বনবী (সা.) মহোত্তম সব গুণে গুণান্বিত থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু নবী হিসেবে প্রেরিত হওয়ার আগেও এমন সব গুণে গুণান্বিত ছিলেন তিনি, যার ফলে সপ্রাণ মানুষ তো বটেই, নিষ্প্রাণ পাথররা পর্যন্ত তাকে শ্রদ্ধা করত ও ভালোবাসত। নবী হওয়ার আগেও প্রিয়নবী (সা.) জড়জীবের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। নবী হিসেবে প্রেরিত হওয়ার আগে নিষ্প্রাণ পাথর তাকে সালাম দেওয়ার কথা হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি মক্কায় একটি পাথরকে জানি, যা নবীরূপে প্রেরিত হওয়ার আগেও আমাকে সালাম করত; আমি এখনও তাকে সন্দেহাতীতভাবে চিনতে পারি।’ (মুসলিম : ৫৮৩৩)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা