ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহানবীর রমজান

রমজানকে বলা হয় ইবাদতের বসন্ত। পবিত্র এ মাসে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মোমিনের জন্য প্রবাহিত হয় রহমতের বারিধারা। রোজার নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী মিলন থেকে বিরত থেকে ঐশী বিধান পালনের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয় এ মাসের প্রতিটি দিন। প্রত্যেক ব্যবসায়ীর যেমন একটি ব্যবসার মৌসুম থাকে, আর সে মৌসুমে তারা দিনরাত একাকার করে টাকা উপার্জনে লিপ্ত হয়, তদ্রূপ মোমিনের আল্লাহতায়ালার সঙ্গে ব্যবসার একটি মৌসুম রয়েছে; তা হলো মাহে রমজান। এ রমজানে মোমিন তার মর্যাদা বৃদ্ধি করতে দিনরাত একাকার করে ইবাদত-বন্দেগি করতে থাকে। তবে এ ইবাদত-বন্দেগি করতে হবে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ মোতাবেক। তাই জানা দরকার, নবীজি (সা.) রমজানে কী কী আমল করতেন। সেসব নিয়ে লিখেছেন- মুফতি মাহবুবুর রহমান
মহানবীর রমজান

সাহরি

সাহরি গ্রহণ করা প্রিয়নবী (সা.)-এর বরকতময় সুন্নাহর একটি। রাসুল (সা.) রাতের শেষ প্রহরে সাহরি গ্রহণ করতেন। উম্মতকেও সাহরি গ্রহণের প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা সাহরি গ্রহণ কর। কেননা, সাহরিতে বরকত রয়েছে।’ (বোখারি : ১৯২৩, মুসলিম : ১০৯৫)। কাতাদা (রহ.) আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণনা করেন, (একদিন) রাসুল (সা.) ও জায়েদ বিন সাবেত (রা.) একসঙ্গে সাহরি খেলেন। সাহরি শেষে নবীজি (সা.) নামাজ পড়তে গেলেন। আমরা আনাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাদের সাহরি শেষ করা ও ফজরের নামাজ শুরু করার মধ্যে সময়ের ব্যবধান কতটুকু ছিল?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘পঞ্চাশ অথবা ষাট আয়াত পড়তে যতক্ষণ সময় লাগে।’ (বোখারি : ৫৭৬)। পঞ্চাশ-ষাট আয়াত বলতে মধ্যম ধরনের আয়াত; যা তেলাওয়াতে পনেরো-বিশ মিনিট সময় লাগবে। সে আলোকে রাতের একেবারে শেষ প্রহরে সাহরি খাওয়া ছিল রাসুল (সা.)-এর অভ্যাস। তাই রাতের শেষ প্রহরে সাহরি খাওয়া সুন্নত।

রমজানের দিন

সাহরির পর যখন ফজরের আজান হতো, নবীজি (সা.) ফজরের সুন্নত সংক্ষিপ্তভাবে আদায় করতেন। দিনের আলো ভালোভাবে ফুটলে রাসুল (সা.) রমজান ও রোজা সংক্রান্ত নানা সমস্যার সমাধান দিতেন।

বিভিন্ন কাজে উৎসাহ প্রদান ও নানা কাজ হতে নিষেধ করতেন। রোজা অবস্থায় তিনি সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে থাকার উপদেশ দিতেন। নবীজি (সা.) লাকিত বিন সাবিরা (রা.)-কে বলেছেন, ‘তোমরা ভালোভাবে নাকে পানি পৌঁছাও, তবে রোজা অবস্থায় নয়। (অর্থাৎ রোজা অবস্থায় হালকাভাবে পানি পৌঁছাও, অতিরঞ্জন কোরো না)।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৩৬৩)। রাসুল (সা.) রোজা অবস্থায় মেসওয়াকের খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন; অন্যদেরও উৎসাহ দিতেন। যেন নিজের মুখে দুর্গন্ধ তৈরি না হয় ও অন্যের কষ্ট না হয়। আমের বিন রাবিয়া (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে রোজা অবস্থায় এত বেশি মেসওয়াক করতে দেখেছি, যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। (আত তালখিসুল হাবির : ১/৯)।

দান-সদকা

প্রিয় নবীজি (সা.) স্বভাবগতভাবেই মানবকুলের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল ছিলেন। রমজান মাস এলে তার দানের পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যেত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) মানুষের মধ্যে সর্বাধিক দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। রমজান মাসে জিবরাইল (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে কল্যাণবহ মুক্ত বায়ুর চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন।’ (বোখারি : ৩২২০)।

কোরআন তেলাওয়াত

নবীজি (সা.) সব সময়ই কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কয়েকটি প্রিয় জিনিসের মধ্যে কোরআন তেলাওয়াত ছিল অন্যতম। আর তা রমজান মাসে অনেক বাড়িয়ে দিতেন। কারণ, রমজান মাসেই আল্লাহতায়ালা কোরআন নাজিল করেছেন। কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে কোরআন নাজিল করা হয়েছে।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, প্রতি বছর রাসুল (সা.)-এর ওপর একবার পুরো কোরআন নাজিল করা হতো। তবে যে বছর আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেলেন, সে বছর বাদে। কারণ কোরআন দু’বার নাজিল করা হয়।’ (বোখারি : ৪৯৯৮)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘রমজান এলে প্রতি রাতে নবীজি (সা.)-এর কাছে জিবরাইল (আ.) আগমন করতেন। একে অপরকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন।’ (বোখারি : ৩৫৫৪)।

নফল নামাজ

নবীজি (সা.) রমজানে এবং রমজানের বাইরে মহান রবের প্রেমে সিক্ত হয়ে দীর্ঘ সময় নামাজে কাটিয়ে দিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রমজান কিংবা অন্য সময়ে তিনি এগারো বা তেরো রাকাতের অধিক নফল সালাত আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে চার রাকাত আদায় করতেন। তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য হতো অতুলনীয়। এরপর চার রাকাত আদায় করতেন। তার সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য হতো অতুলনীয়। এরপর তিন রাকাত আদায় করতেন। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি বিতর আদায়ের আগেই ঘুমাবেন?’ তিনি বললেন, ‘আয়েশা! আমার দু-চোখ ঘুমায়; কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।’ (বোখারি : ২০১৩)।

তারাবির নামাজ

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; নবীজি (সা.) রমজানে বিশ রাকাত (তারাবি) ও বিতর আদায় করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ৭৭৭৪)। ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেন, ‘ওলামায়ে কেরাম রমজানে রাতের নামাজের ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন। এ ক্ষেত্রে অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম ওমর (রা.), আলী (রা.) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের যে বিশ রাকাতের মত, তা গ্রহণ করেছেন। এটাই ইমাম ইবনুল মোবারক, সাওরি ও শাফেয়ি (রহ.)-এর অভিমত।’ (তিরমিজি : ১৬২/২)।

ইতেকাফ

রমজানে রাসুল (সা.)-এর অন্যতম ধারাবাহিক ও গুরুত্বপূর্ণ আমল ছিল ইতেকাফ করা। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশকে নবীজি (সা.) ইতেকাফ করতেন।’ (বোখারি : ২০৩৩)। এমনকি জিহাদের সফরের কারণে এক রমজানে তিনি ইতেকাফ করতে পারেননি, তাই পরবর্তী বছর ২০ দিন ইতেকাফ করে তা পূর্ণ করে নিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) প্রতি রমজানে দশ দিনের ইতেকাফ করতেন।’

ইফতার

ইফতার গ্রহণ করা সুন্নত এবং স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। রাসুল (সা.) সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কালবিলম্ব না করে ইফতার করতেন। উম্মতকে দ্রুত ইফতার গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মানুষ যতদিন পর্যন্ত (আজানের পর) দ্রুত ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অতএব, তোমরা দ্রুত ইফতার কর। কেননা, ইহুদিরা ইফতার করতে দেরি করে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৯৮)। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দাদের মধ্যে সে-ই বেশি প্রিয়, যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে।’ (তিরমিজি : ৭০০)।

ইফতারে খেজুর

খেজুর বা খোরমা দিয়ে ইফতার করা উত্তম। রাসুল (সা.) সাধারণত খেজুর বা খোরমা দিয়ে ইফতার করতেন। আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) (মাগরিবের) নামাজের আগে খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তা না থাকলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন। (সুনানে আবি দাউদ : ২৩৫৬, তিরমিজি : ৬৯৬)।

ইফতারের দোয়া

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) ইফতারকালে বলতেন, ‘জাহাবাজ জামাউ, ওয়াবতাল্লাতিল উরুকু, ওয়া সাবাতিল আজরু ইনশাআল্লাহ।’ (অর্থ : পিপাসা দূর হলো, শিরা-উপশিরা সিক্ত হলো এবং যদি আল্লাহ চান, সওয়াবও সুনিশ্চিত হলো)।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৩৫৭)। মুয়াজ ইবনে জুহরা বলেন, রাসুল (সা.) ইফতারকালে এ দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু, ওয়া আলা রিজকিকা আফতারতু।’ (অর্থ : হে আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য রোজা রেখেছি এবং তোমারই দেওয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করছি।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৩৫৮)।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম (গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা), টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত