ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

২০ রাকাত তারাবি পড়ুন

মুহাম্মদ শেখ মুসা
২০ রাকাত তারাবি পড়ুন

পবিত্র মাহে রমজান আনন্দময় ইবাদতের সময়। রমজানে মোমিনের জন্য একটি বিশেষ নামাজের বিধান দেওয়া হয়েছে। বছরের আর কোনো মাসে এ নামাজ পড়ার বিধান নেই। বিশেষ এ নামাজের নাম ‘তারাবি’। তারাবি আরবি শব্দ। ‘তারবিহাতুন’-এর বহুবচন। এর অর্থ হলো, আরাম করা ও বিশ্রাম করা। ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী তারাবির নামাজে প্রতি চার রাকাত পরপর কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেওয়ার বিধান রয়েছে। তাই এ নামাজকে তারাবি বা প্রশান্তির নামাজ বলা হয়।

তারাবির নামাজের বিধান

তারাবির নামাজ ২০ রাকাত। তারাবির নামাজকে আট রাকাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা অনুচিত। পবিত্র রমজান মাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল এ তারাবির নামাজ। এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদা। রাসুল (সা.) তিনদিন এ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করেছেন। তিনি নিয়মিত সম্মিলিতভাবে জামাতের সঙ্গে তারাবি নামাজ আদায় করলে তা ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই পুরো রমজানে তিনি জামাতের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করেননি। নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবির নামাজ পড়ার প্রচলন ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর যুগে। সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তা সুন্নত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। তখন আর এটি ফরজ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কেননা, মহানবী (সা.)-এর ওফাতের মাধ্যমে ওহির পথ বন্ধ হয়ে যায়।

তারাবির নামাজের রাকাত

তারাবির রাকাত সংখ্যা শরিয়তের বিশুদ্ধ দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত। গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবি পড়েছেন। ওমর (রা.)-এর খেলাফতকাল থেকে অবিচ্ছিন্ন কর্মধারায় এখন পর্যন্ত মক্কা শরিফের মসজিদুল হারাম ও মদিনা শরিফের মসজিদে নববিসহ সব মসজিদে বিশ রাকাত তারাবি পড়া হয়। এ দীর্ঘ সময়ে কোথাও আট রাকাত তারাবির প্রচলন ছিল না। সর্বপ্রথম ১২৮৪ সালে ভারতবর্ষের আহলে হাদিস আলেম আট রাকাতের ফতোয়া দিয়ে উম্মাহর ঐকমত্যপূর্ণ মাসআলায় বিভক্তি সৃষ্টি করেন। তখন অন্য আহলে হাদিসরাও তার বিরোধিতা করেছেন। এরপর আরবের কিছু বিচ্ছিন্ন আলেমও তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন। কিন্তু আরব বিশ্বের আলেমদের বেশিরভাগই বিশ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করেন।

ওমর (রা.)-এর যুগে সাহাবিদের আমল

ইয়াজিদ ইবনে খুসাইফা (রহ.) বলেন, সাহাবি সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে রমজান মাসে বিশ রাকাত তারাবি পড়তেন। তিনি আরও বলেন, তারা নামাজে শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সুরা পড়তেন। আর ওসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর যুগে দীর্ঘ নামাজের কারণে তাদের (কেউ কেউ) লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়াতেন। (আস সুনানুল কোবরা লিল বাইহাকি : ২/৪৯৬/৪২৮৮)। অপর সূত্রে সাহাবি সায়েব ইবনে ইয়াজিদ (রা.) বলেন, আমরা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে বিশ রাকাত তারাবি পড়তাম। (আস সুনানুল কোবরা লিল বাইহাকি : ১/২৬৭-২৬৮)। তাবেঈ ইবনে আবি যুবাব (রহ.) বলেন, ওমর (রা.)-এর যুগে রমজানের কিয়াম তথা তারাবি ছিল ২৩ রাকাত। (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৭৭৩৩)। হাদিসটির সূত্র বিশুদ্ধ। এতে ২৩ রাকাত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ২০ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর। তাবেঈ আবদুল আজিজ ইবনে রুফাই (রহ.) বলেন, উবাই ইবনে কাব (রা.) রমজানে মদিনায় লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবি এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ২/২৮৫/৭৭৬৬)। তাবেঈ ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আনসারি (রহ.) বলেন, ওমর (রা.) এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন, তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবির নামাজ পড়েন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ২/২৮৫/৭৭৬৪)। তাবেঈ ইয়াজিদ ইবনে রুমান (রহ.) বলেন, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর যুগে লোকেরা রমজানে তেইশ রাকাত নামাজ তথা ২০ রাকাত তারাবি ও তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (মুয়াত্তায়ে মালেক : ৩৮০)।

আলী (রা.)-এর যুগে সাহাবিদের আমল

বিখ্যাত তাবেঈ ইমাম আবু আবদুর রহমান সুলামি (রহ.) বলেন, আলী (রা.) রমজানে হাফেজদের ডাকেন এবং তাদের একজনকে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবির নামাজ পড়ার নির্দেশ দিলেন। তিনি বলেন, আলী (রা.) তাদের নিয়ে বিতর পড়তেন। (সুনানে বাইহাকি : ২/৪৯৬-৪৯৭/৪২৯১)। তাবেঈ আবুল হাসনা (রহ.) বলেন, আলী (রা.) এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন, তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবি পড়েন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা : ২/২৮৫/৭৭৬৩)।

তারাবি ২০ রাকাতের কম পড়া যাবে?

উপরোক্ত বর্ণনাগুলোসহ আরও অন্যান্য বর্ণনা এবং সাহাবি ও তাবেঈনের সর্বসম্মতিক্রমে আমলের ভিত্তিতে এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসা সম্মিলিত অবিচ্ছিন্ন কর্মের ভিত্তিতে আলেমদের অভিমত হলো, বিশ রাকাত তারাবি সুন্নতে মোয়াক্কাদা। বিনা ওজরে এর কম পড়লে সুন্নতে মোয়াক্কাদা ছেড়ে দেওয়ার গোনাহ হবে। যারা বর্তমানে আট রাকাত তারাবির প্রচার করছে, তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল হলো বোখারি শরিফের একটি হাদিস, যা আসলে তারাবি সম্বন্ধে নয়; বরং তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত। তাতে বর্ণিত হয়েছে, রমজানে ও রমজানের বাইরে রাসুল (সা.) চার রাকাত করে আট রাকাত পড়তেন। অথচ আমরা জানি, রমজানের বাইরে কোনো তারাবি নেই এবং তারাবির নামাজ হলো দুই রাকাত করে। যদি রাসুল (সা.) থেকে তারাবি আট রাকাতই প্রমাণিত হতো, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-এর বিরুদ্ধাচরণ করে বিশ রাকাত পড়তেন না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার ও আমার খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নত দৃঢ়ভাবে ধারণ করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৬০৭, তিরমিজি : ২৬৭৬, মুসনাদে আহমদ : ১৬৬৯২, সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২)। তাই সাহাবায়ে কেরাম (রা.), তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও ওলামায়ে কেরাম দ্বারা প্রমাণিত তারাবির নামাজ বিশ রাকাত। সুতরাং এর হেরফের করার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত