ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

রমজান আত্মসংযমের পাঠশালা

আহমদ বিন আলী বিন আবদির রহমান আল হুযাইফি
রমজান আত্মসংযমের পাঠশালা

আমি উপদেশ দিচ্ছি নিজেকে এবং আপনাদের। আল্লাহকে ভয় করুন। এ উপদেশ এমন এক ঋতুতে দিচ্ছি যখন আল্লাহভীতির ঝলমলে নানান নিদর্শন প্রকাশ পায়। আর মোমিনরা সুশোভিত হয় নানান ইবাদতের সাজে। ইবাদতের আবেশঘন এমনই একটি ঋতুতে আল্লাহতায়ালা সিয়াম সাধনাকে বিধিবদ্ধ করেছেন, যাতে বান্দারা আল্লাহভীতিকে প্রায়োগিক অর্থে বাস্তবায়ন করতে পারে।

এ লক্ষ্যেই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা আল্লাহভীতি অবলম্বন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)।

কাজেই হৃদয়কে রাঙিয়ে তুলুন আল্লাহভীতির রঙে। আল্লাহভীতির ঝরনায় অবগাহন করে পাপমুক্ত হোন। আর আত্মনিয়ন্ত্রিত হোন আল্লাহভীতির শক্তিতে। কেননা, আল্লাহভীতি দৃঢ় বন্ধন, মজবুত রশি ও সুরক্ষিত দুর্গ।

রমজান আল্লাহর নির্বাচিত অনুগ্রহ

নিজ সৃষ্টি ও সৃষ্টিজগতের জন্য আল্লাহতায়ালার আছে বিশেষ কিছু নির্বাচন ও মনোনয়ন। আছে অনন্য হেকমত, সূক্ষ্ম ইনসাফ ও ব্যাপ্তময় অনুগ্রহ সংবলিত শ্রেষ্ঠত্বদান। আল্লাহতায়ালা প্রতিটি বিষয়ের স্বরূপ ও সম্মান, ভেতর ও বাইর সম্পর্কে অবগত। স্থান-কাল-পাত্র নির্বাচনেও আছে তাঁর বিশেষ এখতিয়ার। স্থান-কাল-পাত্র হিসেবে তিনি ফজিলতপূর্ণ, কল্যাণ ও বরকতময় বিষয়ের উত্তম ও শ্রেষ্ঠটি নির্বাচন করেন। তাঁর ইনসাফ ও অনুগ্রহ যথার্থ ও পরিপূর্ণ। তাঁর নির্বাচনের মানদণ্ডের ভাষ্য পবিত্র কোরআনে বিবৃত হয়েছে- ‘তোমার প্রতিপালক যা চান, তা সৃষ্টি করেন ও নির্বাচন করেন।’ (সুরা কাসাস : ৬৮)। অতএব রমজান মাস আল্লাহতায়ালা কর্তৃক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ সময়। অন্য মাসের তুলনায় বসন্তকাল। রাজমুকুটে খচিত মহামূল্যবান মণি-মুক্তো।

গোনাহ মাফের সুসংবাদ ও সতর্কবার্তা

রমজান মাস গোনাহ মাফের মাস। নিজ কৃতকর্ম সম্পর্কে সতর্ক হওয়ার মাস। এ মাসে অল্প সময়ে অনেক বেশি নেকি অর্জন করা যায়। কেননা, এ মাসে কল্যাণের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। ইবাদত-আরাধনার নানান দিক উন্মোচিত হয়। এ যেন ‘ঝড়ের সময়ই আম কুড়াতে হয়’ প্রবচনের প্রতিবিম্ব। তাই অবারিত দয়া ও ক্ষমার সুযোগ পেয়েও এ মাসে গোনাহমুক্ত হতে না পারা চরম দুর্ভাগ্য ও লাঞ্ছনার ব্যাপার। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে দাঁড়িয়ে আমিন, আমিন, আমিন বললেন। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি এটা কেন করলেন? প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, ‘জিবরাইল (আ.) আমাকে বললেন, ওই ব্যক্তির নাক ধুলামলিন হোক (অর্থাৎ সে লাঞ্ছিত হোক) যে রমজান পেয়েও ক্ষমাপ্রাপ্ত হতে পারেনি। আমি বললাম, আমিন। অতঃপর বললেন, ওই ব্যক্তির নাক ধুলামলিন হোক, যে তার মা-বাবা উভয়কে অথবা তাদের একজনকে (বার্ধক্যে পেয়ে সেবা করার মাধ্যমে) জান্নাত লাভ করতে পারেনি। আমি বললাম, আমিন। অতঃপর বললেন, ওই ব্যক্তির নাক ধুলামলিন হোক, যার সামনে আপনার নাম উচ্চারিত হওয়ার পর আপনার প্রতি দরুদ পাঠ করেনি। আমি বললাম, আমিন।’ (আল আদাবুল মুফরাদ : ৬৪৬, ইবনে হিব্বান : ৯০৮)।

রমজানের পরিবেশ

রমজানের প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রশান্তিদায়ক। তা যেন মৃদু আলো ছড়ানো সকাল। গাছের ডালে পাখির ডাক। বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ পূবালি বাতাস। প্রস্ফূটিত ফুলের মিটমিট হাসি। রমজানে কল্যাণের দরজা খুলে দেওয়া হয়। দয়ার ভান্ডার মেলে দেওয়া হয়।

হৃদয়ের ভাবান্তর

সুমিষ্ট পানির ঘাটে যেমন লোকের উপচে পড়া ভিড়। প্রবহমান পানির ধারায় পিপাসায় কাতর ব্যক্তির ছুটে যাওয়ার যেমন ব্যাকুলতা, তেমনি বান্দার হৃদয়-মন রমজান মাসে কাতর হয়ে ধাবিত হয় রবের প্রতি। দানশীল ব্যক্তির দানের প্রতিযোগিতায় ছুটে যাওয়ার মতো বান্দার আপাদমস্তক ছুটে চলে কল্যাণের প্রতি। বান্দা কখনো দীর্ঘ সময় নিজ রব থেকে দূরে সরে থাকে। ফলে হৃদয় পাষাণ হয়ে যায়। চোখ ভুলে যায় কান্না। এমন অনেক বান্দা রমজানে কল্যাণের প্রতি ধাবিত হয়। ভেতর থেকে তাড়িত হয়। ফিরে আসে রবের স্মরণে। পাষাণ মন যায় গলে। বুক ভাসায় চোখের জলে। নিভৃতে-নির্জনে।

রোজা আত্মশুদ্ধির পাঠ

রোজা ঈমানের পাঠ। রোজা আত্মার চূড়ান্ত উৎকর্ষ সাধিত স্তর ‘ইহসান’ এর পর্যায়ভুক্ত। কেননা রোজা বান্দা ও রবের মাঝে একটি গোপন বিষয়। যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। ইহসান সম্পর্কে নবী (সা.) বলেছেন, ইহসান হলো, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করা যেন তুমি তাকে দেখছ। আর যদি তুমি তাকে না দেখ, তাহলে অবশ্যই তিনি তোমাকে দেখছেন।

রোজার ফজিলত

রোজা আল্লাহতায়ালা ও বান্দার মধ্যকার একটি নিবিড় প্রেম। আল্লাহর আনুগত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এ ইবাদতকে আল্লাহতায়ালা নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন এবং এর প্রতিদান তিনি নিজ হাতেই দেবেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি আমলের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত আল্লাহ তার ইচ্ছেমতো বৃদ্ধি করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তবে রোজা এর ব্যতিক্রম। কেননা, রোজা আমার জন্য নিবেদিত আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব। রোজাদার আমার জন্যই পানাহার ও কামরিপু থেকে বিরত থাকে।’ (মুসলিম : ২৭৬০)। রোজা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই রাখা হয়। রোজায় থাকে না লোক দেখানো মানসিকতা। রিয়া বা লৌকিকতা। তাই রোজার প্রতিদানও হবে শ্রেষ্ঠ ও অনন্য।

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

বান্দার উচিত রোজা রাখার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আগত আয়াতের শেষাংশের শব্দের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত থেকে এমনটাই বোঝা যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সংবলিত, যা সঠিক পথ দেখায় (সত্য ও মিথ্যার মধ্যে) চূড়ান্ত ফয়সালা করে।

সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে, সে যেন অবশ্যই এ সময় রোজা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তাহলে অন্য দিনে সে সমান সংখ্যা পূর্ণ করবে। তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ সেটাই চান, তোমাদের জন্য জটিলতা চান না এবং (তিনি চান) যাতে তোমরা রোজার সংখ্যা পূর্ণ করে নাও। আল্লাহ তোমাদের যে পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবির পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা বাকারা : ১৮৫)।

মনের সঙ্গে যুদ্ধের প্রতিদান

মানুষের কল্যাণ সাধন, ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিক পথে অবিচল থাকা এবং সৃষ্টি ও স্রষ্টার সঙ্গে যথোচিত ব্যবহার করার ক্ষেত্রে মোমিন বান্দার মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিয়তের বিশুদ্ধতার রয়েছে প্রভাব ও প্রতিদান। মানুষের বাহ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার হৃদয়ের আয়না। হৃদয়ের উজ্জ্বলতা নিয়তের বিশুদ্ধতায়। নিয়তের বিশুদ্ধতা মোমিনের বাহন। আর এ বাহনই তাকে নিয়ে যায় রবের সান্নিধ্যে।

রোজা ও তারাবির ফজিলত

রমজান মাস হৃদয় আলোকিত হওয়ার মাস। আমলের স্তর ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ার মাস। হৃদয়ে আল্লাহর ভয়, আমলে ইখলাস ও সততা হাসিল করে অন্তরের শুচিশুদ্ধতায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভের প্রতিযোগিতা করার মাস। রমজান মাসের আমলের সম্পর্ক অন্তরের শুচিশুদ্ধতা ও নিয়তের বিশুদ্ধতার সঙ্গে। এ ব্যাপারে নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে এবং সওয়াবের নিয়তে রমজানের রোজা রাখবে আল্লাহতায়ালা তার আগের সব (সগিরা) গোনাহ মাফ করে দেবেন। (বোখারি : ৩৮, মুসলিম : ৭৬০, ইবনে হিব্বান : ৩৪৩২) এবং রমজানে রাতে তারাবি নামাজ পড়ার ফজিলত সম্পর্কে নবী (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে এবং সওয়াবের নিয়তে রমজানের তারাবি নামাজ পড়বে, আল্লাহতায়ালা তার আগের সব (সগিরা) গোনাহ মাফ করে দেবেন। (৩৮)।

জুমাবারে দরুদের আমল

জুমাবারে নবী (সা.) এর ওপর অধিক পরিমাণে দরুদ পড়া মুস্তাহাব। এ সম্পর্কে নবী (সা.) বলেন, নিশ্চয় জুমাবার শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিনে তোমরা আমার ওপর অধিক পরিমাণে দরুদ পড়। আর তোমাদের পঠিত দরুদ (ফেরেশতাদের মাধ্যমে) আমার কাছে পেশ করা হয়। (ইবনু আবি শাইবা : ২/৫১৭)।

২ রমজান ১৪৪৪ হিজরি (২৪ মার্চ ২০২৩) তারিখে মদিনার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আলোকিত বাংলাদেশের সহসম্পাদক দিদার শফিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত