ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইউসুফ নবী

চরিত্র রক্ষায় বেছে নিলেন কারাজীবন

জুনাইদ ইসলাম মাহদি
চরিত্র রক্ষায় বেছে নিলেন কারাজীবন

নবী হওয়ার পূর্বাভাস

ইউসুফ। সুদর্শন এক ছোট্ট বালক । তার প্রতি বাবার খুব স্নেহ। মায়া। ভালোবাসা। বাবা একজন নবী। নাম ইয়াকুব (আ.)। ইয়াকুব (আ.) তার ছোট দুই ছেলেকে অন্যদের তুলনায় বেশি ভালোবাসতেন। বিন ইয়ামিন ও ইউসুফ। তারা সহোদর ভাই। বয়সে সবার ছোট। তাই তাদের প্রতি বাবার ভালোবাসাও ছিল অত্যধিক।

ইউসুফ ভবিষ্যতে নবী হবেন। এ কথা জানতেন বাবা । তাই ইউসুফের প্রতি তার ছিল আলাদা নজর। বাবার ভালোবাসা ও নজরদারি আরো বেড়ে গেল, যখন ইউসুফ একটি স্বপ্নের কথা বলল তার বাবাকে। বালক ইউসুফ হঠাৎ একদিন তার বাবার কাছে এসে বলল। আমি স্বপ্নে দেখেছি চাঁদণ্ডসুরুজ ও এগারোটি তারা আমাকে সেজদা করছে। বাবা ছেলের মুখে এমন কথা শুনে বললেন, শোনো বাবা, স্বপ্নের কথা তোমার সৎভাইদের বলো না। ওরা জানতে পারলে তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। আর শয়তান তো পিছে লেগেই আছে।

ভাইদের ষড়যন্ত্রের শিকার

ইউসুফ (আ.) ছোট্ট বয়সে মা হারান। তাই বাবা তাকে খুব আদর করতেন। এছাড়া তিনি দেখতে ছিলেন সুদর্শন। আর ভবিষ্যতে হবেন নবী। অন্য ভাইয়েরা ছিল সৎভাই। তাই বালক ইউসুফের প্রতি তার ভাইদের ছিল প্রচণ্ড রকমের হিংসা। একদিনের ঘটনা। ইয়াকুব (আ.) এর অন্য ১০ ছেলে এসে তাকে বলতে লাগল। বাবা আমরা পাশের মাঠে যাব। আনন্দ ভ্রমণ করব। আমাদের সঙ্গে ইউসুফকে যেতে দিন। সে সেখানে মনের আনন্দে খেলবে। তৃপ্তিসহ খাবার খাবে। আমাদের সঙ্গে থাকবে আর আমরা অবশ্যই তাকে সুরক্ষিত রাখব। বাবা বললেন, আমার ভয় হয়। তোমরা তাকে নিয়ে যাবে আর তোমাদের বেখেয়ালে, কোনো অসতর্ক মুহূর্তে বাঘ এসে তাকে নিয়ে যাবে। খেয়ে ফেলবে। ছেলেরা বাবাকে বলল, এটা কী করে হয়! আমরা এতগুলো ভাই থাকতে বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে? তাহলে তো আমাদের সবই শেষ। বৃথা। ছেলেদের আবদার ও পীড়াপীড়িতে অবশেষে বাবা স্নেহের ইউসুফকে তাদের হাতে তুলে দিতে সম্মত হলেন। কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে। কারণ তিনি গত রাতেই স্বপ্নের মাধ্যমে অবগত হয়েছিলেন, তার ১০ ছেলে মিলে ইউসুফকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে। মনকে প্রবোধ দেয়ার জন্য তিনি তার ছেলেদের থেকে ওয়াদা নিলেন, তারা যেন ইউসুফকে কষ্ট না দেয়, তার প্রতি যেন খেয়াল রাখে। আর বড় ছেলে ইয়াহুদা বা রুবিলকে ডেকে বললেন, বাবা তোমার হাতে ইউসুফকে তুলে দিলাম। তুমিই তার সার্বিক খোঁজখবর রেখো। ইউসুফকে নিয়ে তারা মাঠে চলল। মাঠের পাশেই জঙ্গল। সে জঙ্গলে আছে বাঘের প্রাদুর্ভাব। তারা মাঠে গিয়েই ইউসুফকে হত্যা করতে পাগল হয়ে উঠল। বড় ভাই ইয়াহুদা বাধা দিল। কে শোনে কার কথা? তারা এক কথায় অনড়। ইউসুফকে হত্যা করবে। এটাই চূড়ান্ত। তাদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে বড় ভাই প্রস্তাব করলেন তাকে হত্যা না করে কোনো পরিত্যক্ত কূপে ফেলে দাও। তাহলে তোমরাও হত্যাকারী হবে না। সেও প্রাণে বেঁচে যাবে। অবশেষে তাই করা হলো। আর ইউসুফের জামায় ছাগলের রক্ত মেখে নিয়ে গেল বাবার কাছে। কেঁদে কেঁদে ভালো মানুষ সাজার অভিনয় করে বাবাকে বলল, ইউসুফকে বাঘে নিয়ে গেছে। বাবা তাদেরকে বললেন, বাহ, কী বুদ্ধিমান বাঘ? একটি জ্যান্ত মানুষ নিয়ে গেল অথচ তার শিকারের কাপড় ছিড়ল না! হিংসায় উন্মাদ থাকলে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়। তাদের বেলায়ও তাই হয়েছিল।

দাস হিসেবে বিক্রি

সিরিয়া থেকে মিসরগামী একটি কাফেলা পথ ভুলে জঙ্গলে এসে তাঁবু স্থাপন করে। তাদের একজন পরিত্যক্ত কূপে পানি তোলার জন্য বালতি ফেলে। সে বালতি ধরে ওঠে আসে বালক ইউসুফ। তারা সুদর্শন এ বালককে দেখে মহাখুশি। তখন মানুষ বেচাকেনা হতো। দাসপ্রথা চালু ছিল। তাই তারা তাকে মালিকবিহীন মানবপণ্য হিসেবে গ্রহণ করে। প্রতিদিন এসে তার ভাইয়েরা দূর থেকে ইউসুফকে দেখে যেত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইউসুফ কী আছে, না কোনো ভিনদেশি কাফেলার সঙ্গে দূরদেশে চলে গেছে তা নিশ্চিত হওয়া। ইউসুফকে কূপে দেখতে না পেয়ে ছুটে যায় কাফেলার পিছে। কাফেলায় ইউসুফকে দেখে কাফেলার লোকদের উদ্দেশে তার ভাইয়েরা বলে ওঠে- এ আমাদের পলাতক গোলাম। তোমরা চাইলে তাকে আমাদের কাছ থেকে কিনে নিতে পার। নামে মাত্র মূল্যে কাফেলার লোকেরা ইউসুফকে কিনে নিল। গোলাম হিসেবে ভাইয়েরা তাকে বিক্রি করে দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে। ইউসুফ দূর দেশে চলে যাক। আর ফিরে না আসুক। এ একটি উদ্দেশ্য। আর আরেকটি উদ্দেশ্য হলো ইউসুফ যেন আমরণ দাস হিসেবেই বাঁচে।

মিসরের অর্থমন্ত্রীর ঘরে ইউসুফ

ওই কাফেলা ইউসুফকে মিসরের বাজারে দাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য দাম হাঁকে। ইউসুফ সুদর্শন বালক। তাই তাকে কেনার জন্য শহরের অনেক বিত্তবান এসে জড়ো হয়। দামও ওঠে অনেক। অবশেষে মিসরের অর্থমন্ত্রী আজিজ মিসর কিতফির তাকে চড়া দামে কিনে নেয়। অর্থমন্ত্রী কিতফির ছিলেন নিঃসন্তান। বালক ইউসুফের মায়াবী চেহারা ও বুদ্ধিদীপ্ত গুণাবলি দেখে অর্থমন্ত্রী মুগ্ধ। খুশি। তিনি তার স্ত্রীর কাছে ইউসুফকে তুলে দিয়ে বললেন, একে নিজের সন্তানের মতো ভালোভাবে লালন-পালন কর। হতে পারে ভবিষ্যতে সে আমাদের কাজে আসবে।

আজিজ মিসরের ঘরে আদর আপ্যায়নে, ছেলের স্নেœহ পেয়ে কেটে যায় কয়েক বছর। এক সময় তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন।

যৌবনের পরীক্ষা

সুদর্শন, যৌবনপুষ্ট এক টগবগে যুবক এখন নবী ইউসুফ (আ.)। এখনো নবুয়তপ্রাপ্ত হননি। বয়স ২০ বা ৩০ হয়েছে। মন্ত্রীর বউ জুলাইখা। যে তাকে মায়ের স্নেহে বড় করেছে। সে নারীই তার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করছে। কাছে পেতে চায় নির্জনে। একাকিত্বে। একান্ত নিজের করে। একদিনের ঘটনা। যার বর্ণনা কোরআনে এভাবে এসেছে। ‘যে নারীর ঘরে সে থাকত, সে (মন্ত্রীর বউ জুলাইখা) তাকে ফুসলানোর চেষ্টা করল এবং সবগুলো দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, ‘এসো, কাছে এসো। ইউসুফ বলল, আল্লাহ রক্ষা করুন। তোমার স্বামী আমার মনিব। তিনি আমাকে সযত্নে থাকতে দিয়েছেন। নিশ্চয় সীমা লঙ্ঘনকারী সফল হয় না। ওই নারী তো স্পষ্টভাবেই ইউসুফের সঙ্গে অসৎ কাজ করার ইচ্ছে করেছিল আর ইউসুফের মনেও ওই নারীর প্রতি ইচ্ছা জেগে যাচ্ছিল, যদি না সে নিজ প্রতিপালকের প্রমাণ দেখতে পেত। (আল্লাহ বলেন) আমি তার থেকে অসৎ কর্ম ও অশ্লীলতাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই এরূপ করেছিলাম। নিশ্চয়ই সে আমার মনোনীত বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।’ (সুরা ইউসুফ : ২৩-২৪)।

ইউসুফ (আ.) ওই নারীর কুপ্রস্তাবে অসৎ কাজে লিপ্ত হতে রাজি হননি। অথচ ঘরটি ছিল সুরক্ষিত। নির্জন। নারীও স্বেচ্ছায় নিজেকে অর্পণ করছেন। জোর-জবরদস্তি নেই। কিন্তু ইউসুফ (আ.) আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে বন্ধ দরজার দিকেই দৌড় দিলেন। নিজের চরিত্রকে বাঁচানোর জন্য। পাপ থেকে বাঁচার জন্য। চরিত্র রক্ষার চেষ্টা করায় আল্লাহর ফজলে বন্ধ দরজা অলৌকিকভাবে খুলে গেল, যা ছিল অকল্পনীয়। এ ঘটনা কোরআনে এভাবে এসেছে। ‘তারা একজনের পেছনে আরেকজন দৌড়ে দরজার দিকে গেল এবং এই টানাহেঁচড়ার ভেতর নারীটি তার জামা পেছন দিক থেকে ছিঁড়ে ফেলল। তারা উভয়ে ওই নারীর স্বামীকে দরজার কাছে পেল। (তখন ছলনা করে ওই নারী বলে) যে ব্যক্তি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে মন্দ কাজের ইচ্ছে করে তার শাস্তি কারারুদ্ধ করা বা অন্য কোনো কঠিন শাস্তি ছাড়া আর কী হতে পারে?’ (সুরা ইউসুফ : ২৫)।

চরিত্র রক্ষায় বেছে নিলেন কারাজীবন

আজিজ মিসরের কাছে তার বউ উল্টো অভিযোগ করল ইউসুফের বিরুদ্ধে। দাবি জানাল কঠিন শাস্তির। আর ইউসুফ তার নির্দোষ হওয়ার কৈফিয়ত পেশ করল। এক পর্যায়ে দোলনার শিশু সাক্ষ্য দিল, ইউসুফের জামা সামনের দিকে ছেঁড়া হলে ইউসুফ দোষী। আর পেছনের দিক ছেঁড়া হলে জুলাইখা দোষী। তদন্ত করে দেখা গেল ইউসুফের জামার পেছনের দিক ছেঁড়া। অর্থাৎ ইউসুফ নির্দোষ।

ইউসুফ-জুলাইখার এ ঘটনা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। নারীমহল থেকে নানান তিরস্কার আসে। জুলাইখাও পণ করে ইউসুফ তার চাহিদা পূরণ না করলে তাকে অবশ্যই কারারুদ্ধ করবে।

চরিত্র রক্ষা করা কঠিন হবে বুঝতে পেরে ইউসুফ (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। ‘হে প্রতিপালক! এই নারীরা আমাকে যে কাজের দিকে ডাকছে, তার চেয়ে কারাগারই আমার বেশি পছন্দ।’ (সুরা ইউসুফ : ৩৩)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত