ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

রমজান ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির মাস

শায়খ ড. আলী বিন আবদুর রহমান আল হুজাইফি
রমজান ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির মাস

আল্লাহকে ভয় করতে হবে। যিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন নেয়ামতরাজি। যিনি নিস্তার দিয়েছেন যাকে ইচ্ছা তাকে। আল্লাহর ভয় জাগ্রত রাখতে হবে। কেননা, আল্লাহর ভয় কেয়ামতের দিনের উত্তম পাথেয়। উত্তম সময় সে মুহূর্ত, যাকে আল্লাহ মর্যাদা দিয়েছেন। উত্তম দিন সেদিন, যাকে অন্যদিনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। আর শ্রেষ্ঠ মাস ওই মাস, যাকে আল্লাহতায়ালা অন্য সব মাস থেকে সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। শ্রেষ্ঠ আমল হলো ওই আমল, যা আল্লাহতায়ালা এই মর্যাদাকৃত সময়, দিন ও মাসে বিধিবদ্ধ করেছেন; যেন আমরা তার নৈকট্য লাভে তৎপর হতে পারি। হারাম ও ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থেকে আমাদের আমলনামাকে সংরক্ষিত রাখতে পারি।

জ্ঞান আল্লাহর বড় অনুগ্রহ

সব প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রতিপালকের জন্য, যিনি আমাদের জন্য যা উপকারী, তা শিখিয়েছেন। আর যা আমাদের জন্য ক্ষতিকারক, তা থেকে আমাদের সতর্ক করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(এ অনুগ্রহ ঠিক সেরকমই) যেমন আমি তোমাদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিয়েছি তোমাদের মধ্য থেকে। যে তোমাদের সামনে আমার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে, তোমাদের পরিশুদ্ধ করে, তোমাদের কিতাব ও হেকমতের শিক্ষা দেয় এবং তোমাদের এমন সব বিষয় শিক্ষা দেয়, যা তোমরা জানতে না।’ (সুরা বাকারা : ১৫১)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরা যখন নিরাপদ অবস্থা লাভ কর, তখন আল্লাহর জিকির সেভাবে কর, যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা এর আগে জানতে না।’ (সুরা বাকারা : ২৩৯)। বিশ্বনেতা রাসুল (সা.)-এর উদ্দেশ্যে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হেকমত নাজিল করেছেন এবং তোমাকে এমন সব বিষয়ে জ্ঞান দিয়েছেন, যা তুমি জানতে না। বস্তুত তোমার প্রতি সব সময়ই আল্লাহর মহা অনুগ্রহ রয়েছে।’ (সুরা নিসা : ১১৩)। আল্লাহ আমাদের জ্ঞান শিখিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অন্য আয়াতে বলেন, ‘তোমরা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষরা যা জানত না, আমি তোমাদের তা শিখিয়েছি।’ (সুরা আনআম : ৯১)। অনুগ্রহ-দয়া-শ্রেষ্ঠত্বের সূচনা আল্লাহর থেকেই হয় এবং এর শেষও আল্লাহর দিকেই ফিরে যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার পালনকর্তার কাছে সবকিছুর সমাপ্তি।’ (সুরা নাজম : ৪২)। আল্লাহ আমাদের জ্ঞান দান করেছেন। রমজানের গুরুত্ব ও বিশেষত্ব সম্পর্কে

অবগত করেছেন। এটা আমাদের প্রতি তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ। সুতরাং সব নেয়ামতের প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্য।

দুনিয়াদারের পরিণতি জাহান্নাম

আল্লাহ ও আখেরাতে অবিশ্বাসীরা দুনিয়ার চাকচিক্যে মজে আছে। দুনিয়ার পরিবর্তনশীল ও ক্ষণস্থায়ী ভোগসামগ্রীর সৌন্দর্যে তারা বেজায় খুশি, প্রফুল্ল। তাদের সতর্ক করে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে তাদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে রিজিক প্রশস্ত করেন এবং সংকুচিত করেন। তারা দুনিয়ার জীবনের প্রতি মুগ্ধ। দুনিয়ার জীবন পরকালের সামনে অতি সামান্য সম্পদ ছাড়া কিছু নয়।’ (সুরা রাদ : ২৬)। নেয়ামতের না-শোকরকারী এ কাফেরদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, ‘এসব হয়েছে এ কারণে যে, পৃথিবীতে তোমরা অন্যায় বিষয় নিয়ে উল্লাস করতে এবং এ কারণে যে, অহমিকা দেখাতে। তোমরা জাহান্নামের দরজা দিয়ে প্রবেশ কর, সেখানে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য। কত নিকৃষ্ট অহংকারীদের আবাসস্থল!’ (সুরা মোমিন : ৭৫-৭৬)। অন্য আয়াতে দুনিয়াপ্রেমীদের (কাফেরদের) সাবধান করে আল্লাহ বলেন, ‘সাবধান! প্রকৃতপক্ষে তোমরা নগদ প্রাপ্তির বস্তু তথা দুনিয়ার জীবনকে ভালোবাস এবং আখেরাতকে উপেক্ষা কর।’ (সুরা কিয়ামাহ : ২০-২১)।

ইতিহাস থেকে শিক্ষা

আখেরাত ভুলে দুনিয়ার চাকচিক্যে মুগ্ধ ও প্রফুল্ল যারা, তারা যেন আদ ও সামুদ সম্প্রদায় এবং রাসুলদের বিরোধিতাকারী গত হওয়া সেসব জাতির পরিণতি সম্পর্কে ভাবে। চিন্তা করে গভীরভাবে। কীভাবে নিষ্ফল হলো তাদের স্বাদণ্ডশাহওয়াত-মনোবাঞ্ছনা? আজ কোথায় তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি? তাদের পরিতাপ ও পরিণতি ছাড়া কিছুই নেই! আছে শুধু তাদের পাপ ও ধ্বংসাবশেষ।

নবী-রাসুলবিরোধীদের পরিণতি

কাফেরদের চতুষ্পদ জন্তুর সঙ্গে তুলনা করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা কাফের, তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে এবং চতুষ্পদ জন্তুর মতো আহার করে। তাদের শেষ ঠিকানা জাহান্নাম।’ (সুরা মুহাম্মদ : ১২)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে জিন ও মানবজাতি, তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রাসুলরা আসেনি, যারা তোমাদের আমার আয়াত পড়ে শোনাত এবং তোমাদের এ দিনের সম্মুখীন হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করত, যেদিনে আজ তোমরা উপনীত হয়েছ? তারা বলবে, (আজ) আমরা নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলাম (সত্যিই আমাদের কাছে নবী-রাসুল এসেছিলেন; কিন্তু আমরা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিলাম), আসলে দুনিয়ার জীবন তাদের ধোঁকায় নিক্ষেপ করেছিল। আর আজ তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিল যে, তারা কাফের ছিল। এটা (নবী প্রেরণের ধারা) ছিল এ জন্য যে, কোনো জনপদে সীমা লঙ্ঘনের কারণে এ অবস্থায় ধ্বংস করা তোমার প্রতিপালকের পছন্দ ছিল না যে, তার অধিবাসীরা অনবহিত থাকবে।’ (সুরা আনআম : ১৩০-১৩১)। যারা দুনিয়ার সৌন্দর্যে মুগ্ধ, আখেরাত বিমুখ হয়ে দুনিয়ার প্রতি আসক্ত, তাদের পরিণতি কাহিনি আল্লাহতায়ালা আমাদের শোনালেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা আখেরাতে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আশা রাখে না এবং দুনিয়ার জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট ও তাতেই নিশ্চিত হয়ে গেছে এবং যারা আমার নিদর্শনাবলি নিয়ে উদাসীন, তাদের নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তাদের ঠিকানা জাহান্নাম।’ (সুরা ইউনুস : ৭-৮)।

প্রকৃত কল্যাণে ফিরে এসো

আখেরাত ভুলে দুনিয়ার আনন্দে মজে থাকা ব্যর্থ ও পরিতাপের আনন্দ। অতএব, সৌভাগ্য ও কল্যাণের আনন্দের দিকে ফিরে আসতে হবে। ফিরে আসতে হবে প্রতিপালকের আহ্বানকৃত আনন্দ ও কল্যাণের প্রতি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানুষ, তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এসেছে এক উপদেশ, অন্তরের রোগ-ব্যাধির উপশম এবং মোমিনের জন্য হেদায়াত ও রহমত। (হে নবী) আপনি বলুন, এসব আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর রহমতেই হয়েছে। সুতরাং এতে তাদের আনন্দিত হওয়া উচিত। তারা যা কিছু সঞ্চয় করে তার চেয়ে এটা উত্তম।’ (সুরা ইউনুস : ৫৭-৫৮)।

রমজানে অবারিত রহমত

আল্লাহতায়ালা রমজান মাসের কল্যাণ দ্বারা রহম করেছেন। এ মাসে এমন অনেক ইবাদত ও বরকত রেখেছেন, যা অন্য মাসে নেই। এ মাসে ইবাদতের সওয়াবকেও বহুগুণে বৃদ্ধি করেছেন, যা অন্য সময়ের জন্য করেননি। মুসলমানদের পাপ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। শয়তানকে উম্মতে মুহাম্মদির কল্যাণের পথে বাধা হওয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেন, ‘রমজান আগমন করলে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর শয়তানদের শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়।’ (বোখারি)।

বহু ইবাদত ও আত্মশুদ্ধির মাস

রমজান বহু ইবাদতের মাস। নামাজ সুন্দর করার মাস। নামাজের নুর হাসিল করার মাস। জাকাত আদায় করার মাস। জাকাত আদায়কারীর জন্য সুসংবাদ। অন্যায়কারীর জন্য আক্ষেপ ও কবরে সাপে দংশনের সতর্কবার্তা। রমজানে ওমরা পালন করা বড় হজ পালনের সমপরিমাণ সওয়াব প্রাপ্তির সুবর্ণ সুযোগ। অন্তরকে মানবিক গুণে বিকশিত করার মাস। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, গরিব-দুঃখীর প্রতি যত্নশীল ও মানবিক হওয়ার মাস। হাদিসে এসেছে, ‘দান-সদকা অপমৃত্যুকে প্রতিহত করে, মসিবত দূর করে।’ রোজার মধ্যে আছে ভালো কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধের বার্তা। চিন্তাশীলের জন্য রোজায় আছে সব ধরনের ইবাদত ও আনুগত্য এবং সব ধরনের গোনাহ বর্জনের বার্তা। নামাজের সঙ্গে রোজার সমন্বিত ইবাদতের মাধ্যমেই হৃদয় পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা সৎকর্মে ও আল্লাহভীতিতে একে অন্যের অগ্রগামী হও এবং পাপকাজে ও শত্রুতায় একে অপরের সহযোগী হয়ো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।’ (সুরা মায়িদা : ২)।

৯ রমজান ১৪৪৪ (৩১ মার্চ ২০২৩) তারিখে মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুফতি দিদার শফিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত