নবীদের যে আমল পাথেয়

মাওলানা আবু দারদা

প্রকাশ : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আল্লাহনির্ভরতা তাওহিদের অন্যতম উপাদান। যুগে যুগে নবীরা তাওহিদণ্ডরেসালাত-তাওয়াক্কুলের বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন। নবীরা তাদের জীবনে ঘটিত বিশেষ কোনো ঘটনা বা মুহূর্তে আল্লাহর প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেওয়ার মাধ্যমে উম্মতকে তাওয়াক্কুলের সবক দিয়েছেন। তাওয়াক্কুল দুনিয়া ও আখেরাতে প্রশান্তিময় সফল জীবনের অনন্য মাধ্যম। যাপিত জীবনের সবকিছুতেই আল্লাহর ওপর নির্ভর করতে হবে। মন-মননে স্থিরকৃত ও বাস্তবে চর্চিত এ চেতনাই মোমিন জীবনের সফলতার চাবিকাঠি; প্রশান্তিময় জীবন গঠনের মূলমন্ত্র।

তাওয়াক্কুল কী?

তাওয়াক্কুল হলো, পার্থিব জীবন ও আখেরাত জীবনের ভালোমন্দ ও বিপদাপদ সব কিছুতেই একমাত্র আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা রাখা। এটা ঈমান ও ইসলামের শিক্ষা। বিখ্যাত তাবেয়ি ইমাম সাঈদ ইবনে যুবাইর (রহ.) বলেন, আল্লাহর ওপর ভরসা করা এমন গুণ, যা অনেক ঈমানি গুণের ধারক। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় মোমিনদের তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহ নির্ভরতার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যদি মোমিন হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর ওপর ভরসা কর।’ (সুরা মায়িদা : ২৩)। এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট হওয়া জরুরি, আল্লাহর ওপর ভরসা মানে কর্মহীনতা নয়। কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে শুধু ভরসা করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা নয়। বরং নেক কাজের তৌফিক প্রাপ্তি ও যাবতীয় কর্মের ফলাফল আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে আসে, আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণভাবে এ বিশ্বাস ও আস্থা রাখা। তারপর নিজের চেষ্টাটুকু করে যাওয়া। কোনো কাজের ব্যাপারে চেষ্টা করা ও সতর্কতা অবলম্বন তাওয়াক্কুল পরিপন্থি নয়। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করবে।’ (সুরা জুমা : ১০)। আল্লাহতায়ালাই আদেশ করেছেন তাওয়াক্কুল করতে। আবার তিনিই আদেশ করেছেন নামাজ শেষে জমিনে ছড়িয়ে পড়তে। এ আয়াতে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করার অর্থ হলো, বান্দা তার সাধ্যানুযায়ী কাজ করবে আর ঈমান রাখবে আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর।

তাওয়াক্কুলের উপকারিতা

তাওয়াক্কুল উচ্চ পর্যায়ের ঈমানের বহিঃপ্রকাশ। যার ঈমান যত মজবুত, তার তাওয়াক্কুল তত মজবুত। যে আল্লাহ নির্ভরতাকে জীবনের পাথেয় বানাতে সক্ষম হয়, সে-ই সফল হয় সর্বত্র। আল্লাহকে কাছে পায় সবকিছুতে। আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান তার জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে আল্লাহর ওপর ভরসা করবে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক : ৩)। তাওয়াক্কুলের অনেক সুফল রয়েছে। বান্দার তাওয়াক্কুল যত শক্তিশালী হবে, অকল্পনীয়ভাবে তত বেশি সুফল সে ভোগ করবে। এতে করে বান্দা হারাম উপায়ের দিকে ঝুঁকবে না। আল্লাহর আনুগত্য বাড়বে। এর বিনিময়ে সে আল্লাহর নৈকট্য ও ভালোবাসা লাভ করবে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর প্রতি ভরসা করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)।

ইবরাহিম (আ.)-এর তাওয়াক্কুল

ইবরাহিম (আ.)-কে যখন জালেম কাফের শাসক নমরুদ উত্তপ্ত আগুনে নিক্ষেপ করার ঘোষণা দিল, সারাদেশ থেকে উৎসুক জনতা অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে জড়ো হলো। একদিকে আনন্দ করছে নমরুদ বাহিনী, অন্যদিকে সবাই আতঙ্কে ভুগছে। কিন্তু ইবরহিম (আ.) খুবই শান্তশিষ্ট ধীর-স্থির। চেহারায় ভীতির কোনো ছাপ নেই। নির্লিপ্তভাবে আগুনের পাশে বিড়বিড় করে আল্লাহর প্রশংসায় লিপ্ত। এ সময় জিবরাইল (আ.) এসে বললেন, ‘আমি এ আগুন থেকে বাঁচাতে আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি।’ ইবরাহিম (আ.) অত্যন্ত ধীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমার আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট। যার একত্ববাদ স্বীকার করার কারণে আমাকে আগুনে ফেলা হচ্ছে, সেই আল্লাহ সবকিছু দেখছেন। তিনি চাইলে আমাকে রক্ষা করতে পারেন। আর আমাকে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়াতে তিনি রাজি থাকলে তাতে আমিও রাজি। আপনার সাহায্য আমার প্রয়োজন নেই। আমি যার বান্দা, তিনিই আমাকে রক্ষা করবেন বা মৃত্যু দান করবেন।’ ইবরাহিম (আ.)-এর এ কথার কাছে জিবরাইল (আ.) পরাস্ত হলেন। সমস্ত আয়োজন ও প্রস্তুতি শেষ হলো। আগুনের কুণ্ডলির চারপাশে উৎসুক জনতার চোখ। সবাই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইবরাহিম (আ.)-কে কীভাবে পোড়ানো হয় দেখার জন্য। নমরুদ বাহিনী উল্লাসে শোরগোল করছে। মূর্তিপূজারিরাও আনন্দ প্রকাশ করছে। অবশেষে ইবরাহিম (আ.)-কে উত্তপ্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হলো। কিন্তু এ কী দৃশ্য! অবাক কাণ্ড! নমরুদ, তার বাহিনী ও সমবেত জনতা বিস্মিত ও হতভম্ব হলো! যে আগুন সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়, সে আগুন ইবরাহিমকে পুড়ছে না। আগুন তার জন্য শান্তির বাগান হয়ে গেল। সেই বাগানে তিনি হেঁটে চলছেন, হাসছেন। আল্লাহতায়ালা তাঁর মহাশক্তি দেখিয়ে ইবরাহিম (আ.)-কে বিজয় দান করলেন। কোরআনে এ ঘটনার বিবৃতি এসেছে। আল্লাহতায়ালা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নবী ইবরাহিম (আ.)-কে আগুন থেকে বাঁচালেন। তিনি আগুনকে বললেন, ‘হে আগুন, তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও শান্তিময় হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া : ৬৯)। আগুন আল্লাহর আদেশের গোলাম। আগুনের তো আল্লাহর আদেশ ছাড়া পোড়ানোর ক্ষমতা নেই। তাই দাউ দাউ আগুন জ্বলছে, অথচ ইবরাহিম পুড়ছেন না। এ ঘটনা তাওয়াক্কুল, তাওহিদ, বিশ্বস্রষ্টার অস্তিত্ব ও প্রবল ক্ষমতার নিদর্শন।

রাসুল (সা.)-এর তাওয়াক্কুল

রাসুল (সা.) আবু বকর (রা.)-কে নিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় যখন গারে সাওরে আত্মগোপন করেন, তখন রাসুল (সা.)-এর আল্লাহর প্রতি নির্ভরতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন প্রকাশ পায়। আবু বকর (রা.) বলেন, আমি যখন রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে (সাওর পর্বতের) গুহায় ছিলাম। আমি মুশরিকদের পদচারণা প্রত্যক্ষ করছিলাম। আমি বললাম, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! তাদের কেউ যদি পা উঠায়, তাহলেই আমাদের দেখে ফেলবে।’ তিনি বললেন, ‘আমাদের দু’জন সম্পর্কে তোমার কী ধারণা? আমাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ। অর্থাৎ তিনি আমাদের সাহায্যকারী।’ (মুসলিম : ২৩৮১)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তোমরা তাকে (রাসুলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখ, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন, যখন তাকে কাফেররা বহিষ্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন, বিষণ্ন হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তি বর্ষণ করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখনি। বস্তুত আল্লাহ কাফেরদের মাথা নিচু করে দিলেন আর আল্লাহর কথাই সদা সমুন্নত এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তওবা : ৪০)। গারে সাওরে তিনদিন অবস্থান করেছেন নবীজি (সা.) ও আবু বকর (রা.)। শত্রুপক্ষ গুহার মুখ পর্যন্ত এসে ফিরে যায়। গুহায় প্রবেশ করেনি। এ যে আল্লাহর ইচ্ছে ও আল্লাহনির্ভরতার প্রতিদান। নবীদের আল্লাহনির্ভরতার ঘটনা উম্মতের জন্য শিক্ষা। চলার পথের পাথেয়। হতাশায় আশার বাণী। বিপদে আলোর দিশা।