ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাদশাহ হয়েও নিঃস্ব যিনি

জুনাইদ ইসলাম মাহদি
বাদশাহ হয়েও নিঃস্ব যিনি

ওমর ইবনে আবদুল আজিজ; এক রাজপুত্রের নাম। ইতিহাসবরিত শাসকের নাম। যিনি তাকওয়া, সততা ও ইনসাফের ভিত্তিতে রাজ্য শাসনের কারণে ইসলামি ইতিহাসে দ্বিতীয় ওমর ও পঞ্চম খলিফা হিসেবে সমধিক পরিচিত। তিনি একজন বিখ্যাত তাবেয়ি ছিলেন। ছিলেন বংশগতভাবেই ধনীর দুলাল। অর্ধ পৃথিবী শাসনকারী ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) ছিলেন তার মা লায়লার দাদা। তার বাবা আবদুল আজিজ বিন মারওয়ান ছিলেন উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেকের ভাই। আর খলিফা আবদুল মালেক ছিলেন তার শ্বশুর। পারিবারিক সূত্রেই তিনি ছিলেন ধনী ও ধার্মিক। শাসক হওয়ার আগে তার জীবন ছিল রাজপুত্রের জীবন। শাসক হয়ে পরহেজগারিতা, দুনিয়াবিমুখতা ও অল্পেতুষ্টির গুণে হয়ে ওঠেন সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি প্রায় আড়াই বছর মুসলিম বিশ্বের খলিফা ছিলেন। এই আড়াই বছরের রাজ্য পরিচালনায় তিনি রেখে গেছেন শিক্ষণীয় অনেক উপকরণ। শাসক মানে শোষক বা ভক্ষক নয়। শাসক মানে দেশ-জাতি-মানবতার কল্যাণে অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া এক মহামানব। যিনি জুলুম নয়, ইনসাফ ফেরি করে বেড়ান। এমনই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি জীবনের পরতে পরতে। ‘ক্ষমতার সিংহাসনে বসে সম্পদ গড়ার মানসে’- এ মানসিকতা বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রচলিত হলেও ইসলামি শাসন ব্যবস্থায় ছিল এর উল্টো দিক। যার অন্যতম দৃষ্টান্ত ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ.)।

শূন্য হাতে মৃত্যুর দুয়ারে

ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) খলিফা হওয়ার পর তার নিজের সম্পদ, উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেকের কন্যা তার স্ত্রী ফাতেমার গয়না-অলংকার, মূল্যবান ব্যবহারসামগ্রী ও উপহার-উপঢৌকন সব তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করে দেন। খলিফা থাকাকালীন সাধারণ অভাবি মানুষের মতো তিনি জীবনযাপন করেন। স্ত্রী-সন্তানদের রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ ভোগ করা থেকে দূরে রাখেন। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা তিনি নিজে ভোগ করেননি। ভোগ করতে দেননি নিজ স্ত্রী-সন্তানকেও। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিঃস্ব অর্থ-সম্পদহীন। একজন বংশগত রাজপুত্র, বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের শাসক সততার সঙ্গে ইনসাফপূর্ণ জীবনযাপন করে নিঃস্ব অবস্থায় পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। তবুও রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ করা নিজের জন্য বৈধ মনে করেননি।

সম্পদহীনতার উপদেশ সন্তানদের

তার মৃত্যুর সময়ের একটি ঘটনা খুবই শিক্ষণীয়। মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় একবার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন প্রখ্যাত উমাইয়া সেনাপতি ও তৎকালীন রাজপুত্র মাসলামা ইবনে আবদুল মালেক। দু’জনের মাঝে আলাপ জমে। কথা হয়। কথার এক পর্যায়ে মাসলামা বললেন, ‘হে আমিরুল মোমিনিন, আপনি সব সময়ই আপনার সন্তানদের সম্পদ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। তারা তো একেবারেই নিঃস্ব। আমাকে অথবা আপনার পরিবার থেকে যাকে উত্তম মনে করেন তাকে আপনার সন্তানদের জন্য অভিভাবক বানিয়ে যান, তাহলে খুবই ভালো হবে।’ ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) বললেন, ‘আমাকে ধর। উঠিয়ে বসাও।’ তাকে ধরে বসানো হলে তিনি বললেন, ‘মাসলামা! আমি তোমার কথা শুনলাম। তুমি যে বলেছ, আমি আমার সন্তানদের সহায়-সম্পত্তি থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি। রবের কসম! আমি তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে কখনোই তাদের বঞ্চিত করিনি। তবে হ্যাঁ, যেখানে তাদের কোনো অধিকার নেই, সেখানে তাদের কাছেও ঘেঁষতে দিইনি। আর তাদের জন্য তোমাকে বা অন্য কাউকে অভিভাবক বানানোর কথা যে বলেছ; শোনো! তাদের জন্য আমি যাকে অভিভাবক বানিয়ে রেখেছি, তিনি তো আর কেউ নন। ওই মহান আল্লাহ, যিনি সত্য কিতাব নাজিল করেছেন এবং নেককার বান্দাদের হেফাজত করেন। আর তার নেককার বান্দাদের বিশেষভাবে সাহায্যও করেন। মাসলামা, মনে রেখ! আমার ছেলেরা হয়তো নেককার আল্লাহভীরু হবে, ফলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের ধনী করে দিতে পারেন। যে কোনো সমস্যা থেকে বের হওয়ার পথও দেখাতে পারেন। অথবা আমার ছেলেরা পাপাচারে ডুবে থাকা অসৎ বদকারও হতে পারে। এদের জন্য অঢেল অর্থ ও সম্পদের ব্যবস্থা করে আল্লাহর নাফরমানি ও অবাধ্যতায় আমি সহযোগী হতে চাইনি।’

এ কথা বলে একটু থামলেন। তারপর আবার বললেন, ‘মাসলামা! তুমি আমার ছেলেদের আমার কাছে ডেকে পাঠাও।’ সবাইকে ডেকে আনা হলো। তারা ছিল তেরোজন। তিনি তার ছেলেদের দেখামাত্র কাঁদতে শুরু করলেন। কান্নার তোড়ে গাল বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল। ছেলেদের বললেন, ‘আমার প্রিয় ছেলেরা! আমি তোমাদের একেবারে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে যাচ্ছি।’ আবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কান্নার ফলে মুখ থেকে কোনো কথা বেরুচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর তাদের দিকে তাকালেন। স্নেহমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার প্রিয় ছেলেরা! ধন-দৌলতের বিচারে আমি তোমাদেরকে নিঃস্ব অবস্থায় রেখে গেলেও মান-মর্যাদার বিচারে তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি অনেক অনেক মূল্যবান সম্পদ। এ বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যের যে অঞ্চলে বা যে জনপদেই তোমরা যাবে, মুসলিমণ্ডঅমুসলিম, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তোমাদের সম্মান করবে। তোমাদের সামনে দুটো পথ খোলা থাকল; অন্যায় পথে অর্জিত সম্পদে হয়তো তোমরা ধনী হবে, ফলে তোমাদের পিতাকে যেতে হবে জাহান্নামে। অথবা আল্লাহর বিধানে অনড়-অবিচল থেকে দরিদ্রতা মেনে নিয়ে জীবনযাপন করবে। আর এর পুরস্কার হিসেবে পাবে জান্নাত। আমি নিশ্চিত যে, এটাই হবে যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তানদের যথোপযুক্ত পুরস্কার। এটাই হবে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সনদ।’

এর পর তাদের দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘এবার তোমরা যাও, আল্লাহ তোমাদের রক্ষা করুন। নিরাপদে রাখুন। আল্লাহ তোমাদের সব অভাব দূর করে দিন।’ পিতার বুকভরা দোয়া নিয়ে ছেলেরা প্রস্থান করল। মাসলামার ভাগ্নেদের জন্য চিন্তার শেষ নেই। তাই আবার বলল, ‘হে আমিরুল মোমিনিন! আমার কাছে ওদের জন্য একটি উত্তম প্রস্তাব আছে। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) জানতে চাইলেন, ‘কী’? মাসলামা বললেন, ‘আমার কাছে তিন লাখ স্বর্ণমুদ্রা আছে। আমি এগুলো আপনাকে দিচ্ছি, আপনি ওদের মাঝে ভাগ করে দিন অথবা আপনার ইচ্ছা মতো অন্য কোথাও দান করে দিন।’ ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) বললেন, ‘আমি কি এর চেয়েও উত্তম প্রস্তাব দেব তোমাকে?’ মাসলামা বললেন, ‘কী প্রস্তাব আমিরুল মোমিনিন!’ তিনি বললেন, ‘এ স্বর্ণমুদ্রাগুলো যেখান থেকে এনেছ, সেখানে ফিরিয়ে দেবে। এগুলোর ওপর তোমার কোনো অধিকার নেই।’

মাসলামা অনুতপ্ত হলেন। কাঁদলেন। চোখের কোণ ভিজে অশ্রু টপকে পড়ল তার। এবার কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘আমিরুল মোমিনিন, দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ আপনার ওপর দয়া করুন। রহমত বর্ষণ করুন। আমার পাথরশক্ত হৃদয়কে আপনি কোমল করে দিয়েছেন। বিস্মৃতির বৃহৎ পাথরে চাপা পড়া কথা ও চেতনাকে চোখের সামনে এনে দিয়েছেন। সৎ মানুষের হৃদয়ে আমাদের স্মরণকে স্থায়ী করে দিয়েছেন।’ ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) ইন্তেকাল করার পর মাসলামা তার ভাগ্নেদের সার্বিক খোঁজখবর রাখতেন; কিন্তু তিনি তাদের কাউকেই দুঃখণ্ডকষ্ট, অভাব-অনটন বা নিঃস্ব অবস্থায় দেখেননি। (সুয়ারুম মিন হায়াতিত তাবেঈন : ২৬১-২৬৪)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত