রমজানের শেষ দশকের মৃদুমন্দ বায়ু প্রবাহের ক্ষণ প্রত্যাসন্ন। তার সুবাসিত সৌরভ বাতাসে ভেসে আসছে। তার আলো উদ্ভাসিত হয়েছে। নেককার লোকদের হৃদয়-মন তার ফজিলত লাভের জন্য উৎসুক ও উদগ্রীব হয়ে আছে। মানুষ যখন তার মনোজগতে বিচরণ করে, তখন তার অতীত স্মৃতি ফিরে আসে। সে গভীরভাবে ফেলে আসা দিনগুলোতে তার জীবনাচার নিয়ে ভাবনার গভীরে পৌঁছে। নিজেকে আবিষ্কার করে নিজের দুর্বলতা, অলসতা, পাপ, বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির মাঝে। সুতরাং নিজের মনকে সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত করার এটাই (রমজানের শেষ দশক) তার জন্য অবিকল্প মৌসুম, মনের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্তকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাবার, ঘুম থেকে জেগে ওঠার এবং কাঁধ থেকে অলসতার চাদর ছুড়ে ফেলার। যাতে সে (নেক কাজ থেকে বিরত থেকে) যা হারিয়েছে তা পুষিয়ে নিতে পারে এবং যে সময় ও সুযোগ আসবে, তা লাভজনক বিনিয়োগ করতে পারে। এখন চিন্তাভাবনা পরিবর্তনের সময়। দৃঢ় প্রতিজ্ঞরা এখন শ্রেষ্ঠত্ব লাভে প্রতিযোগিতা করে। এ সময় যে প্রতিটি মুহূর্তকে গনিমতে পরিণত করে। প্রতিটি মিনিট ফজিলতে রূপায়িত করে। সে ইবাদতের নেয়ামতে বসবাস করে। সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পাঠরত থাকে। জিকির, তাহাজ্জুদ, কোরআন পাঠ ও আমলকেন্দ্রিক শুভ চিন্তায় সময় অতিবাহিত করে। এভাবে আমলে রত থেকে যাদের সময় কাটে, এরা সেসব লোক, যারা রমজানের শেষ দশকের মূল্য বুঝে ইবাদত করে এবং ইবাদতের মাঝেই সময় কাটায়। ফলে ঈমান ও ইবাদতের স্বাদ, কোরআনের সৌন্দর্য উপলব্ধি, রবের সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব স্থাপন এবং দয়াময়ের প্রতিদান প্রাপ্তির মধ্যদিয়ে জীবনযাপন করে। তাদের আত্মা হয় পরিশুদ্ধ। কলব হয় উৎকর্ষমণ্ডিত। এটাই সিয়াম সাধনার গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য, যা সুরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতের শেষাংশে ‘যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পার’ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
গুরুত্বসহ সপরিবারে আমল
এ শেষ দশকের দম সীমিত। ক্ষণ সীমিত। সময় বয়ে যায় খুব দ্রুত। দিনগুলো চলে যায় চোখের পলকে। বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার অধিকারী ব্যক্তি এ দশকে নিজেকে মুক্ত রাখে দুনিয়াবি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও বিভিন্ন কর্মব্যস্ততা থেকে। আর আমলের অনুশীলনে সচেষ্ট হয় পূর্ণ সতর্কতা, তৎপরতা ও প্রাণবন্ততায় উজ্জীবিত হয়ে। উম্মুল মোমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ব্যাপক অর্থবোধক স্বল্প শব্দে, সাহিত্যপূর্ণ ভাষায় রমজানের শেষ দশকে রাসুল (সা.)-এর অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করেন, ‘রমজানের শেষ দশক আগমন করলে রাসুল (সা.) (কোমরে) ইজার বেঁধে নিতেন (অর্থাৎ আমলে বদ্ধপরিকর হতেন), নিজে রাত জাগতেন (ইবাদতের জন্য) এবং পরিবারকে জাগিয়ে দিতেন।’ (বোখারি : ২০২৪, মুসলিম : ১১৭৪)। যাতে এ পদ্ধতি উম্মতের জন্য আলোকবর্তিকা হয়, তওবাকারীদের জন্য হয় পথনির্দেশক, অনুগতদের জন্য হয় আমলি কর্মপন্থা, পাপীদের জন্য আশ্রয়স্থল আর মোমিনদের জন্য হয় অগ্রগতি।
শেষ দশকে মোনাজাত
শেষ দশকের রাতগুলোতে রবের কাছে বান্দার আরজি-মোনাজাত বড় মধুর হয়। বান্দা তার রব ও মনিবের সঙ্গে একাকিত্বে নিভৃত আলাপে রত হয়। নিজের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুঃখণ্ডকষ্টের কথা জানায়। প্রেমময় খুনসুটিতে অভিযোগ-অনুযোগ করে। নিজ সৃষ্টিকর্তার কাছে তুলে ধরে নিজ আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। নিজের পাপ ও ভুল স্বীকার করে। তওবার ঘোষণা দেয়। কেঁদে কেঁদে অশ্রু ঝরায়। অশ্রুজলে বুক ভাসায়। বান্দা তার হৃদয়কে ভয় ও আশা এবং লাঞ্ছনা ও হীনতায় পূর্ণ করে তোলে। অতএব, বান্দা তার প্রার্থনায় আকুতি জানায়, হে আমার প্রতিপালক! তুমি ছাড়া আমার কোনো রব নেই। তোমার পক্ষ থেকে উপশম ছাড়া আমার হৃদয়ের কোনো সুস্থতা ও পূর্ণতা নেই। এ সময় দোয়া কবুল হয়। বান্দার ডাকে সাড়া দেওয়া হয়। রবের পক্ষ থেকে দয়া-দান অবতীর্ণ হয়। মুষলধারে রহমত বর্ষিত হয়। বান্দার ডাকে সাড়া দেওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদের বলুন যে,) আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে, আমি তার ডাক শুনি। (অর্থাৎ তাদের প্রার্থনা কবুল করি)।’ (সুরা বাকারা : ১৮৬)। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহতায়ালা চিরঞ্জীব, উদার-মহৎ, যখন কোনো ব্যক্তি তার কাছে দু’হাত তুলে (কিছু চায়) নিরাশ শূন্য অবস্থায়, সে হাত ফিরিয়ে দিতে তিনি লজ্জাবোধ করেন।’ (তিরমিজি : ৩৫৫৬)। কাজেই গড়িমসি না করে সময় থাকতে নিজেকে গড়ে নিতে হবে।
লাইলাতুল কদরের ফজিলত
লাইলাতুল কদরের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘লাইলাতুল কদর (শবেকদর) এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতারা ও রুহ তথা জিবরাইল (আ.) প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে অবতীর্ণ হয়। এ রাত (শুরু-শেষ) শান্তি ফজরের উদয় পর্যন্ত।’ (সুরা কদর : ৩-৫)। রোজাদার কি ভাবতে পারে এ রাতের বিশাল প্রতিদানের কথা? এ রাত এক হাজার রাতের চেয়ে উত্তম। এ বিশাল সমাগম ও মর্যাদাপূর্ণ উপস্থিতি কি ভাবতে পারে আল্লাহর সামনে তাহাজ্জুদে দণ্ডায়মান ব্যক্তি? এ রাতের বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে আকাশ থেকে নেমে আসবেন ফেরেশতারা। নেমে আসবেন জিবরাইল (আ.)। এ নেমে আসা শান্তি ও নিরাপত্তাকে শামিল করে। শামিল করে সব ধরনের শান্তিকে। এটা এমন শান্তি, যাতে শুধু শান্তিই আছে, কোনো ক্ষতি নেই। ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত অধিক পরিমাণে কল্যাণ অবতীর্ণ হওয়ায় এ রাত সব ধরনের বিপদ ও অনিষ্ট থেকে নিরাপদ।
শান্তি ও বঞ্চনা
এ রাতে ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত মসজিদের অধিবাসী, নামাজে সেজদারত ব্যক্তিদের জন্য ফেরেশতারা রহমতের দোয়া করেন। এটি এমন একটি শান্তিময় রাত, যা না গরম না ঠান্ডা। এমন বরকতময় রাত, ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত যার শুরু-শেষ পুরোটাই কল্যাণকর। এ রাত হবে শান্তিময় আল্লাহর বন্ধুদের জন্য। আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য। এ রাত শান্তির ছায়া দেবে। আল্লাহতায়ালার ইবাদতে রাতজাগা প্রতিটি মোমিন বান্দার জন্য এ রাত হবে নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ও স্থায়ী নিরাপত্তা। এ শান্তি ও নিরাপত্তা দীর্ঘ হবে ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত। এ বিশাল ফজিলত, বিরাট প্রতিদান যথাযথভাবে অর্জিত হবে না ভালো প্রস্তুতি, পরিশ্রম ও অধ্যবসায় ছাড়া। ধৈর্যের সঙ্গে প্রিয়জনের (সঙ্গীর) সাময়িক বিচ্ছেদ ছাড়া। কয়টা দিনই তো মাত্র। এর পরই তো ঘরে ফসল তোলা হবে। আর বান্দা তার রবের কৃতজ্ঞতা আদায় করবে এ জন্য যে, এ গনিমত (শবেকদর) লাভ করার জন্য রব তাকে সৃষ্টিজীবের মধ্য থেকে নির্বাচন করেছেন নেকিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে, বরকতকে গনিমত হিসেবে লাভ করতে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘এ মাস তোমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। আর তার মাঝে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম একটি রাত রয়েছে। এ রাত থেকে যাকে বঞ্চিত করা হলো, তাকে সব কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করা হলো। আর বঞ্চিতজনই এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৬৪৪)।
লাইলাতুল কদরের দোয়া
উম্মুল মোমিনিন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যদি আমি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাই, তাহলে সে রাতে কী দোয়া পড়ব?’ রাসুল (সা.) জবাবে বললেন, ‘তুমি পড়বে- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।’ (অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দিন)।
তওবা ও দোয়া পাঠে ক্ষমা
সত্য ও খাঁটি দিলে দোয়াটি অনবরত জবানে চলতে থাকলে, তওবা করে আল্লাহতায়ালার প্রতি ধাবিত হয়ে দোয়াটি পড়তে থাকা অবস্থায় লাইলাতুল কদর এবং ফেরেশতাদের অবতরণ পেয়ে গেলে, সেটা হবে এমন নেয়ামত, যার কোনো জুড়ি নেই। এমন অনুগ্রহ, যার কোনো তুলনা নেই। বর্ণনাতীত সৌভাগ্য, আল্লাহতায়ালার ক্ষমা তথা পাপরাশি মোচন, ভুলত্রুটি মাফ করে দেওয়া, বান্দার গোনাহ ঢেকে রাখা, মন্দ কাজগুলো মুছে দেওয়া, নেক কাজগুলো বহুগুণে বৃদ্ধি করা আর গোনাহগুলোকে নেকিতে পরিবর্তন করে দেওয়া- এটাই ক্ষমা প্রাপ্তির অর্থ। লাইলাতুল কদরে রয়েছে তওবা ও দোয়ার বরকত। এ ক্ষমা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা তওবা করেছে, ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদের গোনাহগুলোকে নেকি দ্বারা পরিবর্তন করে দেবেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা ফোরকান : ৭০)। হাদিসে এসেছে, আল্লাহতায়ালা মোমিন বান্দার নিকটবর্তী হয়ে তার ওপর নিজের রহমতের ছায়া দিয়ে তাকে ঢেকে ফেলেন। তারপর বলেন, ‘তুমি তো তোমার অমুক গোনাহ স্বীকার করেছ?’ বান্দা বলবে, ‘হ্যাঁ, আমার প্রতিপালক। (আমি স্বীকার করেছি)।’ একপর্যায়ে আল্লাহতায়ালা বান্দার থেকে তার গোনাহের স্বীকারোক্তি নেবেন। আর বান্দা মনে মনে ভাববে, সে ধ্বংস হয়ে গেছে। আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘আমি দুনিয়ায় তোমার পাপকে ঢেকে দিয়েছি। আর আজ আমি তোমার এ পাপ মাফ করে দেব।’ এরপর তাকে নেকির কিতাব (আমলনামা) দেওয়া হবে। (বোখারি)। পরিপূর্ণ ক্ষমা হলো সেটা, বান্দা যখন পাপের মাধ্যমে নিজের ওপর জুলুম করে, অতঃপর তওবা করে ফিরে আসে, তখন তার সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলে দাও হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার : ৫৩)।
নেককারের প্রতিদান ধ্বংস হয় না
আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে হারামাইনের পাশে ও আঙিনায় সমবেত এ মোবারক দল। এ মোমিন আত্মাগুলো সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে আল্লাহর বিভিন্ন ঘরে। এরা ওইসব লোক, যারা নিজেদের ঘরে নামাজে পা স্থির রাখে। তাদের প্রত্যেকেরই হৃদয়-মন বিগলিত হয়েছে। তাদের জিহ্বা আল্লাহর আয়াত পাঠ করতে শুরু করেছে। তারা কোরআনের স্পষ্ট বর্ণনা শোনে। কোরআনের উপদেশে বিনয়ী ও ভীত হয়। তাদের মন আল্লাহর রহমত প্রত্যাশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে। এরা এবং পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমের সেসব লোক, যারা রোজা ও তারাবির স্বাদ পায়, শবেকদর তালাশ করে, তারা আমল করে প্রেমিকের মন নিয়ে, তওবাকারীর বিনয়, পাপীর চোখের পানি, ভীত-শঙ্কিত ব্যক্তির হৃদয় ও সত্যবাদীর আশা নিয়ে। যারা ঈমানের সঙ্গে, সওয়াবের প্রত্যাশায় আল্লাহর কাছে এসেছে। নিজেকে রবের কাছে সমর্পিত করেছে। আল্লাহ তাদের আশাকে নিরাশায় পরিণত করেন না। তাদের উত্তম আমলের প্রতিদান কখনোই নষ্ট করেন না। আল্লাহ তো অনুগ্রহশীল, দয়ালু, ব্যাপক ক্ষমাশীল, আর তার দয়া প্রতিটি বস্তু ব্যাপৃত। নেককার লোকদের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে, ‘তারা এমন সম্প্রদায়, যাদের কারণে তাদের সঙ্গী-সহচর হতভাগ্য হয় না।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) নিজ বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও গোনাহগুলো মাফ করে দেন। আর তোমরা যা কিছু কর, তিনি তা জানেন।’ (সুরা শূরা : ২৫)।
১৬ রমজান ১৪৪৪ (৭ এপ্রিল ২০২৩) তারিখে মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুফতি দিদার শফিক