ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহানবীর ঈদ

মাওলানা আবু দারদা
মহানবীর ঈদ

নেক আমলের বসন্তকাল রমজান শেষে বাঁকা চাঁদের হাসি নিয়ে উপস্থিত হয় ঈদুল ফিতর। ঈদ মুসলমানের ধর্মীয় উৎসব; ক্ষমাপ্রাপ্তি ও নির্মল আনন্দের দিন। এ আনন্দ আল্লাহর নেয়ামত প্রাপ্তি ও মাগফিরাত প্রত্যাশার। আল্লাহর প্রতি সমর্পিত হওয়ার। রমজানে দিনের বেলা রোজা পালন আর রাতে তারাবি ও কিয়ামুল লাইলের সাধনার প্রতিদান রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত। এটা ঈদের দিনে মোমিন বান্দার বড় প্রাপ্তি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সওয়াবের আশা রেখে রমজানের রাতে তারাবি আদায় করবে, তার বিগত গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে।’ (বোখারি : ২০০৯)। তাই রোজা শেষে মোমিন বান্দার জন্য ঈদুল ফিতর হলো পুরস্কার লাভ ও ক্ষমাপ্রাপ্তির দিন। আর বান্দার আনন্দ প্রকাশ পায় ঈদের দিন তাকবির বলা ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায়ের মধ্য দিয়ে।

ঈদের রাতের আমল

চাঁদ রাতে তথা ঈদের আগের দিন দিবাগত রাতে রাসুল (সা.) নিজে আল্লাহর ইবাদতে রত থাকতেন। অন্যদের ইবাদতে রত থাকতে উৎসাহ দিতেন। রাসুল (সা.)-এর এ সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে সালাফ তথা আলেম ও বুজুর্গ পূর্বসূরীরা ঈদের রাতে খুব গুরুত্বের সঙ্গে আমল করতেন। ক্ষমা ও পুরস্কার লাভের জন্য রোজাসহ অন্যান্য বিধিবিধান ঠিকমতো আদায় করতে পেরেছেন কি-না, তা কবুল হয়েছে কি-না, এ চিন্তায় তারা অস্থির থাকতেন। বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়তেন। আল্লাহর কাছে রোনাজারি করতেন। দোয়ায় মশগুল থাকতেন। হাদিসে এসেছে, আবু উমামা (রা.) রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার রাতে (সওয়াবের নিয়তে, ইবাদতের উদ্দেশ্যে) জাগ্রত থাকবে, তার হৃদয় ওই দিন মৃত্যুবরণ করবে না, যেদিন অন্য হৃদয়গুলো মৃত্যুবরণ করবে। (অর্থাৎ কেয়ামতের দিবসে তার কোনো ভয় থাকবে না)।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৭৮২)।

ঈদের সূচনা ও তাৎপর্য

রাসুল (সা.) ঈদকে মুসলমানদের জন্য নিখাঁদ আনন্দ উৎসবের দিন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই স্বীকৃতির কথা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুল (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন মদিনাবাসীকে বছরে দু’দিন উৎসব করতে দেখেন। রাসুল (সা.) তাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এই দুই দিন উৎসব কর কেন?’ তারা বলল, ‘জাহেলি যুগে এ দুই দিন আমরা আনন্দ উৎসব করতাম।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদেরকে এ দুই দিনের বদলে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তা হলো- ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১১৩৪)। এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, মুসলমানরা অমুসলমানদের আনন্দণ্ডউৎসব বর্জন করার জন্যই আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের দুটি ঈদ দান করেছেন। মুসলমানদের ঈদ উদযাপন হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি মোতাবেক এবং শরিয়তের বিধান অনুসারে। মুসলমানদের ঈদ প্রসঙ্গে হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘ঈদুল ফিতর হলো, ঈদের নামাজ পড়া ও সদকাতুল ফিতর আদায় করা এবং ঈদুল আজহা হচ্ছে ঈদের নামাজ পড়া ও কোরবানি করা।’ (ফাজায়েলুল আওকাত : ৩০৩-৩০৪)।

সদকাতুল ফিতর আদায়

রোজার মাধ্যমে রোজাদার কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারে সারাবছর অনাহারে থাকা মানুষের কষ্ট। তাই দুঃখী মানুষের মুখে ঈদের দিন হাসি ফোটাতে এবং রোজাদারের রোজা রাখতে গিয়ে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে, তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিত্তবানদের ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন রোজাদারকে অর্থহীন ও অশ্লীল কথা-কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা হিসেবে। যে (ঈদের) নামাজের আগে তা আদায় করবে, তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে নামাজের পর আদায় করবে, তা সাধারণ সদকা হিসেবে বিবেচিত হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬০৯)। তাই ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করে দেয়া মুস্তাহাব।

ঈদের দিন রোজা না রাখা

পুরো মাস রোজা রাখার পর ঈদ মোমিন বান্দার জন্য আনন্দের দিন। তাই আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) দু’দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। তা হলো- ঈদুল ফিতরের দিন এবং কোরবানির ঈদের দিন। (মুসলিম : ১১৩৮)।

ঈদগাহে যাওয়ার আগে খেজুর খাওয়া

ঈদের দিন রোজা রাখা নিষেধ। তাই এর প্রকাশ হিসেবে মুস্তাহাব হলো, ঈদগাহে যাওয়ার আগে কয়েকটি খেজুর খেয়ে যাওয়া এবং এ ক্ষেত্রে বেজোড় সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য রাখা। খেজুরের ব্যবস্থা না থাকলে অন্য কোনো মিষ্টান্ন গ্রহণ করা। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরে খেজুর না খেয়ে ঘর থেকে বেরুতেন না। তিনি বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন। (বোখারি : ৯৫৩)। এই আমল হলো ঈদুল ফিতরের জন্য। কেননা, ঈদুল আজহার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো, না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং কোরবানির গোশত দিয়ে সর্বপ্রথম আহার গ্রহণ করা। রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরে না খেয়ে বেরুতেন না, আর ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহ হতে ফেরার আগে কিছু খেতেন না। ঈদগাহ থেকে ফিরে পশু জবাই করার পর নিজ কোরবানির পশুর গোশত থেকে খেতেন। (মুসনাদে আহমদ : ২২৯৮৪)।

গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া

ঈদের দিন গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম গোসল করে ঈদগাহে যেতেন। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করে নিতেন। (মুয়াত্তায়ে মালেক : ৪৮৮)।

উত্তম পোশাক পরিধান করা

সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা এবং বৈধ সাজগোছ গ্রহণ করা মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম এমনটি করতেন। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) দুই ঈদে উত্তম পোশাক পরতেন। (সুনানে কোবরা লিল বাইহাকি : ৬১৪৩)। অতএব, ঈদের দিন সাধ্যানুযায়ী উত্তম পোশাক পরা মুস্তাহাব। তবে উত্তম পোশাক মানে নতুন পোশাক নয়; বরং নিজের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে ভালো পোশাক পরা।

বেশি বেশি তাকবির বলা

তাকবির হলো, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। ঈদগাহে যাওয়ার সময় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তাকবির বলতে থাকা। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের সকালে সশব্দে তাকবির বলতে বলতে ঈদগাহে যেতেন এবং ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবির বলতে থাকতেন। (সুনানে দারাকুতনি : ১৭১৬)।

এক পথে যাওয়া আরেক পথে ফেরা

সম্ভব হলে ঈদগাহে যাওয়ার সময় এক পথে যাওয়া আর ফেরার সময় ভিন্ন পথে আসা। নবীজি (সা.) এমনটি করতেন। জাবের (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) ঈদের দিন এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যেতেন আর ভিন্ন পথ দিয়ে ফিরতেন। (বোখারি : ৯৮৬)।

হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া

যতটুকু সম্ভব হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঈদগাহে হেঁটে যেতেন এবং হেঁটে ফিরতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১২৯৫)।

একে অপরের জন্য দোয়া করা

ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম দোয়াসুলভ বাক্যে সৌজন্য বিনিময় করতেন। তাবেয়ি জুবাইর ইবনে নুফাইর (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরা ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাতে বলতেন, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের এবং তোমাদের আমলগুলো কবুল কর। (ফাতহুল বারি : ২/৪৪৬)। এ রকম সৌজন্য বিনিময়ের মাধ্যমে উত্তম আচরণ প্রকাশিত হয় এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় হয়।

ঈদের নামাজের কেরাত

ঈদের নামাজের জন্য বিশেষ কোনো সুরা নির্ধারিত নেই। তবে হাদিসে পাওয়া যায়, নবীজি (সা.) কোন কোন সুরা দিয়ে ঈদের নামাজ পড়িয়েছেন। আবু ওয়াকিদ লাইসি (রা.) বলেন, ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নবীজি (সা.) ঈদের নামাজে কী কেরাত পড়তেন?’ আমি বললাম, ‘সুরা কমার ও সুরা কফ।’ (মুসলিম : ৮৯১)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত