ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দাউদ (আ.)

হস্তশিল্পের কারিগর এক বাদশাহ যিনি

সায়িদা ইসলাম
হস্তশিল্পের কারিগর এক বাদশাহ যিনি

নবী ও বাদশাহ ছিলেন যিনি

বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নবী ছিলেন দাউদ (আ.)। তিনি ছিলেন নবী ও বাদশাহ। ধর্ম ও ক্ষমতার সমন্বয়ে ছিল তার বাদশাহি ও নবীজীবন। ধর্ম ও রাষ্ট্রক্ষমতার অভিন্ন ও অখণ্ড নেতৃত্ব দিয়ে বহু নবীর মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীকে শাসন করিয়েছেন। দাউদ (আ.) ছিলেন সে রাজ ক্ষমতার অধিকারী প্রভাবশালী নবীদের একজন। তিনি শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমনের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে পৃথিবীতে আগমন করেন। মুসা নবীর পরে তিনি নবী হিসেবে প্রেরিত হন। বর্তমান ফিলিস্তিনসহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত ছিল তার রাজত্ব, যা আধুনিক সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, ফিলিস্তিন ও ইরাককে শামিল করে। পৃথিবীর বিশাল ও অখণ্ড ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর প্রতি তার আনুগত্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহতায়ালা সান্ত¡না দিয়ে বলেন, ‘তারা যেসব কথা বলে তাতে তুমি সবর কর এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদকে স্মরণ কর। নিশ্চয়ই সে ছিল অত্যন্ত আল্লাহ অভিমুখী। (সুরা ছোয়াদ : ১৭)। দাউদ (আ.) সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ৯টি সুরায় ২৩টি আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে। দাঊদ (আ.)-এর ওপর যাবুর কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল। তার কণ্ঠ ছিল ভারি মিষ্টি।

দাউদ নবীর ইবাদত

আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে প্রিয় দাউদ (আ.) এর রোজা। তিনি এক দিন পরপর সারা বছর রোজা রাখতেন। হাদিসে দাউদ (আ.)-এর রোজার প্রশংসা করা হয়েছে এবং তার রোজা রাখার পদ্ধতিকে উত্তম বলা হয়েছে। আমর ইবনুল আস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সব সময় রোজা পালন কর এবং রাতভর নামাজ আদায় কর? আমি বললাম, ‘হ্যাঁ’, তিনি বললেন, ‘তুমি এরূপ করলে চোখ বসে যাবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। যে সারা বছর রোজা পালন করে, সে যেন রোজা পালন করে না। মাসে তিন দিন রোজা পালন করা সারা বছর রোজা পালনের সমতুল্য।’ আমি বললাম, ‘আমি এর চেয়েও বেশি করার সামর্থ্য রাখি।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি দাউদ (আ.)-এর রোজা পালন কর। তিনি একদিন রোজা পালন করতেন আর একদিন ছেড়ে দিতেন। আর যখন শত্রুর সম্মুখীন হতেন তখন পলায়ন করতেন না।’ (বোখারি : ১৮৫৫)।

বোখারি ও মুসলিমের এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় নামাজ হলো দাউদ (আ.)-এর নামাজ এবং সবচেয়ে পছন্দনীয় রোজা হলো দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি অর্ধরাত পর্যন্ত ঘুমাতেন। অতঃপর এক-তৃতীয়াংশ নামাজে কাটাতেন এবং শেষ ষষ্ঠাংশে ঘুমাতেন। তিনি একদিন পরপর রোজা রাখতেন। শত্রুর মোকাবিলায় তিনি কখনো পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতেন না।’ (মেশকাত : ১২২৫)।

দাউদ নবীর পেশা ও আমাদের শিক্ষা

একজন বাদশাহ তার রাজত্ব পরিচালনা করবে এবং সাম্রাজ্য রক্ষা করবে- এটাই তো তার পেশা হবে, আর এর বিনিময়ে বেতন ভাতা নেবে, এমনটাই হওয়া অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু না, দাউদ (আ.) বাদশাহ হয়েও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা নিতেন না। তিনি নিজ হাতে বর্ম তৈরি করে তা বিক্রি করে উপার্জিত অর্থে জীবিকা নির্বাহ করতেন।। রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণের জন্য কিছুই নিতেন না। যদিও সেটা নেওয়া কোনো দোষের ছিল না। দাউদ (আ.) নবী ও বাদশাহ হয়েও পেশায় একজন দক্ষ কর্মকার ছিলেন। বিশেষ করে শত্রুর মোকাবিলার জন্য উন্নত মানের বর্ম নির্মাণে তিনি ছিলেন একজন দক্ষ ও কুশলী কারিগর। দাউদ (আ.)-এর অন্যতম মুজেজা ছিল তার হাতে লোহা মোমের মতো গলে যেত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর আমি তাকে তোমাদের জন্য বর্ম নির্মাণ কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলাম, যাতে তা যুদ্ধের সময় তোমাদের রক্ষা করে। অতএব তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে?’ (সুরা আম্বিয়া : ৮০)। দাউদ (আ.)-এর নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহের বিষয়টি হাদিসে হালাল রিজিকের অনুসন্ধানের প্রতি বেশ উৎসাহমূলকভাবে বর্ণিত হয়েছে। মিকদাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এর চেয়ে উত্তম আর খাদ্য নেই, যা মানুষ নিজ হাতে উপার্জনের মাধ্যমে ক্রয় করে। দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।’ (বোখারি : ২০৭২)।

দাউদ (আ.) রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা নিলে কোনো পাপ হতো না। এটা বৈধ। তবুও তিনি নিজ হাতের কর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। বাদশাহ হয়েও রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদ তিনি ভোগদখল করেননি। নবীরা বৈষয়িক অর্থ-সম্পদ গড়াকে পছন্দ করেন না। এটা নবী ও নেককার লোকদের অতি উঁচু পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য। জনগণের অধিকার আদায়ে ত্রুটি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাতের অপবাদ বা ব্যক্তিগত নিষ্কলুষ জীবন ও কর্ম পরিচালনার দৃঢ় মানসিকতা থেকে সৃষ্ট আত্মজিজ্ঞাসাই বেতন-ভাতাহীন বাদশাহিতে উদ্বুদ্ধ করেছে যুগে যুগে নবী, সাহাবি ও তাবেয়ি ও নেহায়তে সৎ লোকদের। পৃথিবীতে বিবেক ও সততানিষ্ঠ দায়িত্বশীল মানুষের কাছে আর পরকালে রবের কাছে জবাবদিহি করার মানসকিতা ছাড়া ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবন সুন্দর ও সুখময় হয় না। ক্ষমতা ও ধর্ম একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বরং ক্ষমতাবানরা ধার্মিক হলে সে ক্ষমতা কালান্তরের গৌরবময় ইতিহাসে পরিণত হয়। দাউদ (আ.) এর জীবন ও কর্ম থেকে এ বার্তা ও আবেদন স্পষ্টভাবে প্রমাণিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত