সংসার জীবনে মহানবী (সা.)
আবদুল কাইয়ুম শেখ
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এই পৃথিবীতে অতীতে যত মানুষ এসেছে, বর্তমানে যত মানুষ আসছে ও ভবিষ্যতে যত মানুষ আসবে, তাদের সবার সঙ্গে যদি মহানবী মুহাম্মাদ (সা.)-কে তুলনা করা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি চারিত্রিক বিবেচনায় সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হবেন। বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর এই মহোত্তম চারিত্রিক সুষমা তার ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। ব্যক্তিজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো সাংসারিক জীবন। এই সাংসারিক জীবনেও মহানবী (সা.) ছিলেন উত্তম চরিত্রের মূর্ত প্রতীক। সংসার জীবনে মহানবী (সা.) এমন অনন্য পন্থা অবলম্বন করেছিলেন, যার ফলে তার দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠেছিল সুখময়, শান্তিময় ও প্রেমময়।
স্ত্রীর সঙ্গে হাস্যরস করা
আনন্দণ্ডবিনোদন, হাসি-কৌতুক ও হাস্যরসবিহীন সংসার ধূসর মরুভূমির মতো। সুখ, শান্তি ও প্রশান্তিময় দাম্পত্য জীবনের জন্য হাস্যরস থাকা অপরিহার্য। হালাল বিনোদন, হাসি-কৌতুক ও হাস্যরসের মাধ্যমে মহানবী (সা.) এর দাম্পত্য জীবন সুখময়, শান্তিময় ও প্রেমময় ছিল। তিনি উম্মাহাতুল মোমিনিনের সঙ্গে সময়ে সময়ে হাসি-কৌতুক, আনন্দণ্ডবিনোদন ও হাস্যরস করতেন। একবার আয়েশা (রা.)-এর খেলনাগুলোর মধ্যে ডানাবিশিষ্ট একটি পুতুল দেখতে পেয়ে মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করেন, এটা কী? আয়েশা (রা.) জবাবে বলেন, ঘোড়া! মহানবী (সা.) হেসে বলেন, এটা আবার কেমন ঘোড়া, যার পাখা রয়েছে? এ প্রসঙ্গে আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তাবুক অথবা খায়বরের যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন। ঘরের তাকের ওপর পর্দা ঝুলানো ছিল। বায়ু প্রবাহের ফলে তার এক পাশ সরে যায়, যাতে তার খেলার পুতুলগুলো দৃশ্যমান হয়ে পড়ে। তিনি পুতুলগুলো দেখে বললেন, হে আয়েশা! এগুলো কী? উত্তরে তিনি বললেন, এগুলো আমার মেয়ে। আর তিনি এগুলোর মধ্যে কাপড়ের তৈরি দুই ডানাবিশিষ্ট একটি ঘোড়াও দেখতে পেলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, এগুলোর মধ্যে ওটা কী দেখতে পাচ্ছি? তিনি বললেন, ঘোড়া। নবী করিম (সা.) বললেন, তার ওপর আবার ওটা কী? তিনি বললেন, দুটো পাখা। তিনি বললেন, এ আবার কেমন ঘোড়া, যার পাখা আছে? আমি বললাম, আপনি কি শুনেননি, সুলাইমান (আ.)-এর ঘোড়ার কয়েকটি পাখা ছিল! আয়েশা (রা.) বলেন, একথা শুনে রাসুল (সা.) হেসে দিলেন, যাতে আমি তার সামনের সারির দাঁত দেখতে পেলাম।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৩২)।
স্ত্রীর সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ আচরণ
মা-বাবা, ভাই-বোন ও পরিবার-পরিজন ছেড়ে যখন কোনো মেয়ে স্বামীর গৃহে আসে, তখন সে স্বামীর ভালোবাসার কাঙাল থাকে। শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর চেয়ে বেশি আপন আর কেউ স্ত্রীর থাকে না। এ অবস্থায় স্বামীর কর্তব্য হলো স্ত্রীর সঙ্গে দয়া, মমতা, হৃদ্যতা, আন্তরিকতা ও প্রীতিপূর্ণ আচরণ করা। মহানবী (সা.) তার স্ত্রীদের সঙ্গে দয়া, মমতা, হৃদ্যতা ও প্রীতিপূর্ণ আচরণ করতেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) যদি তার মিসওয়াক দিয়ে মিসওয়াক করতেন, তাহলে তিনি বিষয়টি সমর্থন করতেন ও নীরব থাকতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) মিসওয়াক করে তা ধোয়ার জন্য আমাকে দিতেন। আমি নিজে প্রথমে তা দিয়ে মিসওয়াক করতাম, অতঃপর সেটা ধুয়ে তাকে দিতাম।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৫২)। বিশ্বনবী (সা.) কর্তৃক স্ত্রীর সঙ্গে প্রেমময় ও প্রীতিপূর্ণ আচরণ করার অনন্য নজির হলো, আয়েশা (রা.) ঋতুবতী থাকা অবস্থায় পানি পান করলে পানপাত্রের যে স্থান দিয়ে তিনি পানি পান করতেন মহানবী (সা.)ও সে স্থান দিয়ে পানি পান করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি ঋতুবতী অবস্থায় পানি পান করতাম এবং পরে মহানবী (সা.)-কে অবশিষ্টটুকু প্রদান করলে আমি যেখানে মুখ লাগিয়ে পান করতাম তিনিও পাত্রের সে স্থানে মুখ লাগিয়ে পান করতেন। আবার আমি ঋতুবতী অবস্থায় হাড় খেয়ে তা নবী (সা.) কে দিলে, আমি যেখানে মুখ লাগিয়েছিলাম তিনি সেখানে মুখ লাগিয়ে খেতেন।’ (মুসলিম : ৫৭৯)।
স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, অনুরাগ ও অভিমানের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক আরো গভীর ও নিবিড় হয় যদি স্বামী স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে এবং স্ত্রী স্বামীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে। স্বামী স্ত্রীকে ভালোবাসার কথা বললে এবং স্ত্রী স্বামীকে ভালোবাসার কথা বললে দাম্পত্য জীবন সুখময় ও প্রেমময় হয়। মহানবী (সা.) স্ত্রীদের প্রতি নিজের ভালোবাসা ব্যক্ত করতেন। বিশ্বনবী (সা.)-কে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ হলো প্রিয়তমা আয়েশা। আবু উসমান (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.) আমর ইবনুল আস (রা.)-কে সেনাপতি হিসেবে জাতুস সালাসিল বাহিনীর বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। আমর ইবনুল আস বলেন, ‘যুদ্ধ শেষে আমি মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার কাছে কোন লোকটি অধিকতর ভালোবাসার পাত্র? তিনি উত্তর দিলেন, আয়েশা (রা.)। আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে কে? তিনি বললেন, তার (আয়েশার) পিতা। আমি বললাম, তারপর কে? তিনি বললেন, ওমর (রা.)। এভাবে তিনি পরপর আরো কয়েকজনের নাম বললেন। আমি চুপ হয়ে গেলাম এ ভয়ে যে, আমাকে না তিনি সবার শেষে গণ্য করে বসেন।’ (বোখারি : ৪৩৫৮)।
স্ত্রীর মৃত্যুর পরও ভালোবাসা প্রকাশ
মহানবী (সা.) শুধু জীবিত স্ত্রীদের ভালবাসতেন তা নয়, বরং তিনি মৃত স্ত্রীদেরও ভালোবাসতেন এবং তাদের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতেন। খাদিজা (রা.)-এর মৃত্যুর পর তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে নবী করিম (সা.) তার বান্ধবীদের কাছে বিভিন্ন সময় উপহার প্রেরণ করতেন। এ কারণে আয়েশা (রা.) একদিন উষ্মা প্রকাশ করলে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘আমি খাদিজাকে বড়ই ভালোবাসি। তার ভালোবাসা আমার অন্তরে জায়গা করে নিয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি খাদিজা ছাড়া নবী (সা.)-এর সহধর্মিণীদের আর কারো প্রতি ঈর্ষান্বিত হইনি, অথচ আমার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটেনি। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) যখন বকরি জবাই করতেন তখন বলতেন, এর গোশত খাদিজার বান্ধবীদের পাঠিয়ে দাও। একবার আমি তাকে রাগিয়ে দিলাম ও বললাম, খাদিজাকে এতই ভালবাসেন? রাসুল (সা.) বললেন, তার ভালোবাসা আমার মনে জায়গা করে নিয়েছে।’ (মুসলিম : ৬১৭২)।
স্ত্রীর ভুলত্রুটি ক্ষমা করা
সংসার জীবনে স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে না দেখলে সংসার অনেক সময় অগ্নিগর্ভ ও অশান্তিময় হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু স্বামী এমন আছেন, যারা স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি সহ্য করতে চান না। মহানবী (সা.) এমন ছিলেন না। তিনি স্ত্রীদের ভুলভ্রান্তি সহ্য করতেন। জাতুর রিকার যুদ্ধের সফরে আয়েশা (রা.)-এর অন্যমনস্কতার কারণে তার গলার হার ছিঁড়ে পড়ে যায়। যে স্থানটিতে হার হারায় সেখানে পানি ছিল না এবং বাহিনীর লোকদের সঙ্গেও পানি ছিল না। ফলে পুরো বাহিনীকে চরম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহানবী (সা.) আয়েশা (রা.)-কে বকাবকি বা তিরস্কার করেননি। তিনি বিষয়টি সহ্য করেন এবং বাহিনীর লোকদের নিয়ে হারের সন্ধানে লেগে পড়েন। স্ত্রীর এত বড় ভুল সহ্য করে নেওয়া এবং তাকে শাসন বা তিরস্কার না করা মহানবীর সহনশীল ও প্রেমময় গুণ ছিল। এ ঘটনাটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে এক যুদ্ধের সফরে গিয়েছিলাম, তখন আমার হারটি গলা থেকে ছিঁড়ে পড়ে যায়। হারটি খোঁজার জন্য মহানবী (সা.) সেখানে অবস্থান করেন। এ জন্য সাহাবিরাও তাঁর সঙ্গে সেখানে অবস্থান করেন। সেখানে পানি ছিল না এবং তাদের সঙ্গেও পানি ছিল না। তাই সাহাবিরা আবু বকর (রা.)-এর কাছে এসে বললেন, আপনি কি দেখছেন না, আয়েশা (রা.) কী করলেন? তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.) এবং তার সঙ্গে সাহাবিদের এমন স্থানে অবস্থান করালেন, যেখানে পানি নেই এবং তাদের সঙ্গেও পানি নেই। তখন আবু বকর (রা.) আমার কাছে এলেন। এ সময় আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার উরুর ওপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে বলতে লাগলেন, তুমি আল্লাহর রাসুল (সা.) ও সাহাবিদের এমন এক স্থানে আটকিয়ে রেখেছ, যেখানে পানি নেই এবং তাদের সঙ্গেও পানি নেই। আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি আমাকে অনেক বকাবকি করলেন। এমনকি তিনি হাত দ্বারা আমার কোমরে খোঁচা মারতে লাগলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার উরুর ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকার কারণে আমি নড়াচড়াও করতে পারছিলাম না। এমনি পানি না থাকা অবস্থায় আল্লাহর রাসুল (সা.) সকাল পর্যন্ত ঘুমন্ত থাকলেন। তখন আল্লাহতায়ালা তায়াম্মুমের আয়াত অবতীর্ণ করলেন এবং সবাই তায়াম্মুম করলেন। উসাইদ ইবনু হুযাইর (রা.) বলেন, হে আবু বকর (রা.)-এর পরিবারবর্গ, এটা আপনাদের প্রথম বরকত নয়। আয়েশা (রা.) বলেন, অতঃপর আমরা সে উটটিকে উঠালাম যে উটের ওপর আমি সওয়ার ছিলাম। আমরা হারটি তার নিচে পেয়ে গেলাম।’ (বোখারি : ৩৬৭২)।
স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়া ও খোঁজখবর নেওয়া
কিছু পুরুষ এমন আছেন, যারা কর্মব্যস্ততার দোহাই দিয়ে স্ত্রীকে সময় দেন না ও তার যথাযথ খোঁজ নেন না। কিন্তু মহানবী (সা.) একজন রাষ্ট্রনায়ক, সমরনায়ক, প্রধান বিচারপতি ও ইমামণ্ডকাম খতিব হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীদের প্রয়োজন পরিমাণ সময় দিতেন ও তাদের খোঁজখবর নিতেন। স্ত্রীদের মধ্য থেকে কারো কোনো প্রয়োজন থাকলে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন মহানবী (সা.) আসরের নামাজ শেষ করতেন, তখন নিজ স্ত্রীদের মধ্য থেকে যে কোনো একজনের কাছে গমন করতেন। একদিন তিনি স্ত্রী হাফসা (রা.)-এর কাছে গেলেন এবং সাধারণত যে সময় কাটান তার চেয়ে বেশি সময় কাটালেন।’ (বোখারি: ৫২১৬)।
স্ত্রীর জন্য দোয়া করা
পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হওয়া সত্ত্বেও নবী করিম (সা.) তাঁর স্ত্রীদের সালাম দিতেন। তাদের জন্য দোয়া করতেন এবং যে স্ত্রীর পালা যেদিন আসত, সেদিন তিনি তার কাছে রাত যাপন করতেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) ফজরের নামাজ আদায় করে জায়নামাজে বসতেন। সূর্যোদয় হওয়ার আগ পর্যন্ত তার পাশে লোকেরাও বসে থাকত। এর পর তিনি তার স্ত্রীদের প্রত্যেকের কাছে গমন করে তাদের সালাম দিতেন এবং তাদের জন্য দোয়া করতেন। এর পর যে স্ত্রীর পালার দিন থাকত তার কাছে বসতেন।’ (মুজামে আওসাত-তাবারানি : ৮৭৬৪)।
স্ত্রীকে প্রহার না করা
স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর চলাফেরা খানিক সময়ের নয়, বরং সারা জীবনের। এজন্যই হয়তো স্ত্রীকে পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়। স্বামীর সঙ্গে জীবনযাপন করতে গিয়ে অনেক সময় স্ত্রীর ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এই ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পারা উত্তম পুরুষের পরিচায়ক। কিন্তু অনেক পুরুষ জীবন সাথির ভুলভ্রান্তিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিতে পারে না। পান থেকে চুন খসলেই রাগান্বিত হয়ে প্রিয়তমা স্ত্রীর ওপর হামলে পড়ে। কারণে-অকারণে স্ত্রীকে বকাবকি করতে থাকে এবং অনেক সময় মেজাজ খারাপ করে স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে। কিন্তু বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) কখনো এমন করেননি। তিনি স্ত্রীদের ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতেন। তার জীবনে কোনো স্ত্রীকে কিংবা যুদ্ধের ময়দান ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে প্রহার করার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি কখনো আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে তাঁর কোনো সেবক এবং তাঁর কোনো স্ত্রীকে প্রহার করতে দেখিনি। তিনি আল্লাহর পথে জিহাদরত থাকা ছাড়া কোনো সময় কাউকে প্রহার করেননি।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৫৩৯২)।
স্ত্রীকে সান্ত¡না দেওয়া
নারীদের স্বভাব অত্যন্ত নাজুক ও সংবেদনশীল। তারা অনেক সময় অল্পতেই কাতর হয়ে যায় এবং ক্রন্দন ও বিলাপ করে বুক ভাসায়। এ সময় প্রয়োজন হয় স্ত্রীকে আদর, সোহাগ ও ভালোবাসার সঙ্গে সান্ত¡না দেওয়া। কিন্তু বহু পুরুষ এমন রয়েছে, যারা স্ত্রীর অনুভব-অনুভূতি অনুধাবন করতে সক্ষম হয় না। তবে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) স্ত্রীদের অবস্থা বুঝতে পারতেন। তিনি স্ত্রীদের অনুভব-অনুভূতি গভীরভাবে অনুধাবন করতেন ও তাদের প্রয়োজনীয় সান্ত¡না দিতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) তার কাছে প্রবেশ করলেন। অথচ মক্কায় প্রবেশের আগেই ‘সারিফ’ নামক জায়গায় তার মাসিক শুরু হয়। তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। নবী (সা.) বললেন, ‘তোমার কী হয়েছে? মাসিক শুরু হয়েছে নাকি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। নবী (সা.) বললেন, এটা এমন এক ব্যাপার যা আল্লাহ আদম (আ.)-এর কন্যাদের ওপর নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কাজেই হাজীরা যা করে থাকে, তুমিও তেমনি করে যাও, তবে তুমি বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করবে না।’ (বোখারি : ৫৫৪৮)।
স্ত্রীর চোখে শ্রেষ্ঠ হওয়া
কাছ থেকে দেখে একজন মানুষকে যেভাবে পরখ করা যায়, দূর থেকে দেখে ঠিক সেভাবে পরখ করা যায় না। দূর থেকে বহু মানুষকেই অত্যন্ত ভালো ও শ্রেষ্ঠ মনে হয়। কিন্তু কাছে গেলে অনেক সময় এই ধারণা পাল্টে যায় ও বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। আর মানুষ নিজের জীবনে আপন পরিবার পরিজনের সঙ্গে যত সময় ব্যয় করে; বিশেষত স্ত্রীর সঙ্গে যত সময় অতিবাহিত করে, সাধারণত অন্য কারো সঙ্গে তত সময় অতিবাহিত করে না। অতএব, কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামী শ্রেষ্ঠ ও চরিত্রবান হওয়ার সাক্ষ্য দেয়, তাহলে তার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য ও যথার্থ। মহানবী (সা.) তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও পরিবার পরিজনদের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে বিবেচিত ছিলেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মাঝে সে-ই উত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম। আর আমি আমার পরিবারের কাচে তোমাদের চেয়ে উত্তম।’ (সুনানে তিরমিজি : ৩৮৯৫)।
ঘরের কাজে সহায়তা
রান্নাবান্না করা, ঘরদোর ঝাড়ু দেওয়া ও সন্তান লালনপালনসহ সংসারের বহুবিধ কাজ করতে দিতে গিয়ে একজন স্ত্রীকে অনেক সময় হাঁপিয়ে উঠতে হয়। বহু কষ্ট-ক্লেশ ও পরিশ্রমের সম্মুখীন হতে হয়। এমন সময় যদি জীবনসঙ্গী স্বামী তার স্ত্রীর কাজকর্মে কিছুটা সহায়তা করে, তাহলে তার জন্য সংসারের কাজ সামাল দেওয়া সহজ হয়ে যায়। খুব কম পুরুষই এমন আছে, যারা স্ত্রীকে তাদের ঘরের কাজকর্মে সহায়তা করে থাকে। মহানবী (সা.) ঘরের কাজকর্মে স্ত্রীদের সহায়তা করতেন। তিনি অত্যন্ত কর্মব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও ঘরে থাকা অবস্থায় স্ত্রীদের তাদের কাজে সাহায্য করতেন। আসওয়াদ (রা.) বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, মহানবী (সা.) ঘরে থাকা অবস্থায় কী করতেন? তিনি বলেন, ‘ঘরের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। অর্থাৎ পরিবারকে সহায়তা করতেন। আর নামাজের সময় হলে নামাজের জন্য চলে যেতেন।’ (বোখারি : ৬৭৬)।
স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা
একাধিক বিবাহকারী পুরুষরা সাধারণত তার স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী বা কম বয়সি স্ত্রীর প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এটি ঠিক নয়। স্ত্রীদের মাঝে সমতা রক্ষা করার গুণ থাকলেই তবে বহুবিবাহ করার অনুমোদন আছে ইসলামে। তাই স্ত্রীদের মধ্যে ভরণপোষণ ও রাত যাপনে সমতা করতে না পারার ভয় থাকলে কিংবা সমতা রক্ষা করে চলতে না পারলে একাধিক বিবাহ করতে নিষেধ করেছে ইসলাম। মহানবী (সা.) স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করে চলতেন। তিনি উম্মাহাতুল মোমিনিনদের মধ্য থেকে কাউকে কারো ওপর প্রাধান্য দিতেন না। পালাক্রমে সব স্ত্রীর সঙ্গে রাত যাপন করতেন। কারো সঙ্গে অধিক সংখ্যক রাত যাপন করতেন এবং কারো সঙ্গে কম সংখ্যক রাত যাপন করতেন- এমনটি হতো না। হিশাম ইবনু উরওয়াহ (রহ.) তার পিতার সূত্রে বলেন, ‘আয়েশা (রা.) বলেছেন, হে ভাগনে, রাসুল (সা.) আমাদের সঙ্গে অবস্থানের ব্যাপারে কাউকে কারো ওপর প্রাধান্য দিতেন না। এমন দিন খুব কমই হয়েছে; যেদিন তিনি আমাদের কাছে আসতেন এবং সহবাস না করে সবার সঙ্গে আলাপ করতেন। অতঃপর যার কাছে রাত যাপনের পালা হতো, তিনি সেখানে রাত যাপন করতেন। যখন সাওদা বিনতু যামআ (রা.) বার্ধক্যে পোঁছেন তখন আশঙ্কা করেন যে, রাসুল (সা.) হয়তো তাকে ত্যাগ করবেন, তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আমার পালার দিনটি আয়েশাকে দিলাম। রাসুল (সা.) তার এ প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।’ (সুনানে আবু দাউদ : ২১৩৫)। যদি কোনো ব্যক্তি একাধিক বিবাহ করে, তাহলে তার জন্য অপরিহার্য হলো স্ত্রীদের মধ্যে সমতা রক্ষা করে চলা। স্ত্রীদের সঙ্গে সমতা রক্ষা করে না চলার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ হবে বলে মহানবী (সা.) কঠোর হুঁশিয়ার বাণী উচ্চারণ করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুইজন স্ত্রী থাকা অবস্থায় তাদের একজনের প্রতি ঝুঁকে পড়ল, কেয়ামতের দিন সে পঙ্গু অবস্থায় উপস্থিত হবে।’ (সুনানে আবু দাউদ : ২১৩৩)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১