মহানবীর হজ
হজ মহামহিম আল্লাহর দেয়া এক অনুপম ইবাদত। হজের মাস আসতেই মোমিনের হৃদয়ে ঢেউ তোলে আল্লাহ প্রেমের উত্তাল তরঙ্গ। মহান স্রষ্টার প্রেমের ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবীর দিগ-দিগন্ত থেকে শুভ্র-সফেদ ইহরাম গায়ে জড়িয়ে হাজিরা ছুটে চলেন কালো গিলাফের পরম সান্নিধ্য পেতে। রহমতের অপার বারিধারায় সিক্ত হয়ে মহামহিম রবের তরে হৃদয়-নিলয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দিতে হাজিরা ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। প্রেম নিবেদনের এ মহান ইবাদত যথাযথ পালন করে একজন মোমিন কীভাবে তার রবের সন্তুষ্টির অনন্য উচ্চতায় আরোহণ করতে পারে, তা আমাদের দেখিয়েছেন প্রিয় নবীজি (সা.)। তাঁর হজ পালনের নানা চিত্র হাদিসে উঠে এসেছে। মহানবী (সা.)-এর হজ পালন নিয়ে লিখেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ১৮ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইহরাম
নবীজি (সা.) মদিনার অদূরে যুল হুলাইফা নামক স্থানে ইহরাম বাঁধেন। বিশিষ্ট তাবেয়ি সাঈদ ইবনুল জুবায়ের (রা.) ইবনে আব্বাস (রা.)-এর কাছে নবীজি (সা.)-এর ইহরাম বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি সবচেয়ে ভালোভাবে অবগত। নবীজি (সা.) যুল হুলাইফার মসজিদে দু’রাকাত নামাজ আদায় করে সেখানেই তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে ইহরাম বেঁধেছেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৭৭০)।
তালবিয়া পাঠ
হজের অন্যতম আমল হলো, তালবিয়া পাঠ করা। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.)-এর তালবিয়া ছিল- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ (বোখারি : ১৫৩৯)। (অর্থ : আমি উপস্থিত, হে আল্লাহ আমি উপস্থিত। আমি হাজির (তোমার দরবারে), আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই। নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা, তাবৎ নিয়ামতরাজি এবং নিখিল বিশ্বের রাজত্ব একমাত্র তোমারই। তোমার কোনো শরিক নেই)। নবীজি (সা.) উচ্চ স্বরে তালবিয়া পাঠ করতেন। সাহাবিদেরও পাঠ করতে বলতেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার কাছে জিবরাইল (আ.) এসে আমাকে বলল, যেন আমি আমার সাহাবিদের এবং আমার সঙ্গে থাকা সবাইকে উচ্চ স্বরে তালবিয়া পাঠের নির্দেশ দিই।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৮১৪)। নবীজি (সা.) জামারায় কঙ্কর নিক্ষেপের আগ পর্যন্ত তালবিয়া পাঠ করতে থাকতেন। ফযল ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) বড় জামারায় পাথর নিক্ষেপের আগ পর্যন্ত তালবিয়া পড়তে থাকতেন।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৮১৫)।
তাওয়াফ
হজের অন্যতম আমল হলো, পবিত্র কাবার তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করা। নবীজি (সা.)-ও কাবার তাওয়াফ করেছেন। তিনি মক্কায় প্রবেশের পর প্রথম তাওয়াফ হেঁটে করেন। মদিনায় গিয়ে মুসলমানরা দুর্বল হয়ে গেছে বলে মুশরিকরা খোঁচা দিলে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের জন্য নবীজি (সা.) প্রথম তিন চক্করে রমল (কাঁধ দুলিয়ে বীরদর্পে চলা) করেন। আর সাহাবিদেরও করতে বলেন। (মুসলিম : ১২৬৪)। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) হাজরে আসওয়াদ থেকে পুনরায় হাজরে আসওয়াদ পর্যন্ত তিন চক্কর দ্রুত পদক্ষেপে আদায় করতেন। আর বাকি চার চক্কর স্বাভাবিকভাবে হেঁটে আদায় করতেন।’ (মুসলিম : ১২৬২)। মিনায় পাথর নিক্ষেপের পর ফরজ তওয়াফ নবীজি (সা.) উটনীর ওপর আরোহণ করে আদায় করেন। হাতের লাঠি দ্বারা হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করেন। যাতে মানুষ তাকে ভালোভাবে দেখতে পারে। আর তিনি উঁচুতে ছিলেন। যাতে মানুষ তাকে মাসআলা জিজ্ঞেস করতে পারে। কেননা, তিনি তখন লোকদের বেষ্টনীর মধ্যে ছিলেন। (মুসলিম : ২৯৪০)।
সাফা-মারওয়ায় সায়ি
জাবের (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) সাফার কাছাকাছি হয়ে আয়াত তেলাওয়াত করলেন, ‘নিশ্চয়ই সাফা এবং মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা বাকারা : ১৫৮)। এরপর বললেন, ‘মহান আল্লাহ যার কথা প্রথমে বলেছেন, আমরাও প্রথমে এর সায়ি করব।’ এ কথা বলে নবীজি (সা.) সাফা পাহাড়ে আরোহণ করলেন। সেখান থেকে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে আল্লাহর একত্ব ও মাহাত্ম্য ঘোষণা করলেন। বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইইন কাদির। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু, আনজাযা ওয়াদাহু ও নাসারা আবদাহু, ওয়া হাযামার আহযাবা ওয়াহদাহু।’ (অর্থ : আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক; তাঁর কোনো শরিক নেই। তাঁর জন্য রাজত্ব এবং তাঁর জন্যই সব প্রশংসা। তিনি প্রতিটি জিনিসের ওপর শক্তিমান। আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তিনি এক। তিনি নিজের প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন। তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন। শত্রু বাহিনীকে একাই পরাস্ত করেছেন)। তিনি এ দোয়া তিনবার বললেন। এর পর সেখান থেকে নেমে মারওয়া পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হলেন। সমতল ভূমিতে অবতরণ করে (বাতনে বাসিল নামক স্থানে, যা বর্তমানে সবুজ বাতি দ্বারা চিহ্নিত করা) উপত্যকা অতিক্রম করা পর্যন্ত দ্রুত গতিতে চললেন। এর পর মারওয়া পাহাড়ে হেঁটে চড়লেন। অতঃপর এখানেও সাফা পাহাড়ে যা করেছিলেন, তা করলেন। (মুসলিম : ২৮২১)।
আরাফায় অবস্থান
জাবের (রা.) বলেন, তারবিয়ার দিন (৮ জিলহজ) রাসুল (সা.) তাঁর বাহনে আরোহণ করে মিনায় জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের সালাত আদায় করতেন। সূর্য ওঠা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করতেন। নামিরা নামক স্থানে গিয়ে তাঁর জন্য একটি তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দিতেন। আরাফার দিকে রওনা হয়ে যেতেন। কোরাইশরা মনে করত, রাসুল (সা.) মাশআরুল হারামের কাছে অবস্থান করবেন, যেখানে জাহেলি যুগে কোরাইশরা অবস্থান করত। কিন্তু তিনি সামনে এগিয়ে আরাফায় পৌঁছান। দেখতে পান নামিরায় তার জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। তিনি এখানে অবতরণ করলেন। তারপর যখন সূর্য ঢলে পড়ল, তখন তিনি তাঁর কাসওয়া নামক উটনীকে প্রস্তুত করার নির্দেশ দিলেন। তার পিঠে হাওদা লাগানো হলো। তখন তিনি বাতনে ওয়াদিতে এলেন। লোকদের উদ্দেশে (বিদায় হজের ঐতিহাসিক) ভাষণ দিলেন। (ভাষণের পর আজান দেয়া হলো এবং ইকামত দিয়ে জোহর পড়লেন। এরপর আবার ইকামত দিয়ে আসর পড়লেন। এ দুই নামাজের মাঝে অন্য কোনো নামাজ পড়েননি। সূর্যাস্ত পর্যন্ত এভাবে অবস্থান করলেন। হলদে আভা কিছু দূর হয়ে যখন সূযের্র গোলক সম্পূর্ণ অদৃশ্য হলো, তখন তিনি উসামা (রা.)-কে তাঁর বাহনের পেছন দিকে বসিয়ে মুজদালিফার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। (মুসলিম : ২৮২১)।
মুজদালিফায় অবস্থান
জাবের (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) মুজদালিফায় পৌঁছে একই আজানে ও দুই ইকামতে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করলেন। এ দুই নামাজের মাঝে অন্য কোনো নফল নামাজ আদায় করেননি। এর পর নবীজি (সা.) ফজর পর্যন্ত ঘুমালেন। ভোর হয়ে গেলে তিনি আজান ও ইকামতসহ ফজরের নামাজ আদায় করলেন। অতঃপর কাসওয়ার পিঠে আরোহণ করে মাশআরুল হারাম নামক স্থানে এলেন। এখানে তিনি কেবলামুখী হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন। কালেমায়ে তাওহিদ পড়লেন। তাঁর একত্ব ঘোষণা করলেন। দিনের আলো উজ্জ্বল না হওয়া পর্যন্ত তিনি এভাবেই কাটিয়ে দিলেন। (মুসলিম : ২৮২১)।
মিনায় গমন ও কঙ্কর নিক্ষেপ
এরপর রাসুল (সা.) মিনায় আসতেন। জামরায় এসে পাথর নিক্ষেপ করতেন। অতঃপর তিনি মিনায় নিজ স্থানে ফিরে এসে কোরবানি করতেন। হাজ্জাম (ক্ষৌরকার)-কে ইশারায় বলতেন, ‘প্রথমে ডান পাশ, পরে বাম পাশ মু-ন করো।’ অতঃপর তিনি লোকদের নিজের চুল দান করতেন। (মুসলিম : ৩০৪৩)। নবীজি (সা.) কোরবানির দিন সূর্য হেলে যাওয়ার আগে এবং কোরবানির পরের তিন দিন সূর্য হেলে যাওয়ার পর কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। প্রথমে ছোট জামরায়, এর পর মাঝারিটায় এবং সবশেষে জামরায়ে আকাবা (বড়)-তে কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। জাবের (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) কোরবানির দিন সূর্য হেলে যাওয়ার আগে এবং কোরবানির পরের তিন দিন সূর্য হেলে যাওয়ার পর কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। (মুসলিম : ১২৯৭)। ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.) মসজিদে মিনার দিক থেকে প্রথমে অবস্থিত জামারায় সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন। প্রতিটি কঙ্কর মারার সময় তিনি তাকবির বলতেন। এর পর সামনে এগিয়ে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে হাত তুলে দোয়া করতেন। এখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন। অতঃপর দ্বিতীয় জামারায় এসে সাতটি কঙ্কর মারতেন। প্রতিটি কঙ্কর মারার সময় তাকবির বলতেন। তারপর বাঁ-দিকে মোড় নিয়ে ওয়াদির কাছে এসে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়াতেন। হাত তুলে দোয়া করতেন। অবশেষে আকাবার কাছে জামারায় এসে তিনি সাতটি কঙ্কর মারতেন। প্রতিটি কঙ্কর মারার সময় তাকবির বলতেন। এর পর ফিরে যেতেন। এখানে বিলম্ব করতেন না। (বোখারি : ১৭৫৩)।
তাওয়াফে জেয়ারত
নবীজি (সা.) কোরবানির দিন মিনা থেকে মক্কায় এসে তাওয়াফে জেয়ারত তথা মূল তাওয়াফ আদায় করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘নবীজি (সা.) কোরবানির দিন মিনা থেকে মক্কায় এসে তাওয়াফে জেয়ারত তথা মূল তাওয়াফ আদায় করতেন। এর পর মিনায় গিয়ে জোহর আদায় করতেন।’ (মুসলিম : ১৩০৮)।