ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিদায় হজের ভাষণে মানবতার উন্মেষ

মুফতি দিদার শফিক
বিদায় হজের ভাষণে মানবতার উন্মেষ

দশম হিজরি সনে মহানবী (সা.) সর্বশেষ হজ পালন করেন। হজের উদ্দেশ্যে সমবেত দেড় লাখ সাহাবিকে সম্বোধন করে মহানবী (সা.) এ বছর জিলহজ মাসের ৯ তারিখে আরাফার ময়দানে যে ভাষণ দেন, ইতিহাসে তা বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে পরিচিত। বিদায় হজের ভাষণ মানবতার মুক্তির সনদ হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। বিদায় হজের ভাষণের প্রতিটি বাক্যে মানবতা ও জনকল্যাণের কথা বিধৃত হয়েছে।

কী ছিল ভাষণে

‘হে মানবসকল, আল্লাহর কসম, আমি জানি না আজকের পর আর কোনোদিন তোমাদের সঙ্গে এ স্থানে সমবেত হতে পারব কি-না। আল্লাহ রহম করুন ওই ব্যক্তির ওপরে যে ব্যক্তি আজকে আমার কথা শুনবে ও মনে রাখবে। কেননা অনেক জ্ঞানের বাহক নিজে জ্ঞানী নয় (সে অন্যের কাছে জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়) এবং অনেক জ্ঞানের বাহক তার চেয়ে অধিকতর জ্ঞানীর কাছে জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়। তোমরা জেনে রেখ, নিশ্চয়ই তোমাদের মাল-সম্পদ ও তোমাদের রক্ত তোমাদের পরস্পরের ওপরে হারাম, যেমন আজকের এ দিন, এ মাস, এ শহর তোমাদের জন্য হারাম।’ (অর্থাৎ এর সম্মান নষ্ট করা হারাম)। তোমরা জেনে রেখ, তিনটি বিষয়ে মোমিনের অন্তর খেয়ানত করে না : ১. আল্লাহর উদ্দেশ্যে ইখলাসসহ কাজ করা। ২. শাসকদের জন্য কল্যাণ কামনা করা এবং ৩. মুসলমানদের দলবদ্ধতাকে আঁকড়ে ধরা। কেননা তাদের দোয়া তাদেরকে পেছন থেকে (শয়তানের প্রতারণা থেকে) রক্ষা করে।’ (দারেমি : ২২৭)।

৯ জিলহজ সূর্য ঢলে যাওয়ার পর মহানবী (সা.) বলেন, ‘শুনে রাখ, জাহেলি যুগের সব কিছু আমার পদদলিত হলো। জাহেলি যুগের সব রক্তের দাবি পরিত্যক্ত হলো। আমাদের রক্তগুলোর প্রথম যে রক্তের দাবি আমি পরিত্যাগ করছি, তা হলো রাবিয়াহ ইবনুল হারেছ বিন আব্দুল মুত্তালিবের শিশু পুত্রের রক্ত। যে তখন বনু সা’দ (অন্য বর্ণনায় বনু লাইছ। ইবনু হিশাম ২/৬০৪) গোত্রে দুধ পান করছিল, আর হোযাইল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল। জাহেলি যুগের সব সুদ বাতিল ও পরিত্যক্ত হলো। আমাদের সুদগুলোর প্রথম যে সুদ আমি শেষ করে দিচ্ছি তা হলো (আমার চাচা) আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের পাওনা সুদ। যার পুরোটাই বাতিল করা হলো। হে লোকসকল, তোমরা স্ত্রীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাদের আল্লাহর আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে তাদেরকে হালাল করেছ। তাদের ওপরে তোমাদের প্রাপ্য অধিকার হলো, তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে আসতে দেবে না, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা সেটা করে, তবে তোমরা তাদের হালকা প্রহার কর। আর তোমাদের ওপরে তাদের প্রাপ্য অধিকার হলো, তাদেরকে তোমরা উত্তমভাবে খাদ্য ও পরিধেয় বস্ত্র প্রদান করা। হে লোকসকল, জেনে রাখ, আমি তোমাদের মাঝে রেখে যাচ্ছি এমন এক বস্তু, যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। আর সেটি হলো আল্লাহর কিতাব। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ও তাঁর নবীর সুন্নাহ।’ (মুওয়াত্তা : ৩৩৩৮)।

মহানবী (সা.) বলেন, ‘মুসলিম তো সে-ই, যার মুখ ও হাত থেকে অন্যরা নিরাপদ থাকে। আর মুজাহিদ তো সে-ই, যে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করে এবং মুহাজির তো সে-ই, যে সব ধরনের অন্যায় ও পাপকর্ম বর্জন করে।’ (আহমাদ : ২৪০০৪, সহি ইবনু হিব্বান : ৪৮৬২)।

‘মনে রেখ, আমি তোমাদের সবার আগেই হাউসে কাউছারে পৌঁছে যাব। আর আমি অন্যসব উম্মতের মধ্যে তোমাদের আধিক্য নিয়ে গর্ব করব। অতএব তোমরা আমার চেহারাকে কালিমালিপ্ত কর না। মনে রেখ, আমি অনেককে সেদিন মুক্ত করব এবং অনেকে সেদিন আমার দায় থেকে মুক্ত হয়ে যাবে।’ তখন আমি বলব, ‘হে আমার প্রতিপালক! এরা তো আমার সাথি। তিনি বলবেন, তুমি জান না তোমার পরে এরা (ইসলামের মধ্যে) কত বিদাত সৃষ্টি করেছিল।’ (ইবনু মাজাহ : ৩০৫৭)। মহানবী (সা.) বলবেন, ‘দূর হও দূর হও! যে ব্যক্তি আমার পরে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছ।’ (মেশকাত : ৫৫৭১)। ‘মনে রেখ, অপরাধের শাস্তি অপরাধী ছাড়া অন্যের ওপরে বর্তাবে না। পিতার অপরাধের শাস্তি পুত্রের ওপর এবং পুত্রের অপরাধের শাস্তি পিতার ওপর বর্তাবে না।‘ ‘জেনে রেখ, শয়তান তোমাদের এ শহরে পূজা পাওয়া থেকে (অর্থাৎ তোমাদের কাফের হওয়া থেকে) চিরদিনের মতো নিরাশ হয়ে গেছে। তবে যেসব কাজকে তোমরা তুচ্ছ মনে কর, সেসব কাজে তার আনুগত্য করা হবে, আর তাতেই সে খুশি থাকবে।’ (তিরমিজি : ২১৫৯, ইবনে মাজাহ : ৩০৫৫)। ‘মনে রেখ! এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই। অতএব কোনো মুসলমানের জন্য তার ভাইয়ের কোনো বস্তু হালাল নয় শুধু অতটুকু ছাড়া, যতটুকু সে তাকে খুশি মনে দেয়। আর তোমরা জুলুম কর না...।’ (ইরওয়া : ১৪৫৯)।

আরাফার দিন শুক্রবার সন্ধ্যার শুরুতে ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার সনদ দিয়ে আল্লাহতায়ালা সুরা মায়েদার ৩ নং আয়াতটি নাজিল করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে (চির দিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম।’

ভাষণ থেকে শিক্ষা

১. ব্যবসা-বাণিজ্যে সুদি লেনদেন করা যাবে না। সুদ পরিপূর্ণভাবে বর্জন করতে হবে। অর্থনীতিতে সুদের প্রয়োগ গোনাহের কাজ, তাই তা বর্জন করে চলতে হবে। ২. স্ত্রীকে তার ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। আচরণে, খাবারে ও পোশাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। ৩. একজনের পাপের দায় বা বোঝা অন্যজনের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না, যেমনটা আজকাল মিথ্যা মামলা-মকদ্দমায় হয়ে থাকে, তা বর্জনীয়। ৪. কোরআন-হাদিসে নেই এমন বিষয় যা বিদাত নামে পরিচিত, তা পরিহার করে চলতে হবে। ৫. শয়তানের পূজা-অর্চনা করা যাবে না। ৬. হাতে বা মুখের কথায় কাউকে আঘাত করা যাবে না। ৭. যাবতীয় পাপ কাজ বর্জন করতে হবে এবং সর্ববিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করতে হবে। ৮. মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে শিশু অপহরণ ও হত্যা নিষিদ্ধ। পাপের কাজ। ৯. সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ মেনে চলতে হবে। ১০. জাহেলি যুগের সভ্যতাসহ বর্বোরোচিত সব ধরনের আচরণ ও কাজ পরিহার করে রাসুলের দেখানো পথে জীবনযাপন করতে হবে। এছাড়া আরো অনেক জনকল্যাণকর উপদেশ আছে মহানবীর বিদায় হজের দীর্ঘ ভাষণে, যা একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কার্যকর ও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে। কেউ যদি চলার পথে অন্তত মহানবী (সা.) এর বিদায় হজের ভাষণকে মেনে চলে, সে দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। একজন ব্যক্তি মানবিক হওয়ার এবং আল্লাহর অনুগত প্রিয় বান্দা হওয়ার পর্যাপ্ত খোরাক ও রসদ পাবে মহানবীর বিদায় হজের ভাষণে নিঃসন্দেহে, যা তাকে গভীর উপলব্ধিলব্ধ পরম সুখ ও মনুষ্য জীবনের কাঙ্ক্ষিত নির্মল আনন্দ দেবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত