সবাই শান্তি চায়। সে শান্তির বার্তা নিয়েই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার মহানায়ক ছিলেন তিনি। মহানবীর আগমন না হলে পৃথিবীর ইতিহাস হতো ভয়ংকর। এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী গ্রাস করে রাখত আমাদের। অজ্ঞতা ও অশান্তির আঁধার ঘনীভূত হতে হতে পাশবিকতায় ছেয়ে যেত পৃথিবী। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, পৃথিবী নবী যুগ থেকে যত দূরে সরে যাচ্ছে, ততই অশান্ত হয়ে উঠছে। বস্তুতান্ত্রিক উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে আরোহণ করেও ধীরে ধীরে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে পৃথিবী। মানুষের সমাজগুলোতে পাশবিকতা ছেয়ে যাচ্ছে। ভালো মানুষরা আস্তে আস্তে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
থেকে দেড় হাজার বছর আগের পৃথিবী এর চেয়েও ভয়াবহ ছিল। কোথাও কোনো আলোর ছিটেফোঁটা ছিল না। প্রকৃত সত্য দুনিয়া থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র অশান্তির ছায়া নেমে এসেছিল।
সেই অশান্ত পৃথিবীতে শান্তির আবে হায়াত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের মহানবী মুহাম্মদ (সা.)। এ জন্যই আল্লাহতায়ালা বলেছেন- ‘আমি আপনাকে জগতগুলোর জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)।
নবুওয়াতপূর্ব জীবনে শান্তি প্রচেষ্টা
তৎকালীন অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব সমাজের নানা অরাজকতা বাল্যকাল থেকেই নবীজিকে ব্যথিত করে তুলেছিল। মানুষের জানমালের নিরাপত্তাহীনতা, ইজ্জত-সম্মানের ওপর মারাত্মক আঘাত নবীজিকে অস্থির করে তুলেছিল। তাই কিশোর বয়সেই তিনি সমমনা চিন্তাশীল মানুষদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন হিলফুল ফুজুল নামক সামাজিক সংঘ। এর মাধ্যমে তিনি বহিরাগতদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান, মা-বোনদের ইজ্জত আবরুর হেফাজত, ঋণগ্রস্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ সামাজিক শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় নানামুখী অবদান রেখেছেন।
মক্কি জীবনে শান্তি প্রচেষ্টা
তৎকালীন বিশ্ব আদর্শিকভাবে একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। অনুকরণীয় কোনো মতাদর্শ তখন পৃথিবীতে ছিল না। ফলে আদর্শ মানুষও তখন বিদ্যমান ছিল না। তাই আল্লাহতায়ালা মানবতার মুক্তির দিশা দিয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে নবুয়ত দান করেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শ আল- কোরআন অবতীর্ণ করার মাধ্যমে মানব জাতিকে এক মহাদৌলতে ভূষিত করেন। মহানবী (সা.) সেই সুমহান আদর্শের ধারকবাহক হয়ে প্রথমেই ব্যক্তি গঠনে মনোনিবেশ করেন। কারণ, একটি শান্তিপূর্ণ আদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রের মূলভিত্তি হলো আদর্শ মানুষ। আদর্শ মানুষ না থাকলে কখনও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তাই মক্কি জীবনের ১৩ বছর নবীজি (সা.) ব্যক্তি ও পরিবার গঠনে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেন। সর্বপ্রথম তিনি মানুষকে মানুষের গোলামি থেকে বের করে এক আল্লাহর আনুগত্যে অভ্যস্ত করেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ মুছে দেন। মানুষের মন থেকে জাহেলি সমাজের নানা কুসংস্কার ও অনাচার দূর করে ইসলামের সুমহান আদর্শের বীজবপন করেন। এভাবে তিলে তিলে তিনি অন্ধকার পৃথিবীকে নতুন রূপে আলোকিত পৃথিবী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য একদল আদর্শ মানুষ গড়ে তোলেন, যাদের নিয়ে তিনি পরবর্তীকালে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন। মক্কি জীবনে তিনি যে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার ভিত্তিমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তা জাফর বিন আবু তালেব (রা.) এর ভাষণ থেকে স্পষ্টতই বুঝে আসে। তিনি আবিসিনিয়ার শাসক নাজাশির সামনে নবীজির দাওয়াতি কার্যক্রমের যে বিবরণ তুলে ধরেছিলেন তা সংক্ষেপে নবীজির সংস্কার কাজের অসাধারণ বিবরণ ছিল। তার বক্তব্যের কিছু অংশ ছিল এমন-
‘হে বাদশাহ, আমরা মূর্খ ছিলাম। মূর্তি পূজা করতাম। মৃত প্রাণী ভক্ষণ করতাম। অশ্লীলতায় লিপ্ত ছিলাম। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতাম। প্রতিবেশীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করতাম। আমাদের সবলরা দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করত। এমতাবস্থায়, আমাদের কাছে আল্লাহ পাক একজন রাসুল পাঠালেন। আমরা তার বংশ পরিচয়, সততা, আমনদারি ও উঁচু ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অবগত ছিলাম। তিনি আমাদের দাওয়াত দিলেন, আমরা যেন এক আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করি এবং তার ইবাদত করি। আমরা এবং আমাদের বাপ-দাদারা যেসব মূর্তি ও পাথরের পূজা করতাম তা যেন ছেড়ে দিই। তিনি আমাদের আদেশ দিলেন, ‘যেন আমরা সত্য কথা বলি, আমানত রক্ষা করি, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখি, প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো আচরণ করি, রক্তপাত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে বিরত থাকি। তিনি আমাদের নিষেধ করলেন, অশ্লীলতা থেকে, মিথ্যা থেকে, মৃতপ্রাণী ভক্ষণ করা থেকে, সতী নারীর ওপর অপবাদ আরোপ করা থেকে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৭৪০)। মহানবী (সা.) অশান্ত পৃথিবীতে এসে শান্তির পৃথিবীর ভিত গড়েছিলেন, তা আমরা ওপরের বর্ণনা থেকে বুঝতে পারি।
মদিনায় শান্তি প্রচেষ্টা ও মদিনা সনদ
পৃথিবীতে পরিপূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। তাই তিনি মদিনায় একটি আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। আর এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ ছিল রাষ্ট্রের অধিবাসীদের জানমাল ও ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা বিধান করা। তাই তিনি মদিনার সব গোত্র ও ধর্মের লোকদের সমন্বয়ে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ইতিহাসে মদিনা-সনদ হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি ছিল প্রথম লিখিত ও কার্যকর সংবিধান। রাষ্ট্রীয়ভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রথম ও অনন্য দৃষ্টান্ত। মদিনাকেন্দ্রীক নতুন রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে তা বিস্তারিতভাবে ৫৩টি ধারায় বিবৃত হয়েছে এই সংবিধানে। মদিনার ঐতিহাসিক দুই গোত্র আওস ও খাজরাজদের মাঝে প্রায় ১২০ বছর ধরে চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল মহানবী (সা.)-এর হাত ধরে। যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা এ যুদ্ধের অবসান ঘটা ছিল এক ঐতিহাসিক যুগান্তকারী ঘটনা এবং তৎকালীন আরবে শান্তি প্রতিষ্ঠার অনন্য নজির।
হুদাইবিয়ার শান্তিচুক্তি
পৃথিবীর ইতিহাসে শান্তি চুক্তির অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে জ্বলজ্বল করছে ঐতিহাসিক হুদাইবিয়ার সন্ধি। ১০ বছরের জন্য কুরাইশদের সঙ্গে যে যুদ্ধ বন্ধের চুক্তি নবীজি স্বাক্ষর করেছিলেন, তা তখনকার আরব সমাজে এক ধরনের অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কারণ এ চুক্তির ধারাগুলো বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্য এতটাই অসম ও অপমানজনক ছিল, কোনো সাহাবিই এ চুক্তিতে রাজি হতে চাননি। এমনকি ওমর (রা.) এক পর্যায়ে বলে উঠেছিলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমরা কি সত্যের ওপর নেই? এবং আমাদের শত্রুরা কি মিথ্যার ওপর নয়? তাহলে কেন আমরা দ্বীনের ক্ষেত্রে এ অপমান সহ্য করব?’ (বোখারি : ২৭৩১)। কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের আদেশ হিসেবে পরে সবাই এ চুক্তি মেনে নিয়েছিলেন। মহান আল্লাহপাক এ চুক্তিকে সুস্পষ্ট বিজয় আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি।’ (সুরা ফাতহ : ১)। হুদাইবিয়ার সন্ধিতে আরবের গোত্রীয় অহং, মানুষের স্বভাবজাত ক্রোধ, মানব মনের আকাঙ্ক্ষা সবকিছুকে একমাত্র আল্লাহর আদেশে বিসর্জন দেয়ার নজির স্থাপিত হয়েছে। ইসলাম যে কোনোভাবেই রক্তপাত ও প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, বরং শুধু সত্য প্রতিষ্ঠা এবং সবাই মিলে সত্যকে আঁকড়ে ধরে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তা পূর্ণ মাত্রায় প্রকাশিত হয়েছে হুদায়বিয়ার সন্ধিতে।
মক্কা বিজয় ও রক্তপাতহীন যুদ্ধ
মক্কা বিজয় ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে শান্তির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত। যে মক্কাবাসী দীর্ঘ ১৩টি বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে নবীজি ও সাহাবিদের ওপর বর্বরোচিত অত্যাচার চালিয়েছে, মদিনায় হিজরতের পরও ৮ বছর পর্যন্ত ইসলামকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য যুদ্ধের পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। জীবনের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে যারা ইসলামকে মিটিয়ে দিতে চেয়েছে, সেই তাদের ওপরই যখন নবীজির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলো, তখন তিনি যে ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন তা শুধু ‘রাহমাতুল্লিল আলামিনে’র পক্ষেই সম্ভব। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আজ তোমাদের ওপর আমার কোনো আক্রোশ নেই। তোমরা সবাই স্বাধীন।’ অথচ এই মানুষগুলোই তার চাচাকে হত্যা করেছে, তার প্রাণাধিক প্রিয় শত শত সাহাবিকে হত্যা করেছে। এর চেয়ে বড় শান্তির নজির আর কী হতে পারে?
তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, নবীজি কখনও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মিথ্যার সঙ্গে আপস করেননি। শান্তির নামে মিথ্যাকে মেনে নেয়া বা অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা কোনোভাবেই শান্তি প্রচেষ্টা হতে পারে না, বরং এটা আরও অশান্তির দ্বার উন্মোচন করে দেয়ার নামান্তর। আমরা নবীজির জীবনী গভীরভাবে পাঠ করলে এই সত্য সুস্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করতে পারব। নবীজি সত্য প্রতিষ্ঠায় ছিলেন সুদৃঢ় পাহাড়ের মতো। তিনি আদর্শিক প্রশ্নে কখনও কাউকে ছাড় দিতেন না। ব্যক্তিগত স্বার্থের ক্ষেত্রে তিনি সর্বোচ্চ ছাড়ের নজির স্থাপন করেছেন। সত্য প্রতিষ্ঠাই মূলত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মিথ্যা ও অন্যায়ের সঙ্গে আপস কখনও সমাজে শান্তির বার্তা বয়ে আনতে পারে না।
শান্তি প্রতিষ্ঠায় নবীজির চিরন্তন বাণী
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নবীজির অসংখ্য বাণী পৃথিবীকে শান্তির পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। নবীজির রেখে যাওয়া দৃষ্টান্ত ও কথামালা যুগে যুগে হাজারো দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছে। তিনি বলেছেন, কোনো অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। (মুসনাদে আহমদ : ২৩৪৮৯)। এভাবে তিনি পৃথিবীর সব গোত্রীয় ও জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছেন। পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় নবীজিই ছিলেন সর্বোচ্চ অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম (তিরমিজি : ৩৮৯৫)।
সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানের ক্ষেত্রেও তার অমেয় বাণী প্রতি মুহূর্তে আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে কাজ করছে। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলিম তো সে ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে।’ (বোখারি : ১০)। তিনি আরও বলেন, ‘যে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে অথচ তার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে, সে মোমিন হতে পারে না। (আল মুসতাদরাক : ২১৬৬)। মহানবী (সা.) তার জীবন দিয়ে সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তার জীবনচরিত ও অসংখ্য বাণী কেয়ামত পর্যন্ত মানুষকে শান্তি প্রতিষ্ঠার সঠিক পথ দেখাবে।