বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) যখন এই ধরাপৃষ্ঠে আগমন করেন তখন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে সুবিচার বলতে কিছুই ছিল না। মানুষে মানুষে হানাহানি, মারামারি ও খুনোখুনি লেগেই থাকত। নানা অন্যায়, অনাচার ও অপরাধ সংঘটিত হতো। কেউ কারও ওপর অত্যাচার, নির্যাতন, জুলুম ও নিপীড়ন করলে এর সুবিচার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। সুবিচার করার মতো মন-মানসিকতা লোকের মধ্যে বিদ্যমান ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে মুহাম্মদ (সা.) যখন ধরাধামে আগমন করেন, তখন চোখ মেলে পৃথিবীর এই নৈরাজ্যকর অবস্থা প্রত্যক্ষ করেন। অসহায় বিশ্বমানবতার জন্য তার হৃদয় ব্যথিত ও মর্মাহত হয়ে ওঠে! তার আঁখিযুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। তিনি বিশ্ব মানবতাকে এ কঠিন দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য দৃঢ়সংকল্পে আবদ্ধ হন।
নবীজিকে সুবিচারের নির্দেশ
মহান আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। তিনি এমন বিধানই শুধু নাজিল করেছেন যেগুলো ইনসাফপূর্ণ ও ন্যায়ানুগ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইনসাফপূর্ণ বিষয়াদি নাজিল করেই শুধু ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি রাসুলে আকরাম (সা.) কেও তার নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী সুবিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি আদেশ করছি, আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারগুলোতে আল্লাহ যা নাজিল করেছেন, সে অনুযায়ী বিচার করুন; তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না এবং তাদের থেকে সতর্ক থাকুন- যেন তারা আপনাকে এমন কোনো নির্দেশ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ আপনার প্রতি নাজিল করেছেন।’ (সুরা মায়েদা : ৪৯)। মুসলিম সমাজে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে মহানবী (সা.) ঈমানদারদের আল্লাহতায়ালার এ বাণী শুনিয়ে দিয়েছেন, ‘হে মোমিনরা, তোমরা আল্লাহর উদ্দেশে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ কর না। সুবিচার করো, এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী।’ (সুরা মায়েদা : ০৮)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশনা অনুযায়ী সুবিচার করে এবং তার অনুসারী লোকদের সুবিচার করার ঐশী নির্দেশনা জানিয়ে দিয়ে মহানবী (সা.) বিশ্বজুড়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথ মসৃণ করেছেন।
নবীজির সুবিচার
বহুবিধ ব্যস্ততা সত্ত্বেও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখা দিলে মহানবী (সা.) তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিতেন। একবার দুইজন সাহাবির মধ্যে পানি সিঞ্চন নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যে দু’জন সাহাবিকলহে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তাদের একজন মহানবী (সা.)-এর ফুফাতো ভাই ছিলেন। স্বজনপ্রীতি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদের জন্য এমন রায় প্রদান করেন, যার মধ্যে আনসারির কিছুটা সুবিধা ছিল। কিন্তু আনসারি নিজের সুবিধার বিষয়টি বুঝতে না পেরে উল্লিখিত রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। এতে মহানবী (সা.) রাগান্বিত হন এবং ঐশী নির্দেশনা অনুযায়ী পূর্ববর্তী রায় পরিবর্তন করেন। এতে আনসারির সুবিধা তিরোহিত হয়। যুবাইর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক আনসারির সঙ্গে বিবাদ করেছিলেন, যিনি বদরে শরিক ছিলেন। তিনি আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে প্রস্তরময় জমিনের একটি নালা সম্পর্কে অভিযোগ করলেন। তারা উভয়ে সে নালা থেকে পানি সিঞ্চন করতেন। তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) যুবাইরকে বললেন, ‘হে যুবাইর! তুমি প্রথমে পানি সিঞ্চন করবে। অতঃপর তোমার প্রতিবেশীর দিকে পানি ছেড়ে দেবে।’ আনসারি তখন রেগে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! সে আপনার ফুফুর ছেলে হওয়ার কারণে?’ এতে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর চেহারার রং বদলে গেল। অতঃপর তিনি বললেন, ‘তুমি সেচ করো, অতঃপর পানি আটকে রাখ, বাঁধ বরাবর পৌঁছা পর্যন্ত’। আল্লাহর রাসুল (সা.) যুবাইর (রা.)-কে তার পূর্ণ হক দিলেন। এর আগে যুবাইর (রা.)-কে তিনি এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন যা আনসারির জন্য সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু আনসারি আল্লাহর রাসুলকে রাগান্বিত করলে সুস্পষ্ট নির্দেশের মাধ্যমে যুবাইর (রা.)-কে তিনি তার পূর্ণ হক দান করলেন।’ (বোখারি : ২৭০৮)।
ন্যায় বিচারক নবী
পৃথিবীর কোনো ব্যক্তি যদি কথা বলে, তাহলে তা মিথ্যা হতে পারে। মানুষের কথায় মিথ্যার লেশ ও সম্ভাবনা থাকতে পারে। কিন্তু মহান প্রতিপালক আল্লাহর কথায় মিথ্যার সামান্যতম সন্দেহ, সংশয় ও লেশ নেই। সেই সত্যবাদী মহামহিম আল্লাহ আল কোরআনে মহানবী (সা.)-কে ন্যায়বিচারক উপাধিতে ভূষিত করেছেন। যদি কোনো ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে ন্যায়বিচারক বলে বিশ্বাস না করে, তাহলে সে কাফের ও বেঈমান হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নেবে।’ (সুরা নিসা : ৬৫)।
সুবিচারের শপথ গ্রহণ
যদি কোনো সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি মাথাছাড়া দিয়ে উঠে, তাহলে অন্যায়কারীরা বেপরোয়াভাবে ও দাম্ভিকতার সঙ্গে অন্যায় অপরাধ চালিয়ে যায়। তারা যে কোনো অন্যায় কর্ম আঞ্জাম দিতে কোনো ধরনের ভয় ও শঙ্কা বোধ করে না। অপরাধ করার আগে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার ভয় তাদের মধ্যে জাগ্রত হয় না। অপরাধীদের সদম্ভ তৎপরতায় সমাজের সর্বত্র অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। ইসলামি সমাজ যেন এমন নৈরাজ্যকর অবস্থার সম্মুখীন না হয়, তাই আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামের কাছ থেকে ইনসাফপূর্ণ কথা বলা ও সুবিচার করার শপথ গ্রহণ করেছিলেন। উবাদা ইবনু সামিত (রা.) বলেন, আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অনুকূল-প্রতিকূল এবং সুখণ্ডদুঃখ সর্বাবস্থায় শ্রবণ ও আনুগত্য প্রদর্শনের বাইআত করলাম। সঙ্গে সঙ্গে এ কথারও শপথ নিলাম যে, আমরা আমাদের শাসকের সঙ্গে বিরোধ করব না এবং আমরা যেখানেই থাকি না কেন, ন্যায়ানুগ কথা বলব। আর আল্লাহতায়ালার ব্যাপারে কোনো তিরস্কারকারীর তিরস্কারে ভয় করব না।’ (সুনানে নাসায়ি : ৪১৫৩)।
আদালতে মিথ্যা বলতে নিষেধকরণ
বিশ্বনবী (সা.) শুধু নিজে সুবিচার করতেন তাই নয়, বরং কোনো ব্যক্তি যেন বাকপটুতার আশ্রয় নিয়ে আদালতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে অন্যের অধিকার হরণ করে না নেয়, সে ব্যাপারে তার অনুসারী লোকের নিষেধ করেছেন। কোনো ব্যক্তি যদি আদালতে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের অধিকার হরণ করে নেয়, তাহলে সে প্রকারান্তরে জাহান্নামের একটি অংশ অর্জন করে বলে মহানবী (সা.) জানিয়ে দিয়েছেন। উম্মু সালামা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা আমার কাছে মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে আস। আর তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো প্রতিপক্ষের তুলনায় প্রমাণ সাক্ষী পেশ করার ব্যাপারে অধিক বাকপটু। তবে জেনে রেখ, বাকপটুতার কারণে যার পক্ষে আমি তার ভাইয়ের প্রাপ্য হক ফায়সালা করে দেই, তার জন্য আসলে আমি জাহান্নামের অংশ নির্ধারণ করে দেই। কাজেই, সে যেন তা গ্রহণ না করে।’ (বোখারি : ২৬৮০)। বিচার ও বিচারালয়ের প্রতি বিচারপ্রার্থীর মনে শ্রদ্ধা ও আস্থা থাকে তখনই, যখন সে ন্যায়সঙ্গত বিচার পায়। তাই বিচারকদের উচিত মানুষের মনের ভালোবাসা কুড়িয়ে আমরণ স্বস্তিময় অনুভূত শ্রদ্ধার আসনে নিজেকে সমাসীন করা। বিচারিক রায়ে স্বচ্ছতা রক্ষা করে শান্তিময় সমাজ ও দেশ গঠনে আত্মনিয়োজিত হওয়া।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১