ফেরাউনের পরিচয়
আল্লাহ ন্যায় ও ইনসাফের আধার। তিনি অত্যাচার করেন না এবং অত্যাচারীকে প্রশ্রয়ও দেন না। পৃথিবীতে যত অত্যাচারী-জালেম শাসক এসেছে, তাদের অন্যতম হলো, ফেরাউন। ফেরাউন মূলত একটি পদবি। হাল-জামানায় রাষ্ট্রপতি যেমন একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির পদবি। তেমনি ফেরাউনও একটি পদবি, যা তৎকালীন মিশরের শাসকেরা ধারণ করত। মুসা (আ.)-এর যুগের ফেরাউনের প্রকৃত নাম হলো- দ্বিতীয় রামসিস বা মিনফাতাহ। যেজুলুম, আত্যাচার, অহংকার, অহমিকা, পাপাচার আর অনাচারে দুনিয়ার অন্যসব জালেমকে পেছনে ফেলেছিল। ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে নিজেকে খোদা দাবি করেছিল। আল্লাহতায়ালা ছাড় দেন; কিন্তু ছেড়ে দেন না। তিনি এমনভাবে এই দাম্ভিকের ধ্বংস ও পতন ঘটিয়েছেন যে, পৃথিবী ও পৃথিবীবাসী যতদিন থাকবে তার ধ্বংসের কথা স্মরণে রাখবে। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন সুরায় তার ঘটনার বিবরণ এসেছে- আল্লাহতায়ালা মুসা (আ.)-কে নবী বানিয়ে তার কাছে পাঠালেন। প্রেরিত নবীকে আদেশ করলেন, একত্ববাদের দাওয়াত দিতে। আর সীমা লঙ্ঘন করা থেকে বারণ করতে। আল্লাহ বলেন, ফেরাউনের কাছে যাও, নিশ্চয়ই সে সীমা লঙ্ঘন করেছে (সুরা ত্ব-হা:২৪)। অন্য আয়াতে এসেছে- মুসা (আ.) স্বীয় ভাই হারুনসহ ফেরাউনের কাছে এলেন এবং বললেন, আমরা জগৎ প্রতিপালকের রাসুল, বনি ইসরাইলকে আমাদের সঙ্গে যেতে দাও। (সুরা শু’আরা : ১৭-১৮)। মুসা (আ.) যুক্তিতর্কের মাধ্যমে ফেরাউনকে বোঝানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন; কিন্তু দাম্ভিক ফেরাউন নিজেকেই বড় রব হিসেবে দাবি করল। সভাসদদের ডেকে বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ব্যতীত তোমাদের কোনো ইলাহ আছে বলে আমার জানা নেই। (সুরা কাসাস : ৩৮)। আবার জনসাধারণকে জমায়েত করে ঘোষণা করল, আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিপালক। (সুরা নাযিয়াত : ২৩-২৪)।
ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হলেন না বরং মন্ত্রীদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যারা তাকে রব মানবে না বরং মুসা এবং তার খোদাকে রব মানবে, তাদের ছেলেদের হত্যা করা হবে আর মেয়েদের জীবিত রাখা হবে। কোরআনে এসেছে- যারা তার সঙ্গী হয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদের পুত্রদের হত্যা কর আর নারীদের জীবিত রাখ। (সুরা মুমিন : ২৫)। যুগে যুগে জালেমরা এমনটাই করে এসেছে। তারা আইনের জাঁতাকলে পিষ্ট করে জনসাধারণকে।
সত্যের বিজয়
মুসা নবী ও তার উম্মতের ওপর ফেরআউন ও তার দলবলের অত্যাচার সীমাহীন বেড়ে গেল। আল্লাহতায়ালা মুসা (আ.)-কে বনি ইসরাইলকে নিয়ে রাতের আঁধারে মিশর ত্যাগ করতে আদেশ দেন। কোরআনে এসেছে- আমি মুসার কাছে ওহি অবতীর্ণ করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাতের বেলা বের হয় পড়। (সুরা শু’আরা : ৫২)।
মুসা (আ.) তার জাতিকে নিয়ে বের হলে, ফেরআউন বনি ইসরাইলকে শায়েস্তা করার জন্য তার বিশাল বাহিনী নিয়ে পিছু ধাওয়া করে। মুসা (আ.) তার জাতিকে নিয়ে লোহিত সাগরের কিনারে পৌঁছলে, ফেরাউনও তার দলবল নিয়ে পেছনে পেছনে উপস্থিত হয়। বনি ইসরাইলের ডানে-বাঁয়ে ছিল পাহাড়, সামনে লোহিত সাগর আর পেছনে ছিল ভয়ংকর ফেরাউন বাহিনী। বনি ইসরাইল ফেরাউনের বাহিনীকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায়। তারা মুসা (আ.)-কে বলতে থাকে, আমরা তো ধরা পড়ে গেলাম। মুসা (আ.) বললেন, কখনোই নয়! আমার সঙ্গে আমার রব আছেন, তিনি আমাকে পথ দেখাবেন। (সুরা শু’আরা : ৬২)।
আল্লাহ বনি ইসরাইলকে হেফাজতের ইচ্ছা করলেন আর স্বয়ং রব যাকে বাঁচাতে চান তাকে আর কে মারে? আল্লাহর হুকুমে মুসা (আ.) লাঠি দ্বারা সাগরে আঘাত করলে বারোটি রাস্তার সৃষ্টি হয়। মুসা (আ.) এবং তার জাতি সাগরে নির্মিত রাস্তা দিয়ে সমুদ্রের ওপারে চলে যায়। ততক্ষণে ফেরআউন বাহিনীর আগের অংশ সাগরের এপারে পৌঁছে। তারা এসে সাগরে রাস্তা দেখে। ফেরআউন বলে এই রাস্তা আমার তৈরি। ধাওয়া কর তাদের। ছুটো এ রাস্তা দিয়ে। তারা ছুটে চলল। মাঝ সমুদ্রে পৌঁছলে আল্লাহর আদেশে রাস্তা সমুদ্রে মিলিয়ে যায়। সমুদ্রে হয় তাদের সলিল সমাধি। (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৬০৪)। এ ঘটনার বর্ণনা
কোরআনে এসেছে এভাবে, আমি মুসাকে ওহি প্রেরণ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রে আঘাত কর, ফলে এটা বিভক্ত হয়ে প্রত্যেক ভাগ বিশাল পর্বতের মতো হয়ে গেল। আমি সেখানে উপনীত করলাম অপর দলটিকে এবং উদ্ধার করলাম মুসা ও তার সব সঙ্গীকে। তারপর নিমজ্জিত করলাম অপর দলটিকে। (সুরা শু’আরা : ৬২)।
ফেরআউনের মৃত্যু ও শিক্ষা
ফেরআউন যখন পানিতে ডুবে যাচ্ছিল, পরিত্রাণের কোনো উপায় পাচ্ছিল না। তখন সে চিৎকার করে বলত থাকে, আমি বিশ্বাস করলাম বনি ইসরাইল যাতে বিশ্বাস করে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। (সুরা ইউনুস : ৯০)।
হাদিসে এসেছে, তার ঈমানের কথা শুনে জিবরাইল (আ.) তার মুখে সমুদ্রের কাদা নিক্ষেপ করেন। যাতে সে আর ঈমানের কথা বলতে না পারে। হতে পারে, আল্লাহর রহমত তার ক্রোধের ওপর প্রাধান্য পাবে এবং তিনি তাকে মাফ করে দেবেন। (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৬০৮)। আল্লাহতায়ালা তার এমন ধোঁকাপূর্ণ ঈমান কবুল করেননি। ধ্বংস হয়েছে জালেমের। পতন হয়েছে প্রবল অহঙ্কারি ও অত্যাচারীর। তার এমন ধ্বংসাত্মক মৃত্যু থেকে দুনিয়াবাসীর জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষা। যেমন-
এক. তার মৃত্যু আমাদের শিক্ষা দেয়, কোনো ব্যক্তির জন্য অহঙ্কারি, স্বৈরাচারী ও দাম্ভিক হওয়া উচিত নয়। কারণ ফেরাউনের ধ্বংসের পেছনে প্রধান কারণ ছিল অহঙ্কার। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, অহঙ্কার আমার চাদর, যে আমার চাদর নিয়ে টান দেবে আমি তাকে লাঞ্ছিত করব। (ইবনে মাজাহ :৪১৭৫)।
দুই. ফেরআউন বনি ইসরাইলের অন্যান্য ঈমানদারকে লাঞ্ছনা, অপদস্থতা ও হত্যার পরে স্বয়ং মুসা (আ.)-কেও হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। কোরআনে এসেছে- ফেরআউন তার সভাসদদের বলল, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মুসাকে হত্যা করি। (সুরা ইউনুস : ৯০)। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সঙ্গে শত্রুতা পোষণ, অভদ্র ও অশোভন আচরণ কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। এতে শুধু নিজের ধ্বংসকেই ত্বরান্বিত করা হয়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, যে আমার বন্ধুদের সঙ্গে শত্রুতা রাখে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধের ঘোষণা দিই। (বোখারি : ৬৫০২)। আর এটা স্পষ্ট, আল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধ করে কেউ বিজয়ী হয় না। সুনিশ্চিত ধ্বংস হয়। তাই ধ্বংস থেকে বাঁচতে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। শত্রুতা বর্জন করতে হবে।
তিন. ফেরাউন সীমা লঙ্ঘনের সীমা পার করেছিল নিজেকে আল্লাহ হিসেবে দাবি করে। সে বলেছিল, আমি-ই তোমাদের বড় রব। (সুরা নাযিয়াত : ২৩, ২৪)। এর দ্বারা সে নিজের ধ্বংকে আহ্বান করেছিল।
চার. এমন অত্যাচারী, অহঙ্কারি, স্বৈরাচারী জালেম হওয়া কারো জন্য উচিত নয়। যার মৃত্যুতে শোকের বদলে মানুষ খুশি হয়। যেমনটা হয়েছিল ফেরাউন ও তার বাহিনীর ক্ষেত্রে। এদের ধ্বংসে কেউ কষ্ট পায়নি, কাঁদেনি। কোরআনে এসেছে- তাদের ধ্বংসে (ফেরআউন ও তার বাহিনী) আসমান, জমিন কেউ কাদেনি। (সুরা দুখান : ২৯)। তাই এমনভাবে জীবন গড়া উচিত, যাকে হারানোর বেদনায় পুরো জগত ব্যথিত হয়।
পাঁচ. আল্লাহপ্রেমীদের বদদোয়া নিতে নেই। আজ বা কাল তাদের বদদোয়ার ফলাফল সামনে এসে যায়। যেমনটা হয়েছিল, ফেরাউনের সঙ্গে। তার মৃত্যুর অন্যতম বড় কারণ মুসা (আ.) এর বদদোয়া। সে মুসাকে এত পরিমাণ যাতনা ও কষ্ট দিয়েছিল যে, তিনি বদদোয়া করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ছয়. তার মৃত্যু আমাদের শিক্ষা দেয়, যে নিজে পথহারা সে অন্যকে পথ দেখাতে পারে না। ফেরাউন নিজে জানত না, সমুদ্রে রাস্তাা কীভাবে হলো? সে বলে দিল আমিই তৈরি করেছি আর সবাই অন্ধভাবে বিশ্বাসও করেছে। একবারও ভাবেনি তার দ্বারা এটা কীভাবে সম্ভব? ফেরাউন নিজে ভ্রষ্ট হয়েছে এবং তার জাতিকেও ভ্রষ্ট করেছে। কোরআনে এসেছে- ফেরাউন তার জাতিকে পথভ্রষ্ট করেছে, তাদের পথ দেখাতে পারেনি। (সুরা ত্ব-হা : ৭৯)।
সাত. আল্লাহ যাকে বাঁচাতে চান তাকে কেউ মারতে পারে না, সে যত দুর্বলই হোক। আর আল্লাহ যাকে মারতে ইচ্ছা করেন, তাকে কেউ বাঁচাতে পারে না, সে যতই শক্তিশালী হোক।
আট. মৃত্যু এসে গেলে ঈমান আর তওবায় কোনো লাভ হবে না। তাই তওবা করতে চাইলে মৃত্যু আসার আগেই করা উচিত। আল্লাহ বান্দার তওবা মৃত্যুকালীন গড়গড়া আসার পূর্ব পর্যন্ত কবুল করেন, এর পরে নয়। (তিরমিজি : ৩৫৩৭)।
ফেরাউনও শেষ সময়ে ঈমানের স্বীকারোক্তি দিয়েছিল; কিন্তু সেই ঈমান কবুল হয়নি। সে নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি। জ্ঞানীদের উচিত, ফেরাউনের ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষা নেওয়া এবং সব ধরনের সীমা লঙ্ঘন করা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা।
লেখক : খতিব ও মুহাদ্দিস