প্রতিবেশী জীবনের আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। মানবসমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। নিজেদের প্রয়োজনেই সমাজবদ্ধ হয়ে কাজকর্ম করতে হয়। পাশাপাশি থাকতে হয়। অনেক সময় নিকটাত্মীয়ের চেয়ে প্রতিবেশীই সবচেয়ে আপন মানুষ হয়ে ওঠে। কাছাকাছি সহাবস্থানের কারণে বিপদাপদ, সুখণ্ডদুঃখে আত্মীয়ের চেয়ে প্রতিবেশীর সহযোগিতা বেশি দরকার হয়। বিপদে প্রতিবেশীই সবার আগে ছুটে আসে। তাই ইসলামে প্রতিবেশীর হকের বিষয়ে অনেক গুরুত্বারোপ করেছে এবং প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ ও সহমর্মী হতে জোর দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে কোরআন ও হাদিসে উঠে এসেছে অনেক দিকনির্দেশনার পাঠ।
কোরআনে প্রতিবেশীর গুরুত্ব
আল্লাহর ইবাদত ও তার সঙ্গে শরিক না করার বিধানের পাশাপাশি প্রতিবেশীর হকের বিষয়টিও আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন। একই আয়াতে আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের হকের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে পিতা-মাতার হক, আত্মীয়স্বজনের হক, এতিমের হক ইত্যাদি। এসব গুরুত্বপূর্ণ হকের সঙ্গে প্রতিবেশীর হককে উল্লেখ করা থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ প্রতিবেশীর হককে কত গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তা রক্ষা করা আমাদের জন্য কত জরুরি। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা ইবাদত কর এবং কোনো কিছুকে তার সঙ্গে শরিক করো না। এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, মুসাফির ও তোমাদের দাস-দাসীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা নিসা : ৩৬)।
হাদিসে প্রতিবেশীর গুরুত্ব
রাসুল (সা.) অসংখ্য হাদিসে প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে আলোকপাত করেছেন। এমনকি রাসুল (সা.) বলেছেন, জিবরাইল (আ.) আমাকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে এত বেশি তাগিদ দিয়েছেন যে, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রতিবেশীকে মিরাছ (মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি) এর অংশীদার বানিয়ে দেয়া হবে। (বোখারি : ৬০১৪)। হালে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে আমাদের মধ্যে উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। আত্মীয়তা বা প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার। বিশেষ করে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের একচ্ছত্র সয়লাবের যুগে অফলাইনের প্রতিবেশীরা চরম অবেহলার শিকারে পরিণত হয়ে অনলাইনের অনাত্মীয় ও দূর থেকে দেখা লোকদের গুরুত্ব অপরিসীম হয়ে উঠেছে, যা হওয়ার কথা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। অথচ কাছের বা দূরের আত্মীয় ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করা, তাদের কষ্ট না দেয়া, তাদের খোঁজখবর রাখা এবং বিভিন্ন কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করাকে ঈমানের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতের ওপর ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করে। (মুসলিম : ১৮৫)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, যে আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। (মুসলিম : ১৮৩)।
প্রতিবেশী কে?
প্রতিবেশী বলতে শুধু মুসলমান প্রতিবেশী নয় বরং প্রতিবেশী মুসলিম অমুসলিম, নেককার, বদকার, শত্রুমিত্র, দেশি-বিদেশি, আত্মীয়-অনাত্মীয়, কাছে-দূরের, স্থায়ী-অস্থায়ী সবাই অন্তর্ভুক্ত। পাশের ঘরের লোকজনই কেবল প্রতিবেশী, বিষয়টি এমন নয়। অফিসের কলিগ প্রতিবেশী, বাসের সহযাত্রী প্রতিবেশী, সহপাঠী প্রতিবেশী, অধীন ব্যক্তিরা প্রতিবেশী। সুতরাং যে প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো আচরণ করে এবং তাদের যথাযথ হক আদায় করে এবং প্রতবেশী তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন, সেই উত্তম প্রতিবেশী। রাসুল (সা.) বলেছেন, যে নিজ প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে ভালো সেই সর্বোত্তম প্রতিবেশী। (মুসনাদে আহমাদ : ৬৫৬৬)। আমরা ভালো প্রতিবেশী হবো, মন্দ প্রতিবেশী হবো না। মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইব। কারণ মন্দ প্রতিবেশী নিজেও খারাপ কাজ করে এবং অন্যকেও খারাপের দিকে নিয়ে যায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও। (সুনানে নাসায়ি : ৫৫০২)। দুই প্রতিবেশী নারীর ঘটনা হাদিসে এসেছে, হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি এসে রাসুল (সা.)-কে বলল, এক নারীর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ, সে বেশি বেশি (নফল) নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, দুই হাতে দান করে। কিন্তু মুখের কথায় নিজ প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। (তার অবস্থা কী হবে?)। রাসুল (সা.) বললেন, সে জাহান্নামে যাবে। আরেক নারী বেশি (নফল) নামাজও পড়ে না, খুব বেশি রোজাও রাখে না আবার তেমন দানসদকাও করে না; সামান্য দু-এক টুকরা পনির দান করে। তবে সে মুখের কথায় প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না (এই নারীর ব্যাপারে কী বলেন?)। রাসুল (সা.) বললেন, সে জান্নাতি। (বোখারি : ১১৯)।
প্রতিবেশীদের প্রতি মহানবী
রাসুল (সা.) প্রতিবেশীর প্রতি কতটা সদয় ও যত্নবান ছিলেন, তা রাসুলের হাদিসের দিকে লক্ষ্য করলে সুস্পষ্ট বুঝা যায়। রাসুলের সিরাত পাঠ করলেও ভেসে আসে তাঁর আখলাকের অনুপম দৃষ্টান্তের ছবি। প্রতিবেশীর সঙ্গে কী কী আচরণ করতে হবে। আর কী করা যাবে না। কোন আচরণ দ্বারা প্রতিবেশীর মাঝে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে এবং মুহাব্বত বৃদ্ধি পাবে, সেসব কথাও তিনি উম্মাহর জন্য বলে গিয়েছেন। যদি হাদিসের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করা হয় তাহলে আঁচ করা যায়, রাসুল (সা.) প্রতিবেশীর প্রতি কতটা দরদি ও মানবিক ছিলেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি মোমিন নয়, যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। (আল আদাবুল মুফরাদ : ১১২)। রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা হাদিয়া আদান-প্রদান কর। এর মাধ্যমে তোমাদের মাঝে মুহাব্বত বৃদ্ধি পাবে। (আল আদাবুল মুফরাদ : ৫৯৪)। রাসুল (সা.) হজরত আবু যর (রা.)-কে বললেন, হে আবু যর তুমি ঝোল (তরকারি) রান্না করলে তার ঝোল বাড়িয়ে দিও এবং তোমার প্রতিবেশীকে তাতে শরিক করো। (মুসলিম : ২৬২৫)। রাসুল (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন প্রথম বাদী ও বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশী। (মুসনাদে আহমাদ : ১৭৩৭২)।
উল্লিখিত হাদিসের বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, প্রতিবেশীর হক অত্যধিক। তাদের সঙ্গে সদাচরণ মোমিনের বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া সমাজকে সুসংগঠিত ও সুন্দর রাখার জন্যও প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্প্রীতি সদ্ভাব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এতে সমাজ সুন্দর ও শান্তিময় হয় এবং পার্থিব জীবনের পাশাপাশি পরকালীন জীবনেও অনেক লাভবান হওয়া যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রতিবেশীর হকের ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক : শিক্ষক ও মিডিয়াকর্মী