ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্ববাসীর দয়ার সাগর যিনি

আবদুল্লাহ নোমান
বিশ্ববাসীর দয়ার সাগর যিনি

নবুয়তি কাফেলার সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবী (সা.)। তার অনুপম জীবনচরিতই মানবতার একমাত্র আদর্শ। যিনি অবিনাশী সামগ্রিক বিপ্লবী বাণী নিয়ে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হয়ে এ পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন। যার বিমল চরিত্রের ছোঁয়ায় অলৌকিক বিপ্লব সাধিত হয়েছে শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতিসহ মানবজীবনের সব পরিমণ্ডলে। সময়ের সংক্ষিপ্ত পরিসরে মানবতার জয়গান এবং মুক্তির শাশ্বত আহ্বান ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র আরব দ্বীপগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বিস্ময়করভাবে কাঁচা-পাকা প্রতিটি নিবাসে পৌঁছে গিয়েছিল সত্যের বিজয়ধ্বনি। মহাকালের মহাবিশ্বয় হলো, নবীজি (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই আরব দ্বীপপুঞ্জ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। স্বর্গীয় সৌরভে আমোদিত হয়ে ওঠে পূর্ণ জাজিরাতুল আরব। সভ্যতা বিবর্জিত, নিগৃহীত ও অবহেলিত মানবতার মেঘঘন আকাশে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতোই ঝলসে ওঠে ঈমানি আভা। ভাষাতীত স্বার্থকতায় ও অনন্য সফলতায় দুস্থ অসহায়দের হৃদয়রাজ্যে বয়ে যায় আনন্দণ্ডসুখের প্রাণোচ্ছল ঢেউ। হতাশার কালো ছায়া দূরীভূত হয়ে তাদের মুখে ফুটেছিল প্রস্ফুটিত গোলাপের হাসি; মধুঝরা তৃপ্তির হাসি। নবীজি (সা.)-এর আলোকিত ডাকে সাড়া দিয়ে যারা নিজেদের চিন্তা-চেতনা ও সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতিকে সুউচ্চ আদর্শের সবুজ চিন্তায় পল্লবিত করেছিলেন, তারা নিজেরা যেমন ঐশী আলোর ছোঁয়ায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন, তেমনি জাহেলিয়াতের ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত পথহারা মানবসমাজের জন্যও পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন।

নবীজি (সা.) অমুসলিমদের জন্যও রহমত

নিখিল বিশ্বের স্রষ্টা একচ্ছত্র অধিপতি রাব্বুল আলামিন। তিনি তাঁর প্রিয় বন্ধুকে এ বসুন্ধরায় পাঠিয়েছেন রহমাতুল্লিল আলামিন করে, মোমিন-কাফের নির্বিশেষে সবার জন্যই রহমত বানিয়ে। মোমিনরা তার মাধ্যমে হেদায়াত পেয়েছে। তাকে অনুসরণ করে সঠিক পথের দিশা লাভ করেছে। নববি পয়গাম সন্তর্পণে মেনে উভয় জগতের সাফল্য অর্জন করেছে। তিনি কি শুধু মোমিনের জন্যই রহমত ও বরকতের আকর? না; বরং অমুসলিমদের জন্যও দয়া ও অনুকম্পার কারণ। তাই তো তাঁর উসিলায় এ উম্মতের কাফেরদের পূর্ববর্তী উম্মতের কাফেরদের মতো নগদ শাস্তি দেওয়া হয় না। ঢালাওভাবে আজাব দিয়ে তাদের সমূলে উৎপাটন করা হয় না। দয়াময় আল্লাহতায়ালা নবীজি (সা.)-কে এ জগতে প্রেরণ করেছেন রহমতুল্লিল আলামিন করে। পবিত্র কোরআনের বাণী, ‘(হে নবী!) আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য শুধু রহমত করেই পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)। মাওলানা শাব্বির আহমদ ওসমানি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘কাফেরদের সঙ্গে রাসুল (সা.) যে জিহাদ করেছেন, সেটাও ব্যাপকার্থে প্রকাশ্যে রহমত ছিল। কেননা, এর মাধ্যমে বড় রহমত যা তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়ে এসেছিলেন, তার (যথাযথ) হেফাজত হয়েছিল। তা ছাড়া এর ফলে এমন অনেকের ঈমানের প্রতি অন্তর্দৃষ্টি খুলে গিয়েছিল, যে ব্যাপারে তারা স্বেচ্ছায় অন্ধত্ব বয়ে বেড়াচ্ছিল।’ (তাফসিরে উসমানি)।

উম্মতের জন্য নবীজি (সা.)-এর দরদ

উম্মতের প্রতি মহানবী (সা.)-এর প্রণয়-প্রীতি ও স্নেহ-ভালোবাসা ছিল পিতৃসম। তিনি সন্তানের মতোই তাদের ভালোবাসতেন। সন্তানের আনন্দে মা-বাবা যেমন আনন্দে উদ্বেলিত হন এবং কষ্টে ব্যথিত হন, তিনিও উম্মতের আনন্দে আনন্দিত, তাদের দুঃখে দুঃখিত হতেন। উম্মতের প্রতি প্রিয় নবী (সা.)-এর কল্যাণকামিতা ও নিখাদ ভালোবাসা অনেক হাদিসে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন- জাবের (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার ও তোমাদের দৃষ্টান্ত সে ব্যক্তির মতো, যে আগুন জ্বালাল; ফলে পতঙ্গরাজি তাতে পড়তে লাগল। আর সে ব্যক্তি তাদের তা থেকে তাড়াতে লাগল। অনুরূপ আমিও আগুন থেকে রক্ষার জন্য তোমাদের কোমর ধরে টানছি, আর তোমরা আমার হাত থেকে ছুটে যাচ্ছ।’ (মুসলিম : ৫৮৫২)। এ ছাড়াও উম্মতের প্রতি মহানবী (সা.)-এর ভালোবাসা নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন-

উম্মতের পক্ষ থেকে কোরবানি

রাসুল (সা.) নিজ পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি তার সব উম্মতের পক্ষ থেকেও কোরবানি করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) কোরবানির ইচ্ছা করলে দুটি মোটাতাজা, মাংসল, শিংযুক্ত, ধূসর বর্ণের ও খাসি করা মেষ কিনতেন। এর পর এর একটি নিজ উম্মতের যারা আল্লাহর একত্বের সাক্ষ্য দেয় এবং তার নবুয়তের সাক্ষ্য দেয়, তাদের পক্ষ থেকে এবং অন্যটি মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি করতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩১২২)।

উম্মতের কষ্ট লাঘবে নবীজি (সা.)-এর ব্যাকুলতা

উবাই বিন কাব (রা.) সূত্রে বর্ণিত; একবার রাসুল (সা.) বনু গিফারের কুয়ার কাছে ছিলেন। এমন সময় তার কাছে জিবরাইল (আ.) আগমন করলেন। বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা আপনাকে আদেশ করেছেন, আপনি যেন আপনার উম্মতকে এক উপভাষায় কোরআন পড়ান।’ তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে তার ক্ষমা কামনা করি, আমার উম্মত এর ক্ষমতা রাখবে না।’ তিনি দ্বিতীয়বার এসে বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা আপনাকে আদেশ করেছেন, আপনি যেন আপনার উম্মতকে দুই উপভাষায় কোরআন পড়ান।’ তিনি বললেন, ‘আমি আল্লাহর কাছে তার ক্ষমা কামনা করি, আমার উম্মত এর ক্ষমতা রাখবে না।’ এভাবে তিনি একাধিকবার অক্ষমতা প্রকাশ করতে থাকেন, যতক্ষণ না আল্লাহর পক্ষ থেকে সাত উপভাষায় কোরআন তেলাওয়াতের অনুমতি দেওয়া হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৯৩৯)।

প্রতি নামাজে উম্মতের জন্য দোয়া

উম্মতের প্রতি নবীজি (সা.)-এর দয়া ও অনুগ্রহ অপরিসীম। তা মুখে যেমন গণনা করে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, তেমনি কালো কালির হরফে লিখেও শেষ করা সম্ভব নয়। এমন নবীর উম্মত হয়ে আমরা কতই না সৌভাগ্যবান। অথচ পদে পদে আমরা তার দেখানো পথ থেকে ছিটকে পড়ি। বিচ্যুত হয়ে পড়ি তার অনুপম আদর্শ থেকে। ভঙ্গুর পৃথিবীর তথাকথিত সেলিব্রিটিরাই আমাদের মডেল হয়ে যায়। তাদের পূতিগন্ধময় চালচলনই আমাদের মনঃপূত হয়। নিজেদের জীবন সাজাতে মরিয়া হয়ে উঠি তাদের বস্তাপচা কৃষ্টি-কালচারেই। রাসুল (সা.) প্রতি নামাজে উম্মতের পাপমুক্তির দোয়া করতেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার উম্মতের আগে ও পরের এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব গোনাহ ক্ষমা করে দিন।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৭১১১)।

নবীজি (সা.)-এর ওপর নির্মম অত্যাচার

মক্কার মুশরিকরা রহমাতুল্লিল আলামিনের ওপর বর্ণনাতীত জুলুমণ্ডনির্যাতন চালিয়েছে। এ নরাধমরা তাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়ে জর্জরিত করেছে। এমনকি তার গলায় কাপড় পেঁচিয়ে হত্যা পর্যন্ত করার চেষ্টা করেছে। উরওয়াহ ইবনে যুবায়ের (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, একবার রাসুল (সা.) কাবার আঙিনায় সালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় উকবা ইবনে আবু মুআইত এলো। সে রাসুল (সা.)-এর ঘাড় ধরল। কাপড় দিয়ে তার গলায় পেঁচিয়ে খুব শক্ত করে চেপে ধরল। এ সময় আবু বকর (রা.) হাজির হয়ে তার ঘাড় ধরে রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে সরিয়ে দিলেন। বললেন, ‘তোমরা কি এ ব্যক্তিকে এ জন্য হত্যা করবে যে, সে বলে, আমার রব আল্লাহ; অথচ তিনি তোমাদের রবের কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের কাছে এসেছেন।’ (বোখারি : ৪৮১৫)। বেঈমান কাফেররা নবীজি (সা.)-কে প্রশান্ত মনে ইবাদত করার সুযোগও দিত না। তাঁর ওপর নানাভাবে চড়াও হতো। জন্তুর দুর্গন্ধময় নাড়িভুঁড়ি তার শরীর মোবারকে ফেলতে, তাকে অমানসিক নির্যাতন করতেও তাদের হাত কাঁপত না। ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; একবার নবী (সা.) বাইতুল্লাহর কাছে সালাত আদায় করছিলেন। আবু জাহেল ও তার সঙ্গীরা অদূরে বসা ছিল। আগের দিন সেখানে একটি উট কোরবানি করা হয়েছিল। আবু জাহেল বলল, ‘কে অমুক গোত্রের উটের (নাড়িভুঁড়িসহ) জরায়ুকে নিয়ে আসবে এবং মুহাম্মদ যখন সেজদারত হবে, তখন তার দু’কাঁধের মাঝখানে তা রেখে দেবে?’ তখন সম্প্রদায়ের সবচেয়ে হতভাগা দুরাচার লোকটি উঠে দাঁড়াল এবং তা নিয়ে এলো। নবীজি (সা.) যখন সেজদায় গেলেন, তখন তার দু’কাঁধের মাঝখানে তা রেখে দিল। এতে তারা হাসাহসি করতে লাগল। একে অপরের গায়ের ওপর ঢলে পড়তে লাগল। আর আমি তখন দাঁড়িয়ে তা দেখলাম। যদি আমার প্রতিরোধের সাধ্য থাকত, তবে আমি তা অবশ্যই রাসুল (সা.)-এর পিঠ থেকে ফেলে দিতাম। নবীজি (সা.) সেজদায় রইলেন। মাথা তুলতে পারছিলেন না। অবশেষে এক ব্যক্তি গিয়ে ফাতেমা (রা.)-কে খবর দিল। ফাতেমা (রা.) দৌড়ে এলেন। তিনি তখন বালিকা। তিনি তা তাঁর ওপর থেকে তা ফেলে দিলেন। তারপর তাদের দিকে মুখ করে তাদের মন্দাচারের বিষয়ে বলছিলেন। যখন নবীজি (সা.) সালাত সম্পন্ন করে উচ্চ স্বরে তাদের বদদোয়া দিলেন, আর তিনি যখন দোয়া করতেন (সাধারণত) তিনবার করতেন। তারপর তিনি তিন-তিনবার বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! তোমার ওপরই কোরাইশদের বিচারের ভার ন্যস্ত করলাম।’ যখন তারা তার আওয়াজ শুনতে পেল, তখন তাদের হাসি চলে গেল এবং তারা তার বদদোয়ায় ভয় পেয়ে গেল। তারপর তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! আবু জাহেল, ইবনে হিশাম, উতবা ইবনে রবিআ, শাইবা ইবনে রবিআ, ওয়ালিদ ইবনে উকবা, উমাইয়া ইবনে খালফ ও উকবা ইবনে আবু মুআয়তের শাস্তির ভার তোমার ওপর ন্যস্ত।’ বর্ণনাকারী বলেন, ‘তিনি সপ্তম আরেকজনের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আমি তা স্মরণ রাখতে পারিনি। মুহাম্মদ (সা.)-কে যে পবিত্র সত্তা সত্যসহ রাসুলরূপে প্রেরণ করেছেন, তার কসম! তিনি যাদের নাম সেদিন উচ্চারণ করেছিলেন, বদরের দিন তাদের পতিত লাশ আমি দেখেছি।’ (বোখারি : ২৪০)।

লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত