হাদিস বর্ণনায় অমর
সাহাবায়ে কেরাম নবী-রাসুলদের পরে শ্রেষ্ঠ দল। তারা আমাদের চেতনার বাতিঘর। প্রেরণার আলোকবর্তিকা। আমাদের আদর্শ ও অনুসরণীয় ব্যক্তি। তাদের বর্ণিত হাদিস আমাদের পাথেয়। সুপথের দিশা। রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পরও তাঁর দ্বীনকে তারা আঁকড়ে ধরেছেন। পরবর্তীদের জন্য তাঁর অগণিত বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। হাজার হাজার হাদিস বর্ণনা করে হয়েছেন অমর। এমনই ক’জন অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিকে নিয়ে লিখেছেন- আবদুল কাদের আফিফ
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আবু হুরায়রা (রা.)
তিনি দাউসি গোত্রের অধিবাসী ছিলেন। ইসলামপূর্বে তার নাম ছিল আবদে শামস। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুল (সা.) তার নাম রাখেন আবদুর রহমান। আবু হুরায়রা তার উপনাম। (কিতাবুস সুন্নাহ কবলাদবিন : ১/৪১১)। তার পিতার নাম সাখর আদ দাওসি। আবু হুরায়রা (রা.) অধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিদের অন্যতম। তিনি সর্বমোট ৫ হাজার ৩৭৪টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ২/৬৩২)। লোকেরা একবার তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি এত হাদিস কীভাবে বর্ণনা করেন?’ তিনি বললেন, যদি কোরআনে এ আয়াত না থাকত, তাহলে আমি হাদিস বর্ণনা করতাম না, ‘নিশ্চয়ই যারা গোপন করে, যা আমি অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট নিদর্শন, হেদায়েত তা মানুষের জন্য বর্ণনা করার পর; তারাই সেসব লোক, যাদের আল্লাহ ও অভিশপ্তকারীরা লানত দেয়।’ (সুরা বাকারা : ১৫৯)। মুহাজির সাহাবিরা বাজারে ব্যবসার কাজে যেতেন। আর আনসার সাহাবিরা তাদের সম্পদের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু আবু হুরায়রা (রা.) রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে থাকতন। তিনি ওই সব মজলিসে উপস্থিত ছিলেন, যেখানে তারা উপস্থিত ছিল না। তিনি এমন সব হাদিস মুখস্থ করেছেন, যা তারা মুখস্থ করেনি। (বোখারি : ৫৪)। ৫৭ হিজরিতে তার ইন্তেকাল হয়। (কিতাবুস সুন্নাহ কবলাদবিন : ১/৪১৮)।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)
তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর পুত্র। ইসলাম আত্মপ্রকাশের তৃতীয় বছর মক্কা নগরীতে তার জন্ম। (আল মাউসুআতুল মুজাজা ফিত তারিখিল ইসলামি : ৬৬১)। তার উপনাম আবদুর রহমান। রাসুল (সা.) এর সহধর্মিণী হাফসা (রা.) তার সহোদরা বোন। তিনি তার বাবা উমর (রা.)-এর সঙ্গে ছোটবেলায় ইসলাম গ্রহণ করেন। মুসলিমরা যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনিও তাদের সঙ্গে হিজরত করেন। তার বয়স তখন ১০ বছর। তিনি খন্দক, মক্কা বিজয়, মুতা, ইয়ারমুক যুদ্ধে শরিক ছিলেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৩/২০৪)। তিনি ২ হাজার ৬৩০টি হাদসি বর্ণনা করেছেন। ইলমে তলবের খেদমতে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসতেন। উসমান (রা.)-এর খেলাফতকালে তাকে খেলাফাতের দায়িত্ব দেওয়া হলে তিনি তা ফিরিয়ে দেন। (মিরআতুয যামান ফি তারিখিল আয়ান : ৬/১১৪)। তিনি ইসলামের গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তবুও ফতোয়া দিতে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৩/২২১)। তিনি রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণের ক্ষেত্রে খুবই পাবন্দ ছিলেন। রাসুল (সা.) যে যেই স্থানে নামাজ পড়েছেন, তিনিও সেখানে নামাজ পড়তেন। এমনকি রাসুল (সা.) যে গাছের নিচে বসেছেন, তিনিও সেখানে বসতেন। সে গাছে পানি সিঞ্চন করতেন। যাতে গাছটি শুকিয়ে না যায়। (উসদুল গাবাহ : ৩/৩৪১)। রাসুলপ্রেমী এ সাহাবি ৭২ হিজরিতে পৃথিবী ছেড়ে আখেরাতে পাড়ি জমান। (আল ইসাবা : ৩/২৫৭)।
আনাস ইবনে মালেক (রা.)তার বাবার নাম জমজম। মদিনার খাজরাজ বংশোদ্ভূত ছিলেন তিনি। তিনি রাসুল (সা.)-এর খাদেম ছিলেন। রাসুল (সা.) তাকে খুব স্নেহ করতেন। তার সূত্রে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২ হাজার ২৮৬টি। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৩/৪০৬)। রাসুল (সা.) যখন যা বলতেন, তিনি তা মুখস্থ করতেন। তিনি বলতেন, ‘রাসুল (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন আমার বয়স ১০। আর যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন আমার বয়স ছিল ২০। উম্মাহাতুল মোমিনিন আমাকে রাসুল (সা.)-এর বেশি বেশি খেদমত করতে উদ্বুদ্ধ করতেন।’ (মুসলিম ২০২৯)। তিনি রাসুল (সা.)-এর আদর্শকে জীবনের সবকিছুতে প্রাধান্য দিতেন। তার নামাজ ছিল সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর মাঝে রাসুল (সা.)-এর নামাজের অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৩/৪০০)।
আয়েশা বিনতে আবু বকর (রা.)
তিনি রাসুল (সা.)-এর প্রিয়তমা, সহধর্মিণী। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.)-এর কন্যা। তার বড় বোন আসমা বিনতে আবু বকর (রা.)। পবিত্র মক্কা নগরীতে তার জন্ম। তিনি অনেক মেধাশক্তির অধিকারী ছিলেন। রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর তিনি দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। নিজের জীবনকে তিনি ইলমে দ্বীন প্রচারের কাজে ব্যয় করেছেন। মানুষকে হাদিসের জ্ঞানভান্ডারে সুবাসিত করেছেন। হাদিসের দরস দিয়েছেন। পর্দার আড়ালে থেকে বর্ণনা করেছেন হাজারো হাদিস। মানুষকে সঠিক দ্বীন শেখানোর জন্য লজ্জা ছেড়ে বলেছেন অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো। হাদিসশাস্ত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার সূত্রে বর্ণিত হাদিস ২ হাজার ২১০টি। (তালকিহু ফুহুমি আহলিল আসার : ২৬৩)। তিনি এ উম্মতের মধ্যে সবচেয়ে ফকিহ নারী ছিলেন। ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, ‘যদি সকল মানুষের ইলম একত্র করা হয় এবং সকল নবীপত্নীর ইলমভাণ্ডারও এর সঙ্গে একত্র করা হয়, তাহলে আয়েশা (রা.)-এর ইলমের পরিধি সবচেয়ে বেশি হবে।’ (আল মুসতাদরাক : ৪/১১)। তার সতীত্ব ও পবিত্রতা আল্লাহতায়ালা স্বয়ং কোরআনে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসুলের অধিক প্রিয় ছিলেন। আমর ইবনুল আস (রা.) রাসুল (সা.)-কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনার কাছে মানুষের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আয়েশা!’ সাহাবি বললেন, ‘পুরুষদের মধ্যে কে?’ তিনি বললেন, ‘তার বাবা।’ (তিরমিজি : ৩৮৯০)।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস
তিনি রাসুল (সা.)-এর চাচা আব্বাস (রা.)-এর পুত্র। রাসুল (সা.) তাকে খুব স্নেহ করতেন। হিজরতের তিন বছর আগে আবু তালেবের গিরিপথে তার জন্ম। তিনি রাসুল (সা.)-এর সাহচর্য মাত্র ৩০ মাস পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ৬৬০টি হাদিস বর্ণনা করেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৩/২৩৬, ২৫৯)। রাসুল (সা.) তার জন্য দোয়া করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, হে আল্লাহ! তুমি তাকে কোরআনের ইলম দান করো।’ (বোখারি : ৭৬)। তিনি আরও বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমার মাথায় হাত রেখে আমার জন্য প্রজ্ঞার দোয়া করেছেন।’ (তিরমিজি : ৩৮২৪)। রাসুল (সা.) দোয়ার বরকতে তিনি হাদিস ও ফিকহে অনেক অবদান রাখেন। ইমাম লায়স (রহ.) বলেন, ‘আমি তাউসকে বললাম, আপনি রাসুল (সা.)-এর বড় বড় সাহাবির কাছে না গিয়ে এই বালক সাহাবি (ইবনে আব্বাস)-এর কাছে পড়ে থাকেন কেন?’ তিনি আমাকে বললেন, ‘আমি তো রাসুল (সা.)-এর সত্তরজন সাহাবিকে দেখেছি। তারা যখন কোনো বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হন, তখন ইবনে আব্বাস (রা.)-এর শরণাপন্ন হন।’ (উসদুল গাবাহ : ৩/২৯১)। আলী ইবনুল মাদিনি (রহ.) বলেন, ‘ইবনে আব্বাস (রা.) ৮০ কিংবা ৭৬ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)
তার পূর্ণ নাম ইবনে আমর ইবনে হারাম বিন সালাবা বিন কাব। তার বাবা আকাবার রাতে তাকে নিয়ে রাসুল (সা.)-এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। তিনিও সেই বরকতময় মজলিসে উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার বাবার বড় সন্তান ছিলেন। তাই বাবার কথা মেনে তিনি বদর যুদ্ধে শরিক হতে পারেননি। তার বাবা বদর যুদ্ধে শহীদ হন। তিনি বলেন, ‘রাসুল (সা.) আমার জন্য যে রাতে তার কাছে উট বিক্রি করেছিলাম, পঁচিশবার ইস্তেগফার করেছেন।’ (তিরমিজি : ৩৮৫৩)। তার বর্ণিত হাদিস ১ হাজার ৫৪০টি। তিনি ৯৪ বছর বেঁচে ছিলেন। ৮৭ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১/৯৪)।