পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই মহররম মাস বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে। ১০ মহররম (আশুরা)কে কেন্দ্র করে বহু ইতিহাসও রচিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা এ মাসে তার বিশেষ কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করেছেন। সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়ে তাদের নিরাপদে পার করে নিয়েছেন। আর একই রাস্তায় ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে ধ্বংস করেছেন সমূলে। (মুসলিম : ১১৩০, আল আসরারুল মারফুয়া : ৭৯)।
হিজরতের পর রাসুল (সা.) মদিনার ইহুদিদের দেখলেন, তারা ১০ মহররম রোজা রাখে। তখন বললেন, ‘আমি তোমাদের চেয়ে মুসার অধিক নিকটবর্তী।’ এরপর তিনি এ দিনে রোজা পালন করেন এবং রোজা পালনের নির্দেশ দেন।’ (বোখারি : ২০০৪)।
এই হিসেবে দিনটি ছিল আমাদেরও আনন্দের দিন। রবের বিশেষ নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের দিন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, এ দিনে ইতিহাসের এক নির্মম ঘটনা ঘটে। নতুন এক অধ্যায় রচিত হয় কারবালা প্রান্তরে। যা ইসলামের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক অধ্যায়। যেখানে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন প্রিয় নবীজি (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হোসাইন (রা.)। হোসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করার দিনটিও ছিল ১০ মহররম।
মৌলিকভাবে যদিও মহররমের সঙ্গে কারবালার কোনো যোগসূত্র নেই; জাপানের
জনসংখ্যা কমছে
বাড়ছে বিদেশিার করণীয় পালন করেন। কেননা, যখন কোনো ভুল ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, সমাজে অনাচার সৃষ্ট ধস নামা শুরু হয়, তখন আর ভালোর আহ্বান ও মন্দের প্রতিরোধ এবং তাকওয়া-তাহারাত জাগানো, খোদাভীতি ও ইবাদতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির পরিবর্তে শুরু হয়, আমোদণ্ডপ্রমোদের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধির আয়োজন, চলতে থাকে রাষ্ট্র ও ক্ষমতার গলদ ব্যবহার। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে যে দৃষ্টান্ত থাকা দরকার তিনি তার নির্দশেনা দিয়ে গেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছেন। যদি এমনটি না ঘটত, তাহলে হয়তো ইসলামের পরবর্তী যুগের ইতিহাসে দুঃশাসকদের ব্যাপারে শুধু সমর্থন ও নীরবতার নমুনাই দেখা লাগত।
সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আত্মত্যাগের উপমা হোসাইন (রা.)। আল্লাহর হেকমত ও ইশারায় হোসাইন (রা.) এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন যে, না, এভাবে চলবে না। সবাই চোখ বন্ধ করে অসত্য ও অন্যায়ের আনুগত্য করবে না। বরং কিছু লোকের এমনও হওয়া উচিত যে, দুঃসহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় নির্ভীকভাবে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এরই ফল হলো, হোসাইন-পরবর্তী যুগের মুজাহিদদের উজ্জ্বল ইতিহাস।
হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণে রাখার জন্য বিভিন্নভাবে আলোচনা পর্যালোচনা করা হয়। যদি কেউ ইয়াজিদকে লানত না করে, তাহলে তাকে বলা হয় ইয়াজিদের দালাল। আবার যারা লানত করে তারা মনে করেন, এটা এ মাসের কোনো আমল বিশেষ। বস্তুত কেউই বাড়াবাড়ি, ছাড়াছাড়ি থেকে মুক্ত নন। যার ফলস্বরূপ এখন আমরা কারবালার বাস্তব ইতিহাস ভুলতে বসেছি।
বাস্তবতা হলো, ইয়াজিদ হোসাইন (রা.) কে হত্যা করার নির্দেশ দেয়নি। তার মনোতুষ্টির জন্য কাজ করেছে একদল চাটুকার। বিপুল পরিমাণে হাদিয়া উপঢৌকন লাভের আশায় তার নির্দেশের আগে বেড়ে এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
ইতিহাসের বর্ণনা
ইরাকের গভর্নর ইবনে জিয়াদ হোসাইন (রা.) এবং তার সাথীবর্গের মোকাবিলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং একপর্যায়ে নির্মমভাবে তাকে শহিদ করা হয়। কিন্তু সৈন্যবাহিনীর সবাই তাতে সন্তুষ্ট ছিল না, আর ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়াও না তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন (আল্লাহই ভালো জানেন) না এটিকে ঘৃণা করেছেন। তাকে হত্যা করার আগে যদি তিনি জানতে সক্ষম হতেন, তবে তিনি তার সঙ্গে ক্ষমার আচরণ করতেন। যেমনটি তার পিতা তাকে পরামর্শ দিয়ে গেছেন এবং তিনি নিজে এ কথা ঘোষণাও করেছিলেন এবং এমন আচরণ করার জন্য তিনি ইবনে জিয়াদকে অভিশাপ দিয়েছিলেন।
(আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৮/১৯৬)। হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতে প্রত্যেক মুসলমান সত্য প্রতিষ্ঠার শানিত চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া উচিত, শোক আর মাতমে হা-হুতাশ করা হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের চেতনাবিরোধী কাজ। কারণ তার শাহাদাত গর্বের। সত্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার।
ইসলামে শোকদিবস নেই
হোসাইন (রা.)-এর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে গিয়ে শোকে কাতর হয়ে শিয়ারা তাজিয়া মিছিল বের করে। ছুরির আঘাতে নিজের দেহ কেটে ক্ষতবিক্ষত করে। এগুলো বর্জনীয় ও অনৈসলামিক কাজ। ইসলামে তিন দিনের বেশি শোক পালনের নিয়ম নেই। অথচ একটি ভুল ধারায় যুগ যুগ ধরে তাজিয়া মিছিল ও মাতম আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হচ্ছে। যা ইসলামের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন ও সন্দেহাতীতভাবে বর্জনীয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তার পিতা আলি (রা.) মর্যাদায় তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ ছিলেন।
তাকেও শত্রুরা হত্যা করেছে; কিন্তু তারা তার মৃত্যুকে হোসাইন (রা.)-এর হত্যার ন্যায় শোক মাতমের দিন হিসাবে গ্রহণ করেনি। আহলে সুন্নাহ ওয?াল জামায়াতের মতে একইভাবে উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.), উসমান (রা.) থেকে এবং উসমান (রা.) আলি (রা.)-এর চেয়ে উত্তম ছিলেন। কিন্তু লোকেরা তাদের শাহাদাতের দিনগুলোকে শোক মাতামের দিন হিসেবে গ্রহণ করেনি। তারচেয়ে বড় বিষয় হলো, রাসুল (সা.) এর মৃত্যুর দিনটিও শোক দিবস হিসেবে গ্রহণ করেনি নবীর খাঁটি প্রেমিকরা। (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া : ৮/১৯৬,১৯৭)।
হোসাইন (রা.)-এর পরিবারের নারীরা যখন ইয়াজিদের সামনে হাজির হন, সে তাদের এবং সেই সঙ্গে হোসাইনের কর্তিত মস্তকটি দেখে কেঁদে ওঠে এবং ইবনে জিয়াদকে ধিক্কার দিয়ে বলতে থাকে, ‘এই সুমাইয়ার বাচ্চাকে আমি কখন নির্দেশ দিয়েছি যে, হোসাইন ইবনে আলিকে হত্যা কর।’ এরপর সে শিমার যিল-জাওশান এবং ইরাকিদের সম্বোধন করে বলে, ‘তোমরা হোসাইনকে হত্যা করতে গেলে কেন?’
ইয়াজিদের পুরস্কারের লোভে এমনটি করা হয়। কিন্তু ইয়াজিদ কাউকেই কোনো পুরস্কার বা উপঢৌকন দেয়নি, বরং উন্মাদনা প্রকাশ করে তাদের সবাইকে ফেরত যেতে বলে।
এরপর তার সভা সদস্যবৃন্দকে সম্বোধন করে বলেন, ‘হোসাইনের মা আমার মায়ের চেয়ে উৎকৃষ্ট ছিলেন, তার নানা মুহাম্মদ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল এবং মানবজাতির নেতা। কিন্তু তার পিতা আলি ও আমার পিতা মুআবিয়ার মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল। এভাবে আমার ও হোসাইনের মধ্যেও ঝগড়া হয়েছে।’ (আল মুনতাযাম ফি তারীখিল মুলূকি ওয়াল উমাম, ইবনুল জাওযি : ৫ /৩৪২, তারীখুল ইসলাম, আকবর শাহ নজীবাবাদী : ২/৭০, শহিদে কারবালা, মুফতি শফি (রহ.) : পৃ.৭৪, কারবালা এবং ইমাম বংশের ইতিবৃত্ত : পৃ. ১১২)।
কারবালার দুর্ঘটনার দায় কার?
সবশেষে এই প্রশ্নটা থেকেই যায়, কারবালায় যে দুর্ঘটনা ঘটল এর দায় আসলে কার? রাসুল (সা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার মাত্র ৫০ বছরের মাথায় তার বংশধরদের রক্তে রঞ্জিত করল কে?
কারবালার ঘটনা গভীরভাবে পাঠ করলে যা বোঝা যায়, আসলে কোনো একক ব্যক্তির ওপর এর দায় চাপিয়ে দেওয়া যায় না, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একাধিক দল ও ব্যক্তি। এর মধ্য থেকে কারো ষড়যন্ত্র, কারো অজ্ঞতা, কারো হিংসা এবং কারো প্রতিশোধ-স্পৃহাই ছিল-এর নেপথ্য কারণ। সমষ্টিগতভাবে যারা এর জন্য দায়ী-
কুফার অধিবাসী
কারবালার দুর্ঘটনার মূলে রয়েছে কুফার অধিবাসীরা। যারা হোসাইন (রা.) এর সঙ্গে অসংখ্যবার ওয়াদা করে আহ্বান করেছে এবং পরবর্তী সময়ে ধোঁকা দিয়েছে। সাহাবায়ে-কেরাম এবং উম্মতের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলেমদের আলোচনা ঘাটলে স্পষ্ট হয় যে, তাদের যত ক্রোধ, সব ওই কুফাবাসীদের প্রতিই। (ফাযাইলুস সাহাবা লি আহমাদ ইবনে হাম্বল : ১৩৯২, আল মুজামুল কাবির লিততাবারানি : ৩/১০৮-১০৯, বোখারি : ৫৯৯৩ কিতাবুল আদাব)।
যুদ্ধ চলাকালে উচ্চারিত হোসাইন (রা.)-এর এ বাণীটিও বিশেষ চিন্তার দাবিদার যে, ‘হে আল্লাহ! তুমিই তাদের এবং আমাদের মাঝে ন্যায়বিচার করে দাও। এই এরাই আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে আহ্বান করেছে; কিন্তু এখন তারাই আমাদের হত্যা করছে।’ (তারীখুত তাবারি : ৫/৩৮৯)।
হুসাইন (রা.) এর হত্যায় যারা শরিক ছিল
ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আলি-ভক্ত শিয়ারা হোসাইন (রা.) এর হত্যাকাণ্ডে শরিক ছিল।
১. আমর ইবনে হাজ্জাজ
২. শিমার যিল জাওশান
৩. আবদুল্লাহ ইবনে জহির ইবনে সালিম
৪. কায়েস ইবনুল আশআস
৫. সিনান ইবনে আনাস নাখায়ি
৬. খাওলা বিন ইয়াজিদ আল আসবাহি
৭. আমর ইবনে সাআদ এরা এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল বলে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। (তারীখে উম্মাতে মুসলিমাহ, ইসমাঈল রেহান : ৬/ ৬৮)।
কারবালার ঘটনা এবং ইয়াজিদের কীর্তি
লোকপ্রচলনে প্রসিদ্ধ এটাই যে, ইয়াজিদ হোসাইন (রা.) কে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে ইয়াজিদই আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু কোনো বর্ণনায় স্পষ্টভাবে একথা নেই যে, হত্যার নির্দেশটা ইয়াজিদ দিয়েছিল। প্রমাণ যতটুকু পাওয়া যায় তা হলো, উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ নিজ ইচ্ছাতেই তা করেছিল। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) লিখেছেন, সব বর্ণনাকারী এ ব্যাপারে একমত যে, ইয়াজিদ হোসাইন (রা.) কে হত্যার নির্দেশ দেয়নি। (মিনহাজুস সুন্নাহ : ৪/৫৭৭)।
ইবনে সালাহ বলেছেন, আমাদের কাছে এই কথা সঠিক মনে হয় না যে, ইয়াজিদ হোসাইন (রা.)- কে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল।
প্রসিদ্ধ কথা হলো, হোসাইন (রা.) এর ব্যাপারে এই যুদ্ধের নির্দেশই তার শাহাদাতের কারণ হয়েছিল, আর যুদ্ধের আদেশ দিয়েছিল ইরাকের গভর্নর ইবনে জিয়াদ। (ফাতাওয়ায়ে ইবনে সালাহ : ২১৬)।
তাই বলে এসবের উদ্দেশ্য এটা নয় যে, কারবালার ঘটনা থেকে ইয়াজিদ পূর্ণরূপে মুক্ত ও সম্পর্কহীন। যদি দুনিয়ার কোনো আদালতে কারবালার নিহতদের ব্যাপারে মামলা দায়ের করা হতো, তাহলে প্রমাণের অভাবে ইয়াজিদ মুক্তি পেয়ে যেতো ঠিকই; কিন্তু চারিত্রিক দিক বিবেচনায় এবং প্রচলিত সমাজনীতিতে সাধারণ মানুষের আদালতে সে কখনোই মুক্তি পেতো না (আর আখেরাতের ফয়সালার ব্যপারে আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন)।
(মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস : ইসমাঈল রেহান : (ষষ্ঠ খণ্ড ৬৫-৭৫)
এজিদের তিন বছরের শাসন আমলে প্রথম বছর কারবালা হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড, দ্বিতীয় বছর মদিনা আক্রমন করে তিন দিন ধরে মসজিদে নববীসহ সর্বত্র তান্ডব এবং তৃতীয় বছর মক্কা অবরোধ করে মিনজানিক দিয়ে কাবাঘরে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করে কাজেই এসব ঘটনার নায়ক এজিদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার সুযোগ নেই।