ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহানবীর শেষ রাতের আমল

শরিফ আহমা
মহানবীর শেষ রাতের আমল

কোরআনের আলোকে রাতের নামাজ

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তার জীবনযাপন ও ইবাদতের পদ্ধতি ছিল অনুপম। তিনি দিনের পাশাপাশি রাতেও অধিক সময় ইবাদত করতেন। রবের সান্নিধ্যের সৌরভে ডুবে থাকতে পছন্দ করতেন। প্রথমে তার উপর তাহাজ্জুদ নামাজ ফরজ ছিল। এ প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে, হে বস্ত্রাবৃত! রাত জাগরণ কর কিছু অংশ ব্যতীত। অর্ধরাত কিংবা তদপেক্ষা কিছু কম। অথবা তদপেক্ষা বেশি। আর কোরআন তিলাওয়াত কর ধীরে ধীরে স্পষ্টকরে সুন্দরভাবে। আমি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি গুরুত্বপূর্ণ বাণী। (সুরা মুযযাম্মিল : ১৫)।

আল্লাহতায়ালা স্বীয় নবী (সা.) কে নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি যেন রাতে কাপড় মুড়ি দিয়ে শয়ন করা পরিত্যাগ করেন এবং রাতে তাহাজ্জুদের সালাতে দাঁড়িয়ে তার রবের কাছে প্রার্থনা করেন। রাসুল (সা.) সারা জীবন তাহাজ্জুদের বিধান পালন করেছেন।

তাহাজ্জুদ নামাজের বিধান

তাহাজ্জুদ নামাজ কোরআন দ্বারা প্রমাণিত। পরবর্তী সময়ে ফরজের বিধান রহিত হয়ে নফল হয়ে যায় ।? এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে এসেছে ,আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে; এটা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য; আশা করা যায় তোমার রব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে। (সুরা বনি ইসরাইল : ৭৯)।

এ সম্পর্কে হাদিসের কিতাবে এসেছে, হজরত সাদ বিন হিশাম (রহ.) বলেন, আমি বললাম হে উম্মুল মুমিনীন! আপনি আমাকে রাসুল (সা.)-এর আখলাক চরিত্র বিষয়ে কিছু বলুন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, তুমি কি কোরআন পড়ো না? রাসুল (সা.)-এর আখলাক চরিত্র কোরআনে যা আছে তাই ছিল। তারপর সাদ বলেন, আপনি আমাকে রাসুল (সা.) এর রাতের নামাজের ব্যাপারে বলুন। তখন আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন তুমি কি ইয়া আইয়্যুহাল মুজ্জাম্মিল পড়ো না? হজরত সাদ বলেন, হ্যাঁ আমি পড়ি তো। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন যখন এ সুরার প্রথমাংশ নাজিল হয় (যাতে তাহাজ্জুদ ফরজ হয়) তখন সাহাবায়ে-কেরাম এত দীর্ঘ তাহাজ্জুদ পড?তেন যে, তাদের পা ফুলে যেত। আর এ সুরার শেষাংশ বারো মাস পর্যন্ত আসমানে আটকে থাকে। ১২ মাস পর যখন এর শেষাংশ নাজিল হয়, তখন যে তাহাজ্জুদ ফরজ ছিল তা নফল হয়ে যায়। (সুনানে আবু দাউদণ্ড১/১৮৯-১৯৯)।

মহানবীর শেষ রাতের নামাজ

খুশখুযু এবং পূর্ণ ধীরস্থতার সঙ্গে নামাজ পড়ার মূর্ত প্রতীক ছিলেন নবীজি (সা.)। তার নামাজের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে একাধিক হাদিস রয়েছে। হজরত মুগীরা (রা.) বলেন, মহানবী রাতের নামাজে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তার কদম মোবারক ফুলে যেত। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, আপনি এমন কেন করেন? অথচ আপনার অতীতের ভবিষ্যতের সব গোনাহ ক্ষমা করা হয়েছে। তিনি প্রতিউত্তরে বলেছেন, আমি কি কৃতজ্ঞশীল বান্দা হবো না? (বোখারি ও মুসলিম)। হাদিসে আরো এসেছে, হুমাইদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রহ.) বলেন, একদা নবী করীম (সা.)-এর সাহাবীদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে এক সফরে থাকাবস্থায় মনে মনে বললাম, আল্লাহর কসম! আজ আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নামাজের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করব, যাতে তার কার্যধারা দেখতে পারি। (দেখলাম,) তিনি যখন রাতে ইশার নামাজ পড়লেন, যাকে আতামাও বলা হয়ে থাকে, দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে রইলেন। তারপর জাগ্রত হলেন এবং দিগন্তের (আকাশের) দিকে চেয়ে কোরআনের এ আয়াত পাঠ করতে লাগলেন-

(অর্থ) হে আমাদের প্রভু! আপনি এসবকে অযথা সৃষ্টি করেননি থেকে এবং আপনি কখনো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেন না এ পর্যন্ত পৌঁছলেন। তারপর রাসুল (সা.) বিছানার দিকে ফিরলেন এবং সেখান থেকে মিসওয়াক বের করলেন। তারপর নিজের কাছে রক্ষিত একটি পাত্র থেকে পেয়ালায় পানি ঢাললেন এবং মিসওয়াক করলেন। অতঃপর দাঁড়ালেন এবং নামাজ পড়তে লাগলেন, এমনকি আমি ভাবলাম, তিনি যে পরিমাণ সময় ঘুমিয়েছিলেন সে পরিমাণ সময়ই নামাজে কাটালেন। তারপর দ্বিতীয়বার শুলেন এমনকি আমি ভাবলাম, তিনি যে পরিমাণ সময় নামাজে কাটিয়েছিলেন সে পরিমাণ সময়ই ঘুমিয়ে রইলেন। তারপর তিনি তৃতীয়বার জাগ্রত হলেন এবং আগে যেরূপ করেছিলেন সেরূপই করলেন, আর আগে যা বলেছিলেন তাই বললেন। মোটকথা, ফজর পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনবার এরূপ করলেন। (মেশকাত : ১১৪১)। তবে তিনি শেষ রাতে উঠে কত রাকাত নামাজ পড়তেন, এটা নিয়ে ৯, ১১ ও ১৩সহ বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়।

মহানবীর শেষ রাতের কান্না

সুরা তাওবার ৮২ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন কম হাসো আর বেশি বেশি কাঁদো। নবীজি (সা.) ও অনেক কান্না করতেন। এ সম্পর্কে হাদিস পাওয়া যায়। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) রাতের বেলা আমাকে বলতেন, হে আয়েশা আমাকে ছেড়ে দাও আমি আমার রবের ইবাদত করব। আমি বলতাম আল্লাহর শপথ, আমি আপনার নৈকট্য ভালোবাসি এবং আপনাকে যা আনন্দ দেয় তা ভালোবাসি। তিনি উঠে পবিত্র হয়ে নামাজ পড়তেন। এরপর তিনি এত কাঁদতেন যে তার কাপড় ভিজে যেত। তিনি আরো কাঁদতেন যে দাড়ি ভিজে যেত। অতঃপর, বেলাল (রা.) এসে তাকে নামাজের জন্য ডাকতে এসে দেখেন যে, তিনি কান্না করছেন। তখন তিনি জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আপনি কাঁদছেন কেন? অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সব গোনাহ ক্ষমা করেছেন? তখন তিনি বলতেন, আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না। আজ রাতে এই আয়াত (সুরা আল ইমরানের ১৯০ নম্বর আয়াত) অবতীর্ণ হয়েছে। ওই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস যে তা পড়েছে; কিন্তু তা নিয়ে চিন্তা করেনি। (ইবনে হিব্বান : ৬২০)।

নবীজির শেষ রাতের আমল

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) রাতের শেষ ভাগে তাহাজ্জুদ এবং বিতির নামাজ আদায় করতেন?। বিভিন্ন দোয়া ও কান্নাকাটি করতেন। আর এগুলোর আগে তিনি তাসবিহও পাঠ করতেন। এ সম্পর্কে একটি হাদিস, শারিক হাওযানি (রহ.) বলেন, আমি একদিন আয়েশা (রা)-এর কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন রাতে জাগতেন তখন কী কাজ শুরু করতেন? আয়েশা (রা.) বললেন, তিনি যখন রাতে জাগতেন ১০বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলতেন, ১০বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতেন, ১০বার ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’ বলতেন, ১০বার ‘সুবহানাল মালিকিল কুদ্দুস’ বলতেন, ১০বার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলতেন, ১০বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতেন। এরপর ১০বার বলতেন, আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন দীকিদ দুনইয়া ওয়া দীকি ইয়াওমিল কিয়ামাতি, তারপর নামাজ শুরু করতেন। (আবু দাউদ, মেশকাত, হাদিস : ১১৪৮) নবীজি (সা.) সব কাজে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতেন। রাতকে তিনি তিন ভাগে বিভক্ত করে কিছুটা সময় বিশ্রাম নেওয়া, আপনজনের অধিকার আদায় করা এবং অবশিষ্ট সময় প্রভুর প্রেমে অতিবাহিত করতেন। তাই প্রত্যক উম্মতের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নববী আদর্শের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : কবি ও আলেম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত