ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সাহাবিদের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন পদ্ধতি

মাহমুদ হাসান ফাহিম
সাহাবিদের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন পদ্ধতি

ইসলাম একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ইসলামের বিধান সর্বযুগের সব মানুষের জন্য স্থায়ীভাবে প্রজোয্য। যা চিরকল্যাণময়ও। মূলত একত্ববাদের মূল দর্শনের ওপরেই গড়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবন ব্যবস্থার মূল ভিত। একমাত্র ইসলামি খেলাফত ব্যবস্থাই বিশ্বমানবতাকে এক শান্তিময় সমাজ উপহার দিয়েছে। যা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। উল্লেখ্য যে, মানুষের সমাজ জীবনসহ তাদের সামগ্রিক জীবনকে পূর্ণরূপ সুন্দর, সুবিন্যস্ত ও শান্তিময় করার উদ্দেশ্যে যতগুলো সংস্থা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তন্মধ্যে রাষ্ট্রই হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোচ্চ সংস্থা। আর নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, জনসমষ্টি, সরকার ও সার্বভৌমত্ব হলো একটি রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদান।

খেলাফতের পরিচয়: ‘খেলাফত’ একটি আরবি শব্দ যা ইমারত, ইমামত, শাসন, কর্তৃত্ব প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত। ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও আইনগত কর্তৃত্বকে মেনে নিয়ে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাকে ইসলামি পারিভাষায় খেলাফত বলা হয়। ব্যাখ্যাতাগণ এ বিষয়ে অনেক বিশ্লেষণ করেছেন। তবে এক কথায় খেলাফত হচ্ছে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর আদর্শ বাস্তবায়নের প্রতিনিধিত্ব।

খলিফা পরিচিতি: ‘খলিফা’ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ প্রতিনিধি। ইসলামি পরিভাষায় খলিফা হলেন এমন ব্যক্তি, যিনি শরিয়ত অনুযায়ী তার অধীনদের পরিচালনা করেন। ইসলামি রাষ্ট্রে খলিফা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে গভর্নর, শাসক ও কাজি (বিচারক) নিযুক্ত করেন। (আহকামুস সুলতানিয়্যাহ:১৭)। এক কথায়, (নির্দিষ্ট গুণের অধিকারী) রাষ্ট্রপ্রধানকে ইসলামি পরিভাষায় খলিফা বলা হয়।

খলিফার যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য: ইসলামের একটি স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য হলো, খলিফা বা প্রতিনিধির গুণের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তির মাঝে এই বৈশিষ্ট্যগুলো পূর্ণরূপে না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ সে খলিফা হতে পারবে না। ওলামায়ে কেরাম এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। নিচে খলিফা তথা রাষ্ট্রপ্রধানের বৈশিষ্ট্যাবলি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:

এক. মুসলিম হওয়া। দুই. বুঝমান, প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ বিবেকের অধিকারী হওয়া। তিন. পুরুষ হওয়া। চার. স্বাধীন হওয়া। পাঁচ. ন্যায়পরায়ণ হওয়া। ছয়. জ্ঞান (ইলম তথা ইজতিহাদ করার যোগ্যতা) থাকা। সাত. কোরাইশ বংশীয় হওয়া। অবশ্য অ-কোরাইশের কেউ ইমাম বা খলিফা নির্বাচিত হয়ে গেলে তার খেলাফতও কার্যকর সাব্যস্ত হবে।

(ইযালাতুল খাফা ১/৩২-৩৩, হাশিয়া আলাল গিয়াসি: ৮৬, ইসলাম ও রাজনীতি : ২২৮)।

খলিফা নির্বাচনের পদ্ধতি: নবী (সা.) খলিফা হিসেবে কারো নাম ঘোষণা করেননি। তিনি নির্বাচনের বিষয়টি সাহাবায়ে কেরামের ওপর ছেড়ে গেছেন। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, খলিফা নির্বাচন করার বিষয়টি মুসলমানদের রায়ের ওপর ন্যস্ত। পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম খলিফা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করেছেন তা চার প্রকারে বিভক্ত।

এক: মৌন নির্বাচিত ব্যক্তির খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ

ইসলামি পরিভাষায় একে ‘বাইআতু আহলিল হল ওয়াল আকদ’ বলা হয়। কেননা যারা নায়েব বা প্রতিনিধি তাদের হাতেই দীনি ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত। এক্ষেত্রে যার ভূমিকা বেশি তিনিই হবেন প্রথম খলিফা। সিদ্দিকে আকবার হজরত আবু বকর (রা.) এই পদ্ধতিতে খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন।

দুই: খলিফা কর্তৃক খলিফা নির্বাচন

খলিফা নিজেই তার পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করে যাওয়া। ন্যায়পরায়ণ, জনকল্যাণকামী, নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে তার পরবর্তী খলিফা ঘোষণা করা এবং তার আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া। এই পদ্ধতিতে খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন হযরত ওমর ফারুক (রা.)।

তৃতীয়: শূরা সদস্যদের পরামর্শে নির্বাচন

হজরত ওমর (রা.) তার পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিকেই খলিফা নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হয়। তারা হজরত উসমান (রা.) কে নির্বাচন করেন। হজরত উসমান (রা.) শাহাদাতবরণ করার পর তারা হজরত আলী (রা.) এর কাছে উপস্থিত হয়ে তার হাতে বাইআত গ্রহণ করেন।

চতুর্থ: বলপ্রয়োগ বা প্রাধান্য বিস্তারের নিমিত্তে দায়িত্ব গ্রহণ

খলিফার মৃত্যুর পর জনগণের আনুগত্য ছাড়া এবং খলিফার উত্তরাধিকার তথা মনোনয়ন ব্যতীত তা গ্রহণ করা। যদি শরিয়ত মোতাবেক খেলাফত চালিয়ে নেয়, তহলে তার আনুগত্য করাও ওয়াজিব। (ইযালাতুল খাফা ১/৩৬-৩৭, ইসলাম আওর সিয়াসি নযরিয়্যাত সূত্রে ইসলাম ও রাজনীতি: ২৩৬-২৪৪)।

পঞ্চম: খেলাফত একটি দায়িত্ব, অধিকার নয়

কোরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা অনুযায়ী হুকুমত একটি দায়িত্ব, এমন কোনো অধিকার নয়, যা হাসিল করার জন্য মানুষ চেষ্টা চালাবে। এজন্য রাসুল (সা.) বলেছেন, ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান) দায়িত্বশীল। যেই দায়িত্ব তার কাঁধে অর্পণ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। (বোখারি : ৮৯৩)।

এই ধারণার অত্যাবশ্যক ফলাফল হচ্ছে, একে এমন একটি দায়িত্ব ও কর্তব্য জ্ঞান করতে হবে, যা থেকে দূরে থাকাই উত্তম। তবে যদি প্রয়োজনে কোনো ব্যক্তির ওপর তা চেপে বসে, তাহলে একে একটি আমানত ও জিম্মাদারি মনে করে আঞ্জাম দিবে।

ষষ্ঠ: খলিফার কাজ

খলিফার দায়িত্ব হলো, শরিয়তে মুহাম্মদি (সা.) এর পূর্ণ বাস্তবায়ন করা। ধর্মদ্রোহী, মুরতাদ ও বেদয়াত সৃষ্টিকারীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। তার অবশ্যকর্তব্য হলো, দীনের নিদর্শন: জুমা, জামাত, জাকাত, সিয়াম, হজ ইত্যাদি পাবন্দির সঙ্গে পালনের ব্যবস্থা করা। জাকাত উসুল করা। হজের আনুষ্ঠানিকতা পরিচালনার জন্য ইমাম নিয়োগ করা। প্রয়োজনীয় দীনি ইলম (জ্ঞান) শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং ইসলামি সভ্যতা সংস্কৃতি রক্ষার্থে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। মানুষের মধ্যে সংঘটিত ঝগড়া বিবাদ নিরসনের জন্য বিচার বিভাগ তৈরি করা। দণ্ডবিধি বাস্তবায়ন করা। এককথায়, মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য যা যা প্রয়োজন সবকিছুর সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা খলিফার দায়িত্ব। (ইযালাতুল খাফা: ১/৩৯, ইসলাম ও রাজনীতি: ১৮৭-২০২)।

সপ্তম: খেলাফত প্রশ্নে মতানৈক্য

মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকও পাওয়া যায়, যারা নবী করীম (সা.) এর খলিফা (স্থলাভিষিক্তরা) সম্পর্কে উদ্ভট উদ্ভট আপত্তি উত্থাপন করে। কাউকে অপরাধী ও জালিম এবং কাউকে নিষ্পাপ ও মজলুম সাব্যস্ত করে। অথচ খেলাফত সম্পর্কে মানুষের অভিযোগ বা আপত্তি উঠানোর কোনো অধিকার নেই। আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর রাজত্ব ও খেলাফত কাউকে দান করা বা কারো থেকে ছিনিয়ে নেওয়া একান্তই তার বিষয়। বাহ্যিকভাবেও খেলাফত দান বা তা ছিনিয়ে নেওয়ার কাজকে কোনো মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করেননি। আর এ কারণেই স্বয়ং নবী করীম (সা.)ও খলিফার নির্বাচন ও নিযুক্তি সম্পর্কে কোনো নির্দেশ দেননি।

অষ্টম: মধ্যপন্থা অবলম্বন

সাহাবিদের মধ্যে যারা খলিফা নির্বাচিত হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ যোগ্যতা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এ নিয়ে তর্ক করা অবান্তর। মুসলমানদের মাঝে সর্বপ্রথম খেলাফতের উপযুক্ত কে এবং তারপর কে, আল্লাহতায়ালা স্বয়ং তাঁর নিপুন কাজের দ্বারা তা বাতলে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে লড়াই ঝগড়া করা ও প্রশ্ন তোলা একেবারে অবান্তর। যা আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে অভিযোগ করারই নামান্তর। নবী করীম (সা.) এর পর কার খলিফা হওয়া উচিত ছিল? তার জবাব পরিষ্কার, যিনি খলিফা হয়েছেন, তারই। একথা বলার অধিকার কারো নেই, যিনি খলিফা হয়েছেন, তিনি খলিফা হওয়ার উপযুক্ত নন। অন্য দৃষ্টিকোণে একথা বলার অনিবার্য পরিণতি এই দাঁড়ায়, তাহলে কী খলিফা আল্লাহতায়ালা বানাননি? নাকি আল্লাহ যাকে খলিফা বানাতে চেয়েছেন, তাকে বানাতে পারেননি? এতে মানবীয় ফন্দি-কৌশলের কাছে (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহতায়ালা পরাজিত হন। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলুন, হে আল্লাহ! সার্বভৌম শক্তির মালিক! তুমি যাকে চাও ক্ষমতা দান কর, আর যার থেকে চাও ক্ষমতা কেড়ে নাও। যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর এবং যাকে চাও লাঞ্ছিত কর। সব কল্যাণ তোমারই হাতে। নিশ্চয়ই তুমি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান।’ (সুরা আলে ইমরান: ২৬) (তারিখুল ইসলাম, আকবর শাহ নজিবাবাদী: ২৩৯-২৪০)। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ, জনগণের অধিকার আদায়, দেশ ও জনতার নিরাপত্তা প্রদান এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ শান্তিময় জীবন ব্যবস্থা গঠন ও পরিচালনার জন্যই মূলত রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা হয় এবং এ কাজগুলো আঞ্জাম দেওয়াই রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধান দায়িত্ব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত