ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জান্নাতের মেহমান

সায়ীদ উসমান
জান্নাতের মেহমান

রাসুল (সা.) তাকিয়ে আছেন অবাক চোখে। এক পৃথিবী নিঃশব্দ বিস্ময় ঠিকরে বেরুচ্ছে তার আলোকময় চোখ থেকে। এও কি সম্ভব! এ কী দেখছেন তিনি! এ কী অদ্ভুত অলৌকিক দৃশ্য! উহুদে শহিদ সাহাবাদের দাফন কাফনের প্রস্তুতি পর্ব। ব্যাকুল মৌমাছির মতো রাসুলে আরাবি (সা.)-কে ঘিরে থাকত যারা সেই সব নক্ষত্রদের কয়েকজন আজ অনন্তকালের পথযাত্রী। শাহাদাতের পেয়ালায় ঠোঁট ছুঁইয়ে তারা আজ অনন্ত পৃথিবীর বাসিন্দা। তাদের বিয়োগে আজ তিনি যন্ত্রণার কাফনে বন্দি। হাহাকারের দমকা হাওয়া তার ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। হৃদয়ের কোষে কোষে বেজে চলেছে বেদনার সুর। তার মমতা ও ভালোবাসার অগণিত ঝরনা আজ রূপ নিয়েছে বেদনার প্রস্রবণে। তাই শোকাভিভূত হৃদয় নিয়ে তিনি তদারক করছিলেন কাফন পর্ব। অদ্ভুত দৃশ্যটি তখন থমকে দিল তাকে। তিনি দেখতে পেলেন আকাশের বাসিন্দা ফেরেশতাদের। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন এক শহিদের লাশ নিয়ে। পরম মমতা আর ভালোবাসায় গোসল দিয়ে চলেছেন তাকে। রাসুলে আরাবি (সা.) নির্বাক। হৃদয় অলিন্দের অগুনতি বিস্ময় কৌতূহলী হয়ে বেরিয়ে আসছে চোখের ঝরনা বেয়ে। এ কার লাশ! বুকের ভেতর দাপাদাপি করে প্রশ্নের ঝড়। আরেকটু কাছাকাছি হন রাসুলে আরাবি (সা.)। আর্দ্র চোখের কোমল দৃষ্টি ফেলেন লাশের ওপর। এবার চিনতে পারেন তিনি। ভোরের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার পরিচয়। ‘এতো আমার হানযালার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) লাশ। আমার হানযালা’!

দুঃখের মাঝেও মুচকি হাসেন রাসুলে আরাবি (সা.)। ঠোঁটের কোণ বেয়ে নেমে আসে চাঁদের আলো। যেন আঁধারের মাঝে একটু আলোর ঝলকানি। দাফন কাফনে ব্যস্ত সহচরদের লক্ষ্য করে খুশি আর উচ্ছ্বাসের চূড়ান্ত স্ফূরণ ঘটিয়ে বলে ওঠেন রাসুলে আরাবি (সা.)-‘কই তোমরা! দেখে যাও হানযালার সৌভাগ্য।’ রাসুলে আরাবি (সা.)-এর এ শব্দমালা মহাশূন্যকে আন্দোলিত করার আগেই আবারো ঝরে পড়ে আরো একগুচ্ছ পবিত্র শব্দরাশি- ‘দেখে যাও, ফেরেশতারা গোসল দিচ্ছে আমার হানযালাকে’। কাছেই দাফন কাফনে ব্যস্ত সায়েদী রাদিআল্লাহু আনহু সচকিত হলেন। তার কানেই প্রথম আছড়ে পড়েছে রাসুলে আরাবি (সা.)-এর শব্দমালা। ‘শহিদের লাশের গোসল! সেও আবার দিচ্ছে ফেরেশতারা! এও কি সম্ভব?’

সম্ভব, মনে মনে বলে উঠেন তিনি। রাসুলে আরাবি (সা.)-এর কথা অসম্ভব হওয়াই তো আরেক অসম্ভব। ব্যস্ততা রেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন শহিদ হানযালা (রা.)-এর লাশের দিকে। অদ্ভুত দৃশ্যটি চোখে পড়ল তারও। সেটা তাকে চমকে দিয়ে থমকে দিল। বিস্ময়ের গরম লু হাওয়া ঝাপটা মারল তাকে। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। ‘টপ টপ করে পানি ঝরছে হানযালা (রা.)-এর মাথা থেকে। সদ্য ডুব দিয়ে ওঠা মানুষের মতো ভেজা গাঁ, ভেজা মাথা।’ যেন এই মাত্র গোসল সেরেছেন তিনি।

২.

কাফনের পর দাফন পর্ব সমাপ্ত। আজন্ম সহচর তারকা নক্ষত্রদের ঘুম পারিয়ে রেখে ফিরে চললেন রাসুলে আরাবি (সা.)। বিচ্ছেদ বেদনা ডানাভাঙা পাখির মতো ঝাপটে যাচ্ছিল তার কোমল হৃদয়ে। সেইসঙ্গে একঝাঁক প্রশ্নের তীর ধীরলয়ে বিদ্ধ করছিল তাকে। ‘কী এমন আমল করেছিল হানযালা। কেনোইবা আসমানের বাসিন্দারা তাকে নিয়ে করেছে পবিত্র আয়োজন। কেনো ওরা গোসল করিয়েছে তাকে। আল্লাহর এ কোন রহস্যময়তা! জানতে হবে! জানতে হবে এর কূলকিনারা!’ দৃঢ় পায়ে হেঁটে চলেছেন রাসুল (সা.)। গন্তব্য শহিদ হানযালা (রা.) এর বাড়ি।

৩.

বাসররাত। যৌবনের প্রথম প্রহরে বিয়ের নহরে ডুব দিলেন তিনি। সুখণ্ডপুলকের অজস্র মণি-মুক্তো তুলে আনলেন আনসার এই যুবক। নব পরিণিতা স্ত্রীর বাহুডোরে বিয়ের প্রথম মধুলগ্ন বাসররাত উদযাপন করলেন হানযালা (রা.)। এবার পবিত্রতার আয়োজনের পালা। ফুলশয্যার সুখবোধ ঝেড়ে ফেলে দুজনেই উঠে এলেন কুয়ার কাছে। বসলেন। স্ত্রী পানির পাত্র তুলে নিলেন হাতে। ভালোবাসার লক্ষ-কোটি আবেগ মিশিয়ে পবিত্র পানির ধারা বইয়ে দিলেন স্বামীর মাথায়। তখন হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে গেলেন হানযালা রাদিআল্লাহু আনহু। থামিয়ে দিলেন স্ত্রীর হাত।

‘ওগো! শুনতে পাচ্ছ কিছু?’ ‘হ্যাঁ, কি যেন ঘোষণা করে চলেছে ঘোষক।’ দূর থেকে ভেসে-আসা অস্পষ্ট ঘোষণা স্পষ্ট হতে হতে আছড়ে পড়ল হানাযালা রাদিআল্লাহু আনহুর কানে।

‘চলো চলো জিহাদে চলো। উহুদের ময়দান সামর্থবান যুবকদের ডাকছে। চলো চলো...’

জিহাদের কোকিল যেন গেয়ে উঠল জিহাদের আবেগি গান। হানযালা (রা.) এর হৃদয়ের প্রতিটি কোণে বেজে উঠল প্রভু-প্রেমের সুর। শাহাদাতের ব্যাকুলতা হাহাকার ছড়িয়ে দিল হানযালা (রা.) এর মনতন্ত্রিতে। তরবারি হাতে সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন উহুদ অভিমুখে। যাওয়ার সময় কী সদ্য বাহুডোরে বাঁধাপড়া প্রেয়সীকে মনে পড়েছিল তার? হঠাৎ জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠা প্রিয়জনের ভালোবাসা কী একবারও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যাওয়ার পথে? নববধূর বিচ্ছেদণ্ডবেদনা একপশলা হাহাকার হয়ে তীরের ফলার মতো বেঁধেনি তার বুকে? নাকি আল্লাহর ভালোবাসার কাছে আর সব ভালোবাসা তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল? আল্লাহ প্রেমের পবিত্র বন্যায় আর সব প্রেম খড়কুটোর মতো গিয়েছিল উড়ে? ইতিহাস সাক্ষী, আল্লাহর পথে আত্মোৎসর্গের অপার্থিব ঝর্ণাধারায় স্নাত হওয়ার বাসনায় স্ত্রীর ভালোবাসার সব মায়াজাল ভুলে তিনি ছুটে গিয়েছিলেন উহুদের ময়দানে।

৪.

হানযালা রাদিআল্লাহু আনহুর জীবন যৌবনের সব মায়া বন্ধন এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে প্রবেশ করলেন উহুদ প্রান্তরে। সেখানে তখন হাজারো তরবারির ঝনাৎকার। আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে চলেছে। হক বাতিলের মীমাংসার লড়াইয়ে হানযালার (রা.) তরবারিও আজ ঝলসে উঠেছে শৈল্পিক ভঙ্গিমায়। লড়তে লড়তে হানযালা (রা.) হারিয়ে গেলেন হাজারো তরবারির শামিয়ানার নিচে। মক্কার এক কাফেরসর্দার পড়ে গেল তার সামনে। প্রত্যয়দর্পী হানযালা রাদিআল্লাহু আনহুর তরবারি ঝলসে উঠল আরো আঁধার বিনাশী-আলোর প্রসারী হয়ে। তখন হঠাৎ অপরদিক থেকে হানযালা (রা.)-কে আঘাত করল অন্য এক কাফের। পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়াল মুহূর্তেই। রোদ তাতানো মধ্যদুপুরে হঠাৎ যেন নেমে এলো নিঝুম নিশুতিরাত। ঢলে পড়লেন হানযালা (রা.)। শাহাদাতের অজস্র সুখ বুক ভরিয়ে দিলো তার। জান্নাতের রাশি রাশি প্রাচুর্যভরা উদ্যান স্বাগত জানাল তাকে। স্বর্গ উদ্যানের প্রশস্ত আকাশে গুঞ্জরিত হলো তার আগমণ ধ্বনি। পৃথিবীর একপ্রস্থ ইতিহাস আরো সমৃদ্ধ হলো তার শাহাদাতের বর্ণিল বর্ণনায়।

লেখক: আলেম, কবি ও গল্পকার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত