নবীজীবন সুস্থ চেতনার বাতিঘর
মাহমুদ হাসান ফাহিম
প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
রাসুল (সা.)-এর জীবনী শুধু নবীপ্রেমীদের প্রিয় প্রসঙ্গই নয় বরং মোমেনের জীবনের প্রিয় পাঠ ও পাঠ্যবিষয়। প্রেরণার মিষ্টি মিষ্টি অনুভবের পাতায় পাতায়। ভালোবাসার আলতো পরশের বাক্যে বাক্যে। পাঠজুড়ে হৃদয় প্রশান্তির উপায় উপকরণ। বছরের নির্দিষ্ট কোনো সময়ে নয় বরং সচেতন আশেকে রাসুলরা নিজেদের পাঠ তালিকায় সবসময়ই প্রথমে রাখেন সীরাত প্রসঙ্গ। কেননা, সীরাত তথা নবী (সা.)-এর জীবনী পাঠে রয়েছে সফল ও সার্থক জীবন গঠনের নির্দেশনা। সুস্থ-চেতনার শাণিত পাঠ। রাসুল (সা.) মোমেনের চেতনার বাতিঘর।
সীরাত কী?
সীরাত বলতে প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনীকে বোঝায়। সীরাত হলো, প্রিয়নবীর জীবনী, তাঁর জন্ম, তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, আচার-আচরণ, বৈশিষ্ট্য। এককথায় তাঁর যাপিত জীবনের আদর্শ। তার সুখণ্ডদুঃখ, কান্নাহাসি, সংসার জীবন, দাওয়াতি জীবন, রাষ্ট্র পরিচালনার বিবিধ কার্যক্রম, সামাজিকতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, ইবাদতের নানান দিক, দীন বিজয়ের যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও অভিযান পরিচালনা তথা নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সমগ্র জীবনীই সীরাত।
সীরাত পাঠের উপকারিতা
হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদুল মিল¬াত হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.) সীরাত পাঠের উপকারিতা বর্ণনা করে লিখেন, সীরাত অধ্যয়নের দ্বারা নিজের নবী (সা.)-এর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরিচিতি লাভ হয়। আর এ পরিচিতির মাধ্যমে অনিবার্যভাবে সৃষ্টি হয় প্রিয় নবীর প্রতি ভালোবাসা। যার সত্য প্রতিশ্রুতিতে লাভ হবে জান্নাতে তাঁর সঙ্গ ও সান্নিধ্য। আর এটা যে এক মহা নেয়ামত তাতে কি কারো দ্বিমত আছে? (ভূমিকা, সীরাতে মুস্তফা হজরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী)।
সীরাত কেন পড়ব?
আমাদের জন্য রাসুল (সা.)-এর সীরাত অধ্যয়ন শুধু জ্ঞানবৃদ্ধির বিষয়ই নয়, এটা আমাদের দীনি প্রয়োজন। কেননা, মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা প্রিয়নবী (সা.)-কে স্পর্শ করেনি। ব্যবহারিক, আধ্যাত্মিক, ইহকালীন, পরকালীন সব কিছুই তাঁর জীবন ও সাধনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। ফলে তাঁর জীবনাদর্শ মানবজাতির জন্য অনুপম আদর্শ। জীবন-পথে আলোর মশাল ও চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই রাসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে অনুপম আদর্শ (এমন ব্যক্তির জন্য) যে আল্লাহ ও আখেরাত দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করে।’ (সুরা আহযাব : ২১)।
দৃঢ় ঈমানের সোনালি সোপান
পবিত্র সীরাত পাঠের অনন্য প্রাপ্তি হচ্ছে ঈমান বৃদ্ধি। প্রাচীন ও আধুনিক যুগের ইতিহাস সাক্ষী যে, পবিত্র সীরাত যুগে যুগে অসংখ্য মানুষকে ঈমানের পথ দেখিয়েছে। নবী (সা.) এর ওপর নাজিল হওয়া কোরআন, যার আলোয় উদ্ভাসিত তাঁর বাস্তব জীবন, তাঁর অনন্য চরিত্র মাধুর্য, তাঁর মহত্ব, মহানুভবতা যুগে যুগে অসংখ্য মানুষকে ঈমান ও বিশ্বাসের স্নিগ্ধ ছায়াতলে নিয়ে এসেছে। তাঁর পবিত্র জীবন তাঁর নবুওয়াত ও রিসালাতের এক দেদীপ্যমান প্রমাণ, যার প্রভাব কোনো ন্যায়-নিষ্ঠ হৃদয় ও মস্তিষ্ক এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই তাঁর পবিত্র জীবন ও কর্ম ঈমানের আলো বঞ্চিত প্রত্যেক ন্যায়-নিষ্ঠ মানবের ঈমান লাভের মাধ্যম আর ঈমানের আলোপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবান মানবের ঈমান বৃদ্ধির উপকরণ।
বাহ্যিক সৌন্দর্য লাভ
সভ্য, ভদ্র ও সুন্দর মানুষ হতে চাইলে বাহ্যত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুসজ্জিত করা অপরিহার্য। অন্যান্য গুণাবলি যতই উচ্চমার্গের হোক না কেন, যদি বাহ্যিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিপাটি না হয়, তবে সে মানুষ কখনই সভ্যজনদের মধ্যে গণ্য হয় না। এর জন্য চাই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিচর্যা তথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। চুল, দাড়ি, নখ ইত্যাদির ব্যাপারে যত্নবান হওয়া। সেইসঙ্গে মার্জিত পোশাক-আশাকও-এর অপরিহার্য অনুষঙ্গ। এসব বিষয়ে সুরুচি ও মহাকালীন শালীনতার পাঠ রয়েছে রাসুলের (সা.) জীবনে।
পরিশুদ্ধ অন্তরের দীপ্তি
বাহ্যিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গের চেয়ে মানুষের হৃদয়জগৎ বেশি মূল্যবান। এটাই তার প্রকৃত সত্তা, বহু গুণের লালন ক্ষেত্র ও বিপুল সম্ভাবনার বিচিত্র ভুবন। এখানে চাষবাস করে যথার্থ পরিচর্যা করলে মানুষ প্রকৃত অর্থে মানুষ হতে পারে। আবার অবহেলার ফলে এখানে এত আগাছা ও পশুবৃত্তি জন্ম নেয়, যা মানুষকে পরিণত করে হিংস্রতম হায়েনায়। নবী জীবনের প্রকৃত শিক্ষা কেউ তার ভেতরে ধারন করতে পারলে সে কখনো এরূপ হিংস্র বা হায়েনা হতে পারে না। তাই বলা চলে সীরাতপাঠ মানুষকে সভ্য মানুষে পরিণত করে।
মানবতার শিক্ষা
মানুষের জীবনে মানবতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার মাঝে মানবতা নেই সে কারও উপকারে আসে না। প্রিয়নবী (সা.)-এর জীবন থেকে আমরা মৌলিকভাবে মানবতার শিক্ষাই পাই। জাহেলিয়াতের নিকষ অন্ধকার যখন পৃথিবীকে গ্রাস করতে বসেছিল, সেই চরম দুর্দিনে হেদায়াত ও সংস্কারের এক আলোকবর্তিকা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন তিনি। হেরার আলোকরশ্মি দিয়ে মহান এক সভ্যতা বিশ্বের মানুষকে শিখিয়েছেন। মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখতে সমাজের সবপর্যায়ে মানবাধিকারের এমন এক নমুনা পেশ করেন, যা আজও জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে গোটা বিশ্বের কাছে অনন্য হিসেবে স্বীকৃত।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে নবী (সা.) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। তাঁর মধ্যে মানবিক সব বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। মহান আল্লাহ তাঁকে নিজ অসীম জ্ঞানের ভাণ্ডার থেকে দান করেছেন জ্ঞানের আধার।’ (সুরা নামল : ৬)।
আমলের যাচাই নিক্তি
আমরা যে কাজগুলো করি, সেগুলো রবের আদেশ বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট কিনা এবং তা আমাদের পরকালীন কল্যাণ বয়ে আনবে কিনা তার যাচাইয়ের জন্য একমাত্র মাধ্যম হলো নবী জীবন। প্রিয় নবী (সা.) তার যাপিত জীবনে আমাদের জন্য আদর্শ রেখে গেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর আনুগত্যের সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়নবীজির আনুগত্যের কথাও ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘রাসুল তোমাদের যা করতে বলেন তা করো, আর যা থেকে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা। (সুরা হাশর : ০৭)। রাসুল (সা.)-এর নির্দেশগুলোও কোরআনের নির্দেশের ন্যায় অবশ্য পালনীয়। অনেক সাহাবি আয়াতের ব্যাপক অর্থ অবলম্বন করে রাসুল (সা.)-এর প্রত্যেকটি নির্দেশ কোরআনের নির্দেশের অনুরূপ অবশ্য পালনীয় সাব্যস্ত করেছেন। (তাফসিরে মাআ’রেফুল কোরআন)। সুতরাং আমরা যদি তাঁর উত্তম আদর্শ গ্রহণ করে তাঁর বাতলানো পদ্ধতিতে আমল করতে পারি, তাহলে তা-ই হবে আমাদের নাজাতের উসিলা। তিনিই মোমেনর অনুসৃত, পথিকৃৎ। তাঁর জীবনী ও নির্দেশনা মোমেনের সফলতার রাজতোড়ন।
নিঃসন্দেহে নবীজীবনী মোমিনের হৃদয়ে প্রশান্তির সমীরণ বয়ে আনে। হৃদয়ের উত্তাপ কমে যায়। নবীপ্রেমের ব্যথা বেদনা বাড়ে এবং প্রকৃত প্রেমিক তাঁর গুণ-সংবলিত বর্ণনায় সদাই প্রাণবন্ত থাকে। রাসুল (সা.) এর জীবনী পাঠে মানুষ পায় শান্তির ঠিকানা। সীরাত পাঠ করে বহু অমুসলিম মুসলমান হয়েছে। সীরাতের মাঝে রয়েছে এক অপার্থিব আনন্দ আর আকর্ষণবোধ। তাই প্রতিটি মোমেনের কর্তব্য হলো, সীরাত অধ্যয়ন করা। দৈনন্দিনের পাঠে একটি অংশ যেন সীরাত থাকে। তাহলে রাসুলের ভালোবাসা আমাদের হৃদয় মন আলোকিত করবে।