ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অসামান্য প্রেমের অশ্রু

সায়ীদ উসমান
অসামান্য প্রেমের অশ্রু

হায়েনারা ক্ষুব্ধ মাতাল। সিদ্ধান্ত তারা নিয়েই ফেলেছে। হত্যা করবে তাকে। সব গোত্র মিলে। একযোগে। এবার কী হবে তার! কেমন করে বাঁচবেন তিনি! সবাই চলে গেছে মক্কা ছেড়ে মদিনায়। মক্কায় তিনি একা। শুধু আলী আর আবু বকর রয়েছেন। না, আর পরে থাকা যাবে না মাতৃভূমিকে মায়া করে। এবার তাকে নিয়ে দুস্তরমরু পাড়ি দিতে হবে। সবার অগোচরে। অলক্ষে। চলে যেতে হবে দূরে, বহুদূরে। দাওস গোত্রের লোকেরা এসেছিল। তাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল সুরক্ষিত দুর্গে। তাদের তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন, ফুলফল জল ফসলে পূর্ণ এক বাগানভূমির। সুদৃশ্য এক নন্দনের।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রস্তুত। ৪ মাস আগ থেকেই। দ্রুতগামী দুটো উট কিনে রেখেছেন। তাকে নিয়ে পাড়ি জমাবেন সুদৃশ্য নন্দনে। তিনি আবু বকরের ঘনিষ্ঠ স্বজন। মেয়ে জামাতা। প্রাণপ্রিয় বন্ধু। বিশ্বজগতের ত্রাণকর্তা নবী আলাইহিস সালাম। মহান রবেরও তিনি প্রিয়তম। আজ তিনি এসেছেন আবু বকরের কাছে। নিশ্চয়ই, জরুরি কোনো কথা বলবেন। তাই হলো। তিনি বললেন- ‘আবু বকর! জরুরি কথা আছে আপনার সঙ্গে। কেউ থাকলে সরিয়ে দিন।’

‘হে আল্লাহর রাসূল, আলাইহিস সালাম, আয়েশা ছাড়া ঘরে কেউ নেই।’ ‘মহান রবের পক্ষ থেকে হিজরতের হুকুম পেয়েছি।’ আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহুর মন বিষণ্ন হয়ে উঠল। তার অন্তরতম প্রিয়নবী আলাইহিস সালাম কি একাই চলে যাবেন! তাকে রেখে! তার যদি কিছু হয়ে যায়! একা একা মরুভূমির সরু পথ মাড়াতে গিয়ে! তখন কে দেখাশোনা করবে তার! তার পোড়া চোখজোড়া জুড়াবে কাকে দেখে! আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন- ‘আমি কি আপনার সঙ্গী হওয়ার অনুমতি পেতে পারি?’ সম্মতি দিলেন নবী আলাইহিস সালাম। ‘হ্যাঁ, আপনি যাবেন আমার সঙ্গে।’ শুনে আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু’র মন স্থির হলো। পরম প্রশান্তির পরশ অনুভব করলেন বুকে। না, একা যাচ্ছেন না তিনি। তাকে সঙ্গে নিয়েই যাচ্ছেন। তার সীমাহীন আগ্রহ আজ পূর্ণতা পাচ্ছে। প্রতিক্ষার যন্ত্রণা বুঝি শেষ হচ্ছে। কত রাত নির্ঘুম কেটেছে তার! কখন আসেন তিনি! ডাকেন, উঠো! চলো আমার সঙ্গে! অনন্য সঙ্গী আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু। নবীজির সঙ্গী হচ্ছেন তিনি!

মক্কার হায়েনারা ঘিরে ফেলেছে তার বাড়ি। তাকে হত্যা করবে। মেরেই ফেলবে। কি করবেন। নবী আলাইহিস সালাম। পালিয়ে যাবেন! পিঠ দেখিয়ে! নাহ! হতেই পারে না! সূরা ইয়াসিনের ক’টি আয়াত পড়লেন তিনি। তারপর নিক্ষেপ করলেন, ধুলো আর কাকর মেশানো মুঠোভর্তি বালু। আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতারা সে সব ঢুকিয়ে দিল হায়েনাদের চোখে! হায়েনারা দাঁড়িয়ে রইল নিথর হয়ে। তিনি বেরুলেন। চলে গেলেন ওদের সামনে দিয়ে। এক্কেবারে বীরের মতো।

তার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। তাকে সঙ্গে নিয়ে চললেন সাওর গিরিপর্বত অভিমুখে। জায়গাটি মক্কা থেকে দক্ষিণে। প্রায় তিনমাইল দূরে। ওখানেই হবে প্রথম যাত্রাবিরতি। পথ বিপদাপদে ভরা। চোখা পাথর আর কাকর বিছানো। দুর্গম মরুময়। এই দীর্ঘপথ পাড়ি দিলেন তারা। গাঢ় অন্ধকার মাড়িয়ে। পৌঁছে গেলেন সাওর গিরিপর্বতের সামনে। না, প্রথমে নবী আলাইহিস সালামকে গিরিগুহায় নামতে দেয়া যায় না। যদি ময়লা-আবর্জনা থাকে ভেতরে! সাপবিচ্ছু যদি ওঁৎপেতে থাকে! যদি দংশন করে প্রিয়নবী আলাইহিস সালামকে। তাই! প্রথমে নামলেন আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু। দেখতে পেলেন, অসংখ্য ছিদ্র গিরিগুহার ভেতর। এখানে ওখানে। গায়ের চাদর ছিঁড়ে ফেললেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। ছোট ছোট দলা পাকিয়ে গুঁজে দিলেন। ছিদ্রের মুখে। এখনো ছিদ্র বাকি রয়েছে একটি। কিন্তু চাদর শেষ হয়ে গেছে। হয়রান তিনি! কী করা যায়! যদি কোনো সাপ বের হয়ে আসে! ওটা দিয়ে! তখন! ভয়ে ভয়ে, দ্বিধা সংকোচ নিয়ে, গিরিগুহায় ঢুকলেন আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু। নবী আলাইহিস সালামকে নিয়ে। নবী আলাইহিস সালাম ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

দীর্ঘ সফরের কারণে। আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু বুঝলেন, নবী আলাইহিস সালামের ঘুম প্রয়োজন। বিশ্রাম প্রয়োজন। নিজের উরু পেতে দিলেন তিনি। নবী আলাইহিস সালাম ঘুমিয়ে গেলেন। আবু বকরের উরুয় মাথা রেখে। আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহু পা চেপে ধরলেন খালি ছিদ্রটির মুখে। আর চিন্তা নেই। সাপ-বিচ্ছু ঢুকতে পারবে না। নবী আলাইহিস সালামকে কামড়ে দিতে পারবে না। তখন। ঠিক তখন! দংশন করে বসল একটি সাপ। ছিদ্রের মুখে চেপে থাকা আবু বকরের পায়ে। বিষ ছড়িয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। আবু বকর রাদি আল্লাহু আনহুর শরীরে। শরীর নীল হয়ে যাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণায়। অসহ্য ব্যথায়। তবু শব্দ করছেন না। নড়ছেন না তিনি। যদি নবী আলাইহিস সালামের ঘুম ভেঙে যায়। আরামের ব্যাঘাত ঘটে। চোখে ঝর্ণার প্রেমাশ্রু। বেরিয়ে আসছে টুপটুপ করে। বোধ করা যাচ্ছে না। এ অশ্রু কি বেদনার? না! এ অশ্রু ভালোবাসার! হঠাৎ! হঠাৎ তখন। ভালোবাসার একফোঁটা গড়িয়ে পড়ল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মুখে, চুম্বন করল নবীজির কপোলকমল। ভালোবাসার ছোঁয়ায় নবী আলাইহিস সালামের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন, আবু বকরের অনন্য ভালোবাসা। তার চোখের হীরকপথ মাড়িয়ে নেমে আসা অসামান্য প্রেমের অশ্রু।

লেখক : আলেম, কবি ও গল্পকার

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত