ঢাকা ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রিয়জন হারানোর বেদনা

আমীরুল ইসলাম ফুআদ
প্রিয়জন হারানোর বেদনা

মানবতার মুক্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। সত্যের প্রতি আহ্বান আর মানবতা প্রতিষ্ঠা ছিল যার জীবনের মিশন। সেই মহামানবও জালিমের নির্যাতন থেকে মুক্ত ছিলেন না। মক্কার কাফেররা বিভিন্ন সময় নানানভাবে তাকে কষ্ট দিত। এমন কোনো কষ্ট-নির্যাতন নেই; যা রাসুলের উপর দিয়ে বয়ে যায়নি। তৎকালীন সময়ে মক্কার লোকগুলো এতটাই বখাটে আর উৎশৃঙ্খল ছিল! তারা কখনো মহানবী (সা.) কে পাগল বলে অপবাদ দিত। কখনো কবি কিংবা গণকের তকমা লাগাত। সবকিছু রহমতের নবী সহ্য করতেন মুখ বুজে। যখন খুব বেশি মনখারাপি জেঁকে বসত। মনটা বিষাদে নীল হয়ে যেত তখন দুদণ্ড সুখণ্ডদুঃখের গল্পের জন্য কিংবা বুকের ভেতরের দহনটা নিভানোর জন্য চাচা আবু তালিবের আশ্রয় নিতেন। তার পরম ভালোবাসার পরশে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করতেন। তার ছায়ায় প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন।

আবু তালিব ছিলেন তৎকালীন সময়ের মক্কার বনু আবদে মানাফ গোষ্ঠীর প্রতাপশালী নেতা। সবাই তাকে মান্য করত। শ্রদ্ধা করত। ভক্তি ও সমীহ করত, যেমন তেমনি ভয়ও পেত প্রচণ্ড। এমন শক্তিশালী আর প্রতাপশালী ব্যক্তিত্বের ভাতিজা হলেন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আবু তালিবের ভয়ে মুহাম্মদ (সা.)-কে ততটা নির্যাতন করতে পারছিল না মক্কার লোকগুলো। কারণ, আবু তালিব যে তার এতিম ভাতিজার জন্য ঢালস্বরূপ ছিলেন। নবী মুহাম্মদ (সা.) -কে কিছু বলতে কিংবা গায়ে হাত তুলতে সাহস দেখাতে পারত না কেউই। তারা ভয় করত আবু তালিবকে। আবু তালিবের বংশ-পরম্পরাকে। তাদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠাকে। এভাবেই রাসুলের বেড়ে ওঠার দিন গুজরান হচ্ছিল। ভালোই কাটছিল দিনকাল। কিন্তু হঠাৎ একদিন ডাক এলো আবু তালিবের চলে যাওয়ার। অনন্তকালের মহাযাত্রার। এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিল আবু তালিব। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন শোকে বিষাদে নীল হয়ে যান। কষ্টে কাতর হয়ে পড়েন। সারাজীবনের জন্য হারালেন পিতৃতুল্য চাচাকে। তার পরম ভালোবাসাকে। ঢাল হিসেবে রক্ষা করাকে। বটবৃক্ষের মতো ছায়াদ্বার চাচাকে। বিপদণ্ডআপদের সঙ্গীকে। বুকে আগলে রাখার মতো একজন মহান ব্যক্তিত্বকে। তুলনাহীন একজন আদর্শ অবিভাবককে। কীভাবে এই শোক সহ্য করবে! কেমনে সইবে এমন বিয়োগ জ্বালা! চিন্তা আর পেরেশানির কোনো অন্ত নেই রাসুলের। একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। শোকে পাথর বনে গেছেন যেন।

এখনো আকাশে উড়ছে শোকপাখি। গলা ছেড়ে গান ধরে। ভীষণ কষ্ট দেয় রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। চাচা হারানোর শোকের ক্ষত এখনো তরতাজা। বিয়োগ-শোকের জখম এখনো দগদগে। অল্পকিছু সময়ের ব্যবধানে পরপারে পাড়ি জমান প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত খাদিজা (রা.)। যার কাছে হৃদয়ের সুকুন খুঁজে পেতেন। মাথা গুঁজে ঠাঁই নিতেন। কঠিন আর দুর্যোগ সময়ে রাসুলের সঙ্গে থাকতেন ছায়ার মতো যিনি। কোনো ভয় কিংবা পেরেশানি যাতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিহ্বল করতে না পারে কিংবা কষ্টেরা কাবু করতে না পারে, সেদিকে সদা সজাগ থাকতেন হজরত খাদিজা (রা.)। ইসলামের শুরুর যুগে প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করেছিলেন চিন্তামুক্ত। তারপর নিজের অঢেল ধন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে রাসুলের সহধর্মিণী হলেন। প্রথম নবুওয়াতের দিন রাসুলের ভয় আর শংকা দূর করার জন্য বলেছিলেন ‘হে নবী! আপনি ভয় পাবেন না। বিচলিত হবেন না। মহান আল্লাহ আপনার সঙ্গে কোনো ধরনের মন্দ আচরণ করবেন না’। কতো সুন্দর সান্ত¦নার বাণী সেদিন শুনিয়েছিলেন তিনি। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামীর শ্রেষ্ঠ স্ত্রী। উম্মুল মোমেনিন হজরত খাদিজা (রা.)। নবীর প্রতি প্রেম-ভালোবাসায় তার হৃদয় ছিল সিক্ত। স্বামীর মন খুশি রাখতে তার ছিল অভিভাবকত্বমূলক প্রেম। ভালোবাসা। তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সবচেয়ে প্রিয় ও ভালোবাসার স্ত্রী। কিন্তু, তাকে হারিয়ে রাসুল (সা.) যেন একেবারে ভেঙে পড়েছেন। এতো অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর দুজন প্রিয় মানুষকে হারিয়েছেন। হৃদয়ে একটা বিরাট আঘাতের দাগ পড়েছে তার। ইতিহাসে সে বছরকে বলা হয়েছে ‘আমুল হুযুন তথা চিন্তার বছর’। কারণ, রাসুল সল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে বছরে শোকের উপর শোক সয়েছেন। এ কষ্ট ও শোকক্লিষ্ট-যাতনা দূর করতে মহান রব্বুল আলামিন তার প্রিয় বান্দা ও রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-কে মেরাজে ডেকে নেন। জান্নাত-জাহান্নাম দেখান। ফেরার বেলা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দিয়ে দেন উপহার স্বরূপ। এ মেরাজের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের পর তিনি কিছুটা দুঃখ ভুলেন। কিন্তু চাচা আবু তালিব ও স্ত্রী খাদিজার প্রতি তার প্রেম থেকে যায় হৃদয়ের মণিকোঠায়। উল্লেখ্য, ইসলামে তিন দিনের বেশি শোক পালন করা বৈধ নয়।

(তথ্যসূত্র : বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/১৩৫-৩৬, আর রাহিকুল মাখতুম ১১৩-১৪ )।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত