আদর্শ স্বামীর পরিচয়
শাহাদাত হোসাইন
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দাম্পত্য জীবন নারী-পুরুষের স্বপ্নীলভূবন। সেই ভূবনে সুখী হতে আগ্রহী ও উদগ্রীব সবাই। স্বপ্নীল এই ভূবনে স্বামীর গুরুত্ব অপরিসীম। স্বপ্নময় এই ভূবনকে বাস্তবে সাজাতে একজন স্বামীর উত্তম ও আদর্শবান হওয়া একান্ত জরুরি। আদর্শ ও উত্তম স্বামীর বৈশিষ্য ও পরিচয় কী? তা আমরা রাসুলুল্লাহর জীবন থেকে পাই। ইসলামের আলোকে উত্তম স্বামীর পরিচয় ও কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো।
দ্বীনদার হওয়া
দ্বীনদারিতা ব্যক্তিত্বে আমূল পরিবর্তন আনে। একজন স্বামী উত্তম ও আদর্শবান তখনই হবে, যখন সে দ্বীনদার হবে। দ্বীনহীন কোনো ব্যক্তির উত্তম স্বামী হওয়া অসম্ভবপ্রায়। তাইতো নবীজি কন্যাদের দ্বীনদার ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ দিতে বলেছন। তিনি বলেন, তোমরা যে লোকের দ্বীনদারী ও নৈতিক চরিত্রের ব্যাপারে সন্তুষ্ট, যদি সে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তবে তোমরা সঙ্গে (পাত্রীর) বিয়ে দাও। অন্যথা পৃথিবীতে ফেৎনা-ফাসাদ ও বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়বে (তিরমিজি : ১০৮৫)।
চরিত্রবান হওয়া
ইসলাম স্বীয় অনুসারীদের সর্বক্ষেত্রে নিষ্কলুষ চরিত্রের অধিকারী হওয়ার শিক্ষা দেয়। চরিত্রহীনতা ব্যক্তিজীবনে অশান্তি আর ধ্বংস ডেকে আনে। উত্তম স্বামীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, চরিত্রবান হওয়া। স্বামীর চারিত্রিক মাধুর্যে দাম্পত্য জীবনের বন্ধন মধুর হবে। অন্যথা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অস্থিরতা ও দূরত্ব সৃষ্টি হবে। চরিত্রবান স্বামীর ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্য। সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য। (সুরা নুর : ২৬)।
স্ত্রীকে আল্লাহর ইবাদতে উদ্বুদ্ধকারী
উত্তম ও আদর্শ স্বামী স্ত্রীকে আল্লাহর ইবাদতে উৎসাহ ও প্রেরণাদানকারী হবেন। স্ত্রীকে আল্লাহর আদেশ পালনে সতর্ক করবেন। হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেন, আল্লাহ এমন ব্যক্তির (স্বামীর) প্রতি দয়া করুন! যে রাতে জাগ্রত হয়ে নিজে নামাজ পড়ে এবং স্বীয় স্ত্রীকে জাগ্রত করে। স্ত্রী উঠতে নাচাইলে সে তারমুখমণ্ডলে পানি ছিটায় (আবু দাউদ : ১৩০৮)।
স্ত্রীকে পর্দায় রাখা
নারীর পর্দা আল্লাহর বিধান। আয়েশা (রা.) বলেন, একদা আসমা (রা.) পাতলা পরিধেয় পরিহিত অবস্থায় নবীজির কাছে এলেন, তিনি তার থেকে মুখ ফিরে নিলেন এবং বললেন হে আসমা, একজনপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীর জন্য দুইহাত এবং মুখমণ্ডল ব্যতীত কোনো কিছুই প্রদর্শন করা বৈধ নয়। (আবু দাঊদ : ৪১০৪)। স্ত্রীকে পর্দায় রাখা স্বামীর দায়িত্ব। একজন উত্তম স্বামী নিজ স্ত্রীকে কখনোই পর্দাহীন হতে দেবেন না। কারণ এতে ব্যক্তি দাইয়ূস হয়ে যায়। আর দাইয়ূসের ব্যাপারে নবীজি বলেছেন, তিন শ্রেণির লোকের জন্য জান্নাত হারাম। সর্বদা মদপানকারী। পিতামাতার অবাধ্য সন্তান এবং সেই ব্যক্তি যে, স্ত্রীকে পর্দাহীন রাখে, অশ্লীলতার সুযোগ দেয়। (নাসাঈ : ৩৬৫৫)।
স্ত্রীর কল্যাণকামী
নৈতিকতাসম্পন্ন আদর্শ স্বামী সর্বক্ষেত্রে স্ত্রীর কল্যাণকামী হবেন। ভুল হলে উত্তমভাবে শুধরে দেবেন। কঠোর ও নিষ্ঠুর হবেন না। বোঝাবেন। হঠকারিতা প্রদর্শন করবেন না। নবীজি বলেছেন, তোমরা নারীদের সঙ্গে উত্তমাচরণ করো। কারণ তাদের বাঁকা হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যদি তা পরিপূর্ণ সোজা করতে চাও তাহলে ভেঙে যাবে। তাই তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। (বোখারি : ৩৩৩১)।
স্ত্রীর সার্বিক খোঁজখবর রাখা
রাসুল (সা.) ছিলেন পৃথিবীর উত্তম স্বামী। তিনি দুনিয়ার ব্যস্ততম ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন স্ত্রীদের খোঁজখবর নিতেন। তাদের সার্বিকবিষয়ে খবরদারী করতেন। তাবরানি শরিফে এসেছে, নবীজির অভ্যাস ছিল, প্রতিদিন ফজরের নামাজের পর নামাজের স্থানেই বসে থাকা। এরপর তিনি স্ত্রীদের কাছে যেতেন এবং সালাম বিনিময় করে সকলের খবরাখবর নিতেন (তাবরানি শরিফ : ৮৭৬৪)।
স্ত্রীকে প্রহারকারী না হওয়া
আল্লাহ অত্যাচার করেন না এবং অত্যাচারীকে পছন্দও করেন না। বিদায় হজের ভাষণে নবীজি উম্মতের পুরুষদের বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন, স্ত্রীদের প্রতি জুলুমণ্ডঅত্যাচার না করতে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) কখনই কোনো স্ত্রীকে প্রহার করেননি (আবু দাউদ : ৪৭৮৬)।
স্ত্রীর পরিবার ও প্রিয়জনদের মহব্বত করা
স্ত্রীর পরিবার ও প্রিয়জনদের মহব্বতকরা। তাদের খোঁজখবর নেয়া উত্তম স্বামীর পরিচয়ক। নবীজির প্রথম স্ত্রী। হজরত খাদিজা (রা.)। নবীজির মক্কী জীবনের কষ্টের সঙ্গী। তাকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে, তার মৃত্যুর পরে তার স্মরণে নবীজি খাদিজার বান্ধবীদের বাসায় হাদিয়া পাঠাতেন। হাদিসে এসেছে, যদি নবীজির বাসায় বকরী যবেহ হতো তাহলে নবীজি বলতেন খাদিজার বান্ধবীদের বাসায় গোশত প্রেরণ করো (মুসলিম : ২৪৩৫)।
ঘরের কাজে সাহায্যকারী
আল্লাহ অনুগ্রহকারীদের পছন্দ করেন। তিনি বলেন, তুমি অনুগ্রহ করো, যেভাবে আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন (সুরা কাসাস : ৭৭)। স্বামী-স্ত্রীর সবচেয়ে কাছের মানুষ। ভালোবাসার মানুষ। ভালোবাসার দাবি হলো, প্রিয়জনের কাজে তাকে সাহায্য করা। নবীজি স্বীয় স্ত্রীদের ঘরের কাজে সাহায্য করতেন। আসওয়াদ (রা.) বলেন, আমি আয়েশা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম নবীজি বাসায় কী করতেন? উত্তরে তিনি বলেন, নবীজি তার পরিবারে খেদমত করতেন (মুসনাদে আহমাদ : ২৫৩৮০) অন্যত্র এসেছে, নবীজি সাধারণ মানুষের মতোই ছিলেন, কাপড় ধৌত করতেন। বকরির দুধ দোহন করতেন এবং নিজের কাজ নিজেই করতেন। (২৩৭৫৬)।
স্ত্রীকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া
একজন আদর্শ স্বামী-স্ত্রীকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে থাকেন। কাজ ও শত ব্যস্ততার ফাঁকে প্রিয় স্ত্রীর জন্য সময় বের করা উত্তম স্বামীর পরিচায়ক। সাহাবি উকবা ইবনে আমের (রা.) বলেন, আমি নবীজিকে বললাম, ইয়া-রাসুলাল্লাহ মুক্তি কীসে? নবীজি বললেন, জিহ্বাকে সংরক্ষণ করা। বাসায় অবস্থান দীর্ঘ করা এবং নিজ ভুলে ক্রন্দন করা (তিরমিজি : ২৪০৬)। বাসায় অবস্থান দীর্ঘ করা বাক্যটি এখানে ব্যাপক অর্থবোধক।
ব্যক্তিগত কাজে স্ত্রীর মতামত নেয়া
পরামর্শের গুরুত্ব অপরিসীম। গুরুত্বপূর্ণ কাজ পরিবারের সঙ্গে পরামর্শেরভিত্তিতেই সম্পাদন করা উচিত। বিশেষত স্ত্রীর সঙ্গে। এতে দাম্পত্যজীবন সুখী ও সমৃদ্ধ হয়। বোখারি শরিফে এসেছে, হুদাইবিয়ার সন্ধিতে মুসলমানদের বিপক্ষে অনেক ধারা এবং সাহাবিদের প্রবল অমত সত্ত্বেও নবীজি সন্ধিচুক্তি স¤পাদন করেন, সাহাবীদের তিন তিনবার কোরবানি ও মাথামুণ্ডন করতে বললেও কেউ সাড়া নাদিলে নবীজি তাবুতে উম্মে সালমার (রা.) কাছে আসেন এবং ঘটনা খুলে বলেন। তখন উম্মে সালমা (রা.) পরামর্শ দেন যে, কাউকে কথা নাবলে, আপনি আপনার কোরবানি ও মুণ্ডনকার্য সম্পন্নকরেন তাহলে সাহাবিরাও করবেন। তার এই পরামর্শ কাজে দেয় এবং নবীজির দেখাদেখি সব সাহাবি মাথামুণ্ডন ও কোরবানি করেন (২৭৩১)।
লেখক : মুহাদ্দিস ও খতিব