নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইসলামি জীবনব্যবস্থা পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেই পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে দ্বিতীয় স্তম্ভ হলো নামাজ। ঈমানের পরেই ইসলামে নামাজের স্থান। নামাজ একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদাত। নামাজের মাধ্যমেই বান্দা ও আল্লাহর মাঝে সুনিবিড় সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন নসিব হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, সব নামাজের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সঙ্গে দাঁড়াও। (সুরা বাকারা : ২৩৮)। নামাজের গুরুত্ব বোঝাতে নবীজি (সা.) বলেছেন, যার আমানতদারী নেই তার ঈমান নেই, যার পবিত্রতা নেই তার নামাজ নেই, যার নামাজ নেই তার দ্বীন নেই, গোটা শরীরের মধ্যে মাথার যে মর্যাদা দ্বীন ইসলামে নামাজের সে মর্যাদা। (মুসনাদে আহমদ : ২৩৮৩)। জীবনের মহাসড়কে হাজারো ব্যস্ততার দীর্ঘ জ্যাম লেগে যায়। দৈনিক রুটিনের বাইরেও থাকে নানান কাজ। অনেকে বিশ্রাম এবং খাওয়ার সময় পর্যন্ত পায় না। এমন অসংখ্য ঝামেলার মধ্যেও একজন মোমিন তার নামাজ ঠিক রাখে। তার কানে কে যেন গুণগুণিয়ে বলে ওঠে, নামাজকে বলো না কাজ আছে বরং কাজকে বলো আমার নামাজ আছে। একজন প্রকৃত মোমিনের নামাজ হয় জীবন্ত। বিনয় ও একাগ্রতার সৌন্দর্যে ভরা। আল্লাহর দর্শন লাভের অনুভূতি নিয়ে নামাজ পড়ার তাগিদ পাওয়া যায় হাদিসে। নবীজি (সা.) বলেছেন, তুমি এমনভাবে নামাজ আদায় করবে যেন তুমি মহান আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ আর যদি তুমি দেখতে না পাও, তাহলে অন্তত ভাববে যে নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ তোমাকে দেখছেন। (বোখারি : ৫০)। আল্লাহ আমাকে দেখছেন, আমার তেলাওয়াত শুনছেন এই একটি যুগান্তকারী বোধ নামাজে খুশু খুজুর প্রধান সহায়ক। মূলত খুশু খুজু অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও তার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে শরীরের মাধ্যমে। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্তরকে অনুসরণ করে। নামাজ প্রাণবন্ত করে তোলে। আল্লাহর কাছে থেকে আনে সার্টিফিকেট। পবিত্র কোরআনে এসেছে, সেসব মোমিন সফল হয়েছেন যারা নিজেদের নামাজে বিনয়ী ও একাগ্র। (সুরা মুমিনুন : ১২)। সুরা মুমিনুন-এর ১০ ও ১১ নং আয়াতে সফল মোমিনের পুরস্কার জান্নাতুল ফেরদৌসের ঘোষণা করা হয়েছে।
কেয়ামতের দিন নুর হবে
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর নবী করীম (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, একদা তিনি নামাজের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করলেন অতঃপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি এই নামাজ যথাযথভাবে ও সঠিক নিয়মে আদায় করতে থাকবে, তাদের জন্য কেয়ামতের দিন একটি নুর অকাট্য দলিল এবং মুক্তি নির্ধারিত হবে। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি নামাজ সঠিকভাবে আদায় করবে না, তার জন্য নূর, অকাট্য দলিল এবং মুক্তি কিছুই হবে না; বরং কেয়ামতের দিন তার পরিণতি হবে কারুন, ফেরাউন, হামান, উবাই ইবনে খালকের সঙ্গে। (মুসনাদে আহমদ : ৬২৮৮)।
নামাজে মনোযোগ আবশ্যক
ধ্যান ও খেয়ালের সঙ্গে নামাজ পড়া বেশ কঠিন। শয়তান বারবার নামাজে বিভিন্ন বিষয়ে স্মরণ করে দিয়ে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করার আক্রমণ চালায়। নির্ধারিত রোকনে নির্ধারিত স্থানে দৃষ্টি রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! নামাজে আমি দৃষ্টি কোথায় রাখব? তিনি বললেন, হে আনাস! তুমি তোমার সিজদার স্থানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখ। তিনি বলেন, আমি বললাম, রাসুলাল্লাহ! এটা অত্যন্ত কঠিন, আমি তা পারব না। তিনি বললেন, (কমপক্ষে) ফরজ নামাজে এটা কর। (সুনানে কুবরা, বাইহাকি : ২/৪০৩, ৩৫৪৪ )।
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, নামাজে অযথা এদিক-ওদিক তাকানো নিষেধ। নামাজে সিজদার দিকেই নজর রাখা। বিশেষ করে ফরজ নামাজে। হাদিসে আরো এসেছে, আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি আমি রাসুল (সা.) কে নামাজে এদিক-ওদিক তাকানো সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, এটা একটি ছিনতাই, এর মাধ্যমে শয়তান বান্দার নামাজ থেকে (তার খুশু-খুজুকে) নষ্ট করে। (বোখারি : ৭৫১)।
নামাজে চুরি নিকৃষ্ট চুরি
কিছু লোকের ধারণা দ্রুত নামাজ পড়লে নামাজে মনোযোগ রাখা যায়। এটাও একটি ভিত্তিহীন ধারণা। দ্রুত নামাজ পড়লে নামাজের আরকানগুলো সঠিক মতো আদায় করা যায় না। এটা খুব গুরুতর একটি বিষয়। এ সম্পর্কে হাদিসের বক্তব্য হলো, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবু কাতাদা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট চোর হলো, যে নামাজের মধ্যে চুরি করে। সাহাবিগণ আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! নামাজে কীভাবে চুরি করে? তিনি বললেন, নামাজে রুকুণ্ডসিজদা ঠিকমতো আদায় করে না। (মুসনাদে আহমাদ : ২২৬৪২ সহিহ ইবনে হিব্বান : ১৮৮৮)। এই হাদিসে ধীরস্থিরতার সঙ্গে নামাজে রুকু সিজদা না করার অপরাধে নিকৃষ্ট চোর বলা হয়েছে; কিন্তু আরেকটি হাদিসে ইসলাম থেকে বহির্ভূত হওয়ার ব্যাপারে সাবধান করা হয়েছে। হজরত যায়েদ ইবনে ওয়াহাব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুযাইফা (রা.) এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, সে রুকুণ্ডসিজদা ঠিকমতো করছে না। তিনি তাকে বললেন, তোমার নামাজ হয়নি। যদি তুমি এমতাবস্থায় মারা যাও, তাহলে আল্লাহ কর্তৃক মুহাম্মদ (সা.) কে প্রদত্ত আদর্শ হতে বিচ্যুত অবস্থায় মারা যাবে। (বোখারি : ৭৯১)।
ধীর-স্থিরভাবে নামাজ পড়ার নববি তালিম
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী কারীম (সা.) মসজিদে প্রবেশ করলেন। এমন সময় একজন গ্রাম্য সাহাবি (মসজিদে) এসে নামাজ আদায় করলেন। এরপর তিনি নবী কারীম (সা.) কে সালাম দিলেন। নবী কারীম (সা.) সালামের জবাব দিয়ে বললেন, তুমি যাও, পুনরায় নামাজ আদায় কর। কেননা, তুমি নামাজ আদায় করনি। তিনি ফিরে গিয়ে আগের মতো নামাজ আদায় করলেন। তারপর নবী কারীম (সা.) কে সালাম দিলেন। তিনি বললেন, তুমি যাও, পুনরায় নামাজ আদায় করো। কেননা, তুমি নামাজ আদায় করনি। এভাবে তিনবার বললেন।
সাহাবি বললেন, সেই মহান সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, আমি তো এর চেয়ে সুন্দরভাবে নামাজ পড়তে জানি না। সুতরাং আপনি আমাকে (নামাজ ) শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন- যখন তুমি নামাজের জন্য দাঁড়াবে, তখন তাকবির বলবে। তারপর কোরআন থেকে যা তোমার জন্য সহজ পাঠ করবে। তারপর রুকুতে যাবে এবং ধীরস্থিরভাবে রুকু করবে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর সিজদায় যাবে এবং ধীরস্থিরভাবে সিজদা করবে। তারপর সিজদা থেকে উঠে স্থির হয়ে বসবে। আর এভাবেই পুরো নামাজ আদায় করবে। (মুসলিম : ৯১১)। আজকাল মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। মসজিদে মুসল্লির সংখ্যাও অনেক। কিন্তু খুশু-খুজুর সঙ্গে নামাজ আদায়কারীর সংখ্যা হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া প্রত্যেকটি ঈমানদার নারী-পুরুষের জন্য একান্ত প্রয়োজন।
নামাজে উদাসীনতা কাম্য নয়
যারা নামাজ পড়ে না কিংবা নামাজ নিয়ে উদাসীনতার পরিচয় দেয় তাদের পরিণতি ভয়াবহ হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ধ্বংস সেসব নামাজির জন্য যারা তাদের নামাজ সম্পর্কে গাফেল। (সুরা হুমাজাহ : ১২)। নামাজে উদাসীনতা ব্যক্তিজীবনকে এলোমেলো ও অপ্রাপ্তির কষ্টে ভোগায়। দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষতির সম্মুখীন করে। হাদিসে এসেছে নামাজ বেহেশতের চাবি। নামাজি ব্যক্তি দুনিয়ায় সম্মান, আত্মিক ও মানসিক শান্তি লাভ করে। বিপদাপদ থেকে রক্ষা পায়। আখেরাতে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হিসেবে জান্নাতে আমন্ত্রিত হয়।
লেখক : কবি ও আলেম