আবু হানিফা (রহ.)
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জ্ঞান-আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
সর্বজনবিদিত এবং সর্বমহলে সমাদৃত এক মহান ব্যক্তিত্বের নাম ইমাম আবু হানিফা। সাধনা আর নিরলস প্রচেষ্টা যে একজন মানুষকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে তিনি তার জীবন্ত উপমা। যুগ তার পরশে ধন্য হয়েছে, জাতি তার রচিত ও সংকলিত জ্ঞানভান্ডার থেকে আজো উপকৃত হচ্ছে। ইসলামের জ্ঞানভান্ডারে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, উম্মাহ তার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে। ভূবণ আলোকিত করা এই পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছিল তৎকালীন জ্ঞানের শহর কুফাতে। তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবন এখানে এই জ্ঞানের শহরেই কেটেছে। তার আসল নাম নুমান। পিতার নাম ছাবিত এবং পিতামহের নাম জওতা। শৈশবে তার ডাক নাম ছিল আবু হানিফা। তার পূর্বপুরুষগণ ইরানের অধিবাসী ছিলেন। পিতামহ জওতা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে তৎকালীন আরবের সমৃদ্ধিশালী নগর কুফায় এসে বাসস্থান নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
ব্যবসায়ী ইমাম আবু হানিফা
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর পৈত্রিক পেশা ছিল কাপড়ের ব্যবসা। পিতার মৃত্যুর পর এটাই ছিল তার প্রধান পেশা। ইরান থেকে শুরু করে ইরাক, সিরিয়া ও হেজায পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী বিপুল পরিমাণ মূল্যবান রেশমি কাপড়ের আমদানি ও রপ্তানি হত। ব্যবসায় তার সততার পরিচয় পেয়ে দিগি¦দিক থেকে লোকেরা তার দোকানে ভিড় জমাত। এভাবে তিনি জনমানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করলেন। ইমাম শাবি (রহ.) তাকে ইলমের ব্যাপারে উৎসাহিত করার আগ পর্যন্ত তিনি এ ব্যবসাকেই নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়েছিলেন। (উসুলুদ্দিন ইনদা আবি হানিফা, পৃষ্ঠা- ৬৬)।
শিক্ষাজীবন
জীবনের ২০টি বছর পার হওয়ার পর দেখা হয় যুগশ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম শাবি (রহ.)-এর সঙ্গে। তার সান্নিধ্য পাওয়ার পর আবু হানিফা (রহ.)-এর জীবনে বিস্ময়কর পরিবর্তন আসে। এরপর তিনি পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। ঘুরে বেড়ান সব জ্ঞানের শহরে। গভীর জ্ঞান লাভ করেন কোরআন-হাদিসসহ বিভিন্ন বিষয়ে। তিনি কুফা শহরে ইলমে কালাম শিক্ষা করেন। ইলমে আদব ও ইলমে কালাম শেখার পর তিনি ইলমে ফিকহ অর্জনের জন্য সমকালীন ফকিহ ইমাম হাম্মাদ (রহ.)-এর শিক্ষাগারে অংশগ্রহণ করেন। নির্ঘুম রাত আর কঠিন সাধনার পর যুগের ‘ইমামে আজম উপাধিতে ভূষিত হন।
ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
যুক্তিবিদ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইসলামি শরিয়তের বিধিবিধানের উপরও গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ফিকহ শাস্ত্রের আবিষ্কারক তিনিই ছিলেন। ফিকহ ও ইসলামি আইন সংকলন এবং সম্পাদনার জন্য তিনি ৪০ জন ফকিহ নিয়ে এক আইনজ্ঞ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই যুগে যেসব মাসালা-মাসায়েল সংকলন হয়েছিল, তার সংখ্যা ১২ লাখ ৭০ হাজারের ঊর্ধ্বে। ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর গভীরতা দেখে ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেছেন, ‘ফিকহ শাস্ত্রের সব মানুষ ছিলেন আবু হানিফার (রহ.)-এর পরিবারভুক্ত।’ (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৬/৩৯২)। কুফা নগরীর বিখ্যাত মনীষী ইমাম সুলায়মান ইবনে মিহরান (রহ.) কে এক ব্যক্তি মাসআলা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি তখন (ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মজলিসের দিকে ইঙ্গিত করে) বললেন, এদের জিজ্ঞেসা করুন। কেননা, এদের কাছে যখন কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তখন তারা সম্মিলিতভাবে মতবিনিময় করেন এবং (সর্বদিক পর্যালোচনার পর) সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন। (জামিউল মাসানীদ, আবুল মুআইয়াদ খুয়ারাযমি : ১/২৭-২৮)।
হাদিস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকাহ শাস্ত্রে এবং মাসআলা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে যেমন অকল্পনীয় জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, অনুরূপ হাদিস শাস্ত্রেও তিনি ছিলেন অনন্য শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। প্রথমত. তিনি কুফার হাদিসবিশারদ বড় বড় তাবেয়িদের কাছে হাদিস শিক্ষা করেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেছেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কুফার ৯৩ জন মুহাদ্দিসের কাছে হাদিস শিক্ষা লাভ করেছেন। এরপর হাদিস সংগ্রহের জন্য বসরা, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি যখন বসরা ভ্রমণ করেন, তখন সেখানে ইমাম হাসান বসরি, শুবা, কাতাদাহ প্রমুখ বড় বড় তাবেয়ি মুহাদ্দিসের প্রচারিত হাদিসের জ্ঞানে বসরা নগরী মুখরিত ছিল। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তাদের কাছ থেকে ইলমে হাদিস শিক্ষা লাভ করে নিজেকে ধন্য করেন।
ইয়াহইয়া ইবনে নাসর বলেন, ‘একদিন আমি ইমাম আবু হানিফার ঘরে প্রবেশ করি যা কিতাবে ভরপুর ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলো কী? তিনি বললেন, এগুলো সব হাদিসের কিতাব, এগুলোর মধ্য থেকে সামান্য কিছুই আমি বর্ণনা করেছি যেগুলো ফলপ্রদ’ (উকূদু জাওয়াহিরিল মুনীফাহ : ১/৩১)। ইয়াহয়া ইবনে মুঈন (রহ.) কে যখনই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হত, তখনই তিনি বলতেন তিনি নির্ভরযোগ্য, বিশ্বস্ত, ভুলভ্রান্তিমুক্ত। হাদিসের ব্যাপারে কেউ তাকে দুর্বল বা অগ্রহণযোগ্য বলেছেন বলে আমি শুনিনি। (উমদাতুল কারি : ২/১২)।
মনীষীদের মন্তব্য
বোখারি-মুসলিমের শ্রেষ্ঠ বর্ণনাকারী ইমাম শু’বা (রহ.) বলেন- আল্লাহর শপথ! আবু হানিফার অনুধাবন শক্তি অতি আকর্ষণীয় এবং স্মৃতি শক্তি খুবই প্রখর ছিল।’ (আল-খাইরাতুল হিসান-৩৪)। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা তো এমন এক ব্যক্তি , এ স্তম্ভটিকে দলিলের মাধ্যমে স্বর্ণ বলে প্রমাণ করতে চাইলে অবশ্য তাতে সক্ষম হবেন। (আস সুন্নাহ মাকানাতুহা-৪৪২ পৃষ্ঠা)। ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) বলেন, হাদিস ও হাদিসের ফিকহ সংবলিত সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা দানে আমি ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর চেয়ে পারদর্শী আর কাউকে দেখিনি। (তারিখে বাগদাদণ্ড ১৩/৩৪০)।
তিনি তাবেয়ি ছিলেন
আবু হানিফা (রহ.) একজন তাবেয়ি ছিলেন এ কথা ইমাম জাহাবি ও আসকালানি (রহ.) দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন। আসকালানি (রহ.) বলেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এক জামাত সাহাবায়ে কেরামকে দেখেছেন, যারা কুফায় অবস্থান করতেন। ঐতিহাসিক ইবনে সা’আদ (রহ.) বলেছেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) আনাস ইবনে মালিক (রা.) কে দেখেছেন। (ইসাবা : ১/ ৮৪)। সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৬ / ৩৯১)। আল্লামা ইবনে হাজর মাক্কি (রহ.) বলেছেন, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) আটজন সাহাবির সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছেন আবদুল্লাহ ইবন আবু আওফা (রা.) আনাস ইবনে মালিক (রা.), সাহল ইবনে সায়াদ (রা.) আবুত্তোফাইন (রা.) (আল মানাকেব লিল মাক্কি : ১/ ২৪)।
আবু হানিফা (রহ.)-এর খোদাভীরুতা
ইমাম আবু জাফর শীযমারী (রহ.) বর্ণনা করেন, ইমাম শাক্বীক বালখি থেকে, তিনি বলেন, ?ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ছিলেন সর্বাপেক্ষা খোদাভীরু, সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ আলিম, সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতকারী, সর্বাপেক্ষা সম্মানি এবং দ্বীন-ধর্মের ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা সতর্কতা অবলম্বনকারী। (আল-মিযানুল কুবরা, ১/৮৬)।
আবু হানিফা (রহ.)-এর মৃত্যু
৭৬৩ সালে আব্বাসীয় বংশের খলিফা আল মানসূর আবু হানিফা (রহ.)কে রাজ্যের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের প্রস্তাব দেন, কিন্তু স্বাধীনভাবে থাকার জন্য তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে খলিফা তাকে কারারুদ্ধ করেন এবং এই কারাগারেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কারো কারো মতে কারাগারে বিষপ্রয়োগের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হয়। বিষক্রিয়া বুঝতে পেরে তিনি সিজদায় পড়ে যান এবং সিজদা অবস্থায়ই তিনি ১৫০ হিজরিতে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ সময় তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৬ /৪০৩)। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ইমাম শুবা (রহ.) বলেন, তার সঙ্গে কূফার ফিকহও চলে গেল, আল্লাহ আমাদের ও তাকে রহমত করুন। (ইবন আব্দুল বার, আল-ইনতিকা ১/১২৬-১২৭)। শাফেয়ি মাযহাবের প্রধানতম সংকলক হজরত ইবনে জরীহ (রহ.) গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আহ! ইলমের কী এক অফুরন্ত খনি আজ আমাদের হাতছাড়া হলো’। (তাহযীবুত্তাহযীব : ১/৪৫০)।
লেখক : ইসমাঈল সিদ্দিকী, শায়েখ জাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ঢাকা