বদরযুদ্ধে কুরাইশরা এবং উহুদের অমীমাংসিত যুদ্ধে ব্যাপকভাবে খেসারত দেয়ার পর সমগ্র আরবের বিভিন্ন গোত্রকে রাসুল (সা.) এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে এবং তাদের একত্রিত করে মদিনা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তাদের এ পরিকল্পনার কথা রাসুল (সা.) জানতে পেরে সাহাবাদের সঙ্গে পরামর্শে বসেন। রাসুল (সা.) সব সময় চাইতেন যুদ্ধে রক্তপাত না হোক কিংবা কম রক্তপাত হোক।
হজরত সালমান ফারসি (রা.) এ সময় পরামর্শ দিলেন যে, শহরের তিন দিকে ১০ হাত গভীর ও ১০ হাত প্রশস্ত করে একটা খন্দক খনন করা হোক। তার এই পরামর্শ রাসুল (সা.) পছন্দ করলেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী রাসুল (সা.) নিজেও সাহাবাদের সঙ্গে খনন কাজে অংশগ্রহণ করলেন। পরিখা খননের সময় রাসুল (সা.)-এর মুজিজা প্রকাশিত হয়।
হজরত সালমান ফারসি (রা.) বলেন, গাইতি দিয়ে পরিখায় কাজ করছিলাম, তখন একটা পাথর খুব কষ্ট দিচ্ছিল। রাসুল (সা.) তা লক্ষ্য করলেন। তিনি পরিখায় নেমে আমার হাত থেকে গাইতিটি নিয়ে এমন জোরে আঘাত করলেন যে, গাইতি থেকে বিদ্যুৎ চমকাল। একবার, দুইবার, তিনবার! আমি রাসুল (সা.)-কে বললাম : আপনি আমার কাছে পিতামাতার চেয়ে অধিকতর প্রিয়! হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি পাথরে আঘাত করতেই বিদ্যুৎ চমকাল, এর কারণ কী?
রাসুল (সা.) বললেন : তোমার চোখে পড়েছে সালমান?
অতঃপর তিনি বললেন : প্রথমটার অর্থ হলো, আল্লাহতায়ালা আমার জন্য ইয়ামান মুক্ত করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টা সিরিয়া ও পশ্চিম দেশ। তৃতীয়টি প্রাচ্যদেশ। মুশরিকরা যখন মদিনার নিকটবর্তী হলো, তখন খন্দকের খনন কাজ সমাপ্ত। মুসলিম ও অমুসলিমরা প্রায় ১ মাস অবরোধের অবস্থান নিয়ে রইল। কিছু তীর পরিচালনা ব্যতীত কোনো যুদ্ধ হলো না। মুশরিকরা অবরোধ তুলে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
খলিফা ওমর (রা.)-এর সময়ে পারস্য মুসলিমদের দখলে এলে তিনি হজরত সালমান ফারসি (রা.)- কে মাদায়ানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। সে সময়ে তার অধীনে ২০ হাজার সৈন্য ছিল। অথচ তিনি নেহায়েত সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
সালমান (রা.) গদি ছাড়া গাধার পিঠে চড়তেন। পায়জামা উঁচু করে পরতেন। তার ঘরে একটি চাদর, শিয়রের কাছে কয়েকটি কাঁচা ইট এবং ঘোড়ার পিঠে বিছানো হয় এমন একটি কম্বল এবং সামান্য কিছু জিনিস ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তার সাধারণ অবস্থা দেখে অনেকে হাসি-ঠাট্টা করত। কিন্তু তিনি তাদের কোনো জবাব দিতেন না।
ইবনে সা’দ লিখেছেন : একবার এক লোক আনজিরের বোঝা নিয়ে যাচ্ছিল। পথে সালমান (রা.)-কে দেখে বলল- এসো, আমার বোঝাটি বহন করো।
হজরত সালমান ফারসি (রা.) বোঝাটি উঠিয়ে নিয়ে চললেন। লোকেরা তাকে দেখে চিনতে পারল এবং বলল- ইনি তো আমীর! লোকটি লজ্জিত হয়ে বলল, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।
সালমান (রা:) বললেন : আমি একটি নিয়ত করেছি যে, তোমার বাড়িতে পৌঁছার আগে আমি এটা নামাব না।
হজরত সালমান ফারসি (রা.) নিজহাতে উপার্জন করতেন। যা কিছু উপার্জন করতেন তা দিয়ে খাবার কিনতেন। তারপর কুষ্ঠরোগীদের দাওয়াত করতেন এবং তাদের সঙ্গে একত্রে খেতেন।
হজরত সালমান ফারসি (রা.) যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত তখন সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.) এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) তাকে দেখতে গেলেন। সালমান (রা.) তখন কাঁদছিলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন : আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন : আমি মৃত্যুর ভয়ে কাঁদছি না। আমি এজন্য কাঁদছি যে, রাসুলল্লাহ (সা.) আমাদের কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছিলেন যে, আমাদের আসবাবপত্র যেনো একজন মুসাফিরের আসবাবপত্রের চেয়ে বেশি না হয়। অথচ আমার কাছে এতোগুলো আসবাবপত্র জমা হয়ে গেছে।
হজরত সা’দ বিন আবু ওয়াক্কাস বলেন : তার আসবাবপত্রের মধ্যে একটি বড়ো পেয়ালা, একটি থালা এবং একটি পানির পাত্র ছাড়া বেশি কিছু ছিল না। হজরত সালমান ফারসি (রা.) বুকাইরাহ নামে একজন মুক্তিপ্রাপ্ত দাসিকে বিয়ে করেন। মৃত্যুর আগে তিনি তার স্ত্রীকে ডেকে বললেন : ‘ঘরের দরজাগুলো খুলে দাও। আমি জানি না, কোন দরজা দিয়ে মালাকুল মাউত প্রবেশ করবেন।’
হজরত সালমান ফারসি (রা.) এর স্ত্রী বলেন : যখন তার মৃত্যু হলো, মনে হচ্ছিল তিনি যেন তার বিছানায় পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন : ‘সালমানু মিন্না আহলাল বাইত’ অর্থাৎ সালমান আমাদের অন্তর্ভুক্ত, আমার পরিবারের সদস্য।’ (তাহযীবুল কামাল ওয়া আসমাইর রিযাল)।
হজরত সালমান ফারসি (রা.) মাদায়েন বর্তমান বাগদাদ শহরে ইন্তেকাল করেন।
ঐতিহাসিকদের মতে ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগস্ট তিনি ইন্তেকাল করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক তার মৃত্যুর সময় ৩৩ হিজরি, ৩৬ হিজরি এবং ৩৭ হিজরি বলে উল্লেখ করেছেন।
সত্যের জন্যে অপরিসীম অনুসন্ধিৎসা, ইসলামের খেদমত এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপনের মাধ্যমে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর মুহাব্বাত ও নৈকট্য হাসিল করেছিলেন। মিথ্যা বর্জন করে সত্য গ্রহণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও সাদাসিধে জীবনযাপনের এক অনন্য শিক্ষা রয়েছে তার জীবন ও কর্মে।