আল্লাহ একমাত্র সত্তা যিনি সব ক্ষমতার আধার। তারই কবজায় সৃষ্টির জীবন-মৃত্যু। তাঁর ইচ্ছায় মৃত্যু ঘটে, তাঁর ইচ্ছায় জীবন। তিনি জীবন দিতে চাইলে, মৃত্যু দেয়ার কেউ নেই। আর মৃত্যু দেয়ার ইচ্ছা করলে, তাকে বাঁচানোর কেউ নেই। কোরআনে এসেছে, আল্লাহর জন্যই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের স্বত্বাধিকারী, তিনি জীবন দেন এবং মৃত্যু দেন (সুরা তাওবা : ১১৬)। তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত একটি পাতাও ঝড়ে না। মোমেন ব্যক্তির উচিত একমাত্র আল্লাহর শক্তিতে বিশ্বাস রাখা। তাকেই ভয় করা। বিপদে তাকে স্মরণ করা। সুখে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নে একমাত্র তাঁর ওপরেই আস্থা রাখা। কারণ, তিনি যাকে বাঁচাতে চাইবেন, তাকে কেউ মারতে পারবে না।
ফেরাউন কর্তৃক মুসা হত্যার পরিকল্পনা
রাখে আল্লাহ মারে কে? এর উৎকৃষ্ট উপমা হজরত মুসা (আ.)। মুসাকে হত্যা করা ফেরাউনের জীবনের অন্যতম আরাধনা ছিল। সারা জীবন, বিশেষত তিনবার সে মুসাকে হত্যার জোরাল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু প্রত্যেকবার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ জীবনের মালিক আল্লাহ মুসাকে জীবন্ত রাখতে চেয়েছিলেন। কোরআনের ভাষায়- তারা চক্রান্ত করেন আর আল্লাহতায়ালাও পরিকল্পনা করেন। আর আল্লাহই উত্তম পরিকল্পনাকারী (সুরা আলে-ইমরান : ৫৪)।
শিশুমুসা হত্যার পরিকল্পনা
ফেরাউন একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন। যার ব্যাখ্যায় জ্যোতিষীরা বলেন, বনি ইসরাঈলে এমন একটি ছেলের জন্ম হবে, যে আপনার সিংহাসনচ্যুতির কারণ হবে। তাই সে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ইসরাঈলি ঘরে জন্ম নেয়া ছেলে সন্তানদের হত্যার আদেশ দেন। আদেশ কার্যকরে কঠোর হৃদয়ের জনবল নিয়োগ দেন। যারা ইসরাঈলি সদ্য ভূমিষ্ঠ ছেলে সন্তানদের হত্যা করতে থাকে। কোরআনে এসেছে-যারা তোমাদের মর্মান্তিক শাস্তি দিত, তোমাদের পুত্রদের খুন করত আর নারীদের জীবিত রাখত (সুরা ইবরাহিম : ৬)।
পৃথিবীর বুকে মুসা (আ.)
এমন কে আছেন, যে আল্লাহর কার্যে বাধা দেবেন? ফেরাউনও আল্লাহর হুকুম কার্যকরে বাঁধা হতে পারেনি। মায়ের গর্ভে মুসা কিন্তু তার পেট স্বাভাবিক। যার কারণে ফেরাউন বাহিনী তা বুঝতে ব্যর্থ হলো। নির্ধারিত সময়ে ভূমিষ্ঠ হলে ছেলের নিরাপত্তার চিন্তায় মা চিন্তিত হয়ে যান। আল্লাহতায়ালা তার চিন্তিত মনকে প্রশান্ত করেন। তাকে (ইলহাম) নির্দেশ দেন। তুমি শিশুটিকে স্তন্য দান করতে থাক। তার স¤পর্কে আশঙ্কা করলে, তাকে দরিয়ায় নিক্ষেপ কর এবং ভয় কর না (সুরা কাসাস : ৭)। দরিয়া তাকে ডোবাতে পারেনি। হত্যা করতে সক্ষম হয়নি।
ঘাতকের গৃহে শিশু মুসা (আ.)
মুসা (আ.) এর মা আল্লাহর নির্দেশে সিন্দুকে করে শিশু মুসাকে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেন। (সুরা ত্বহা:৩৯)। ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া সেই সিন্দুক উত্তোলন করে এবং তাতে ফুটফুটে মুসাকে দেখলে তার প্রতি মহব্বত সৃষ্টি হয়।
এবং তাকে সন্তান হিসাবে প্রতিপালনের ইচ্ছা প্রকাশ করে। ফেরাউন স্ত্রীর মনোবাসনা পূরণে সাধারণ শিশু ভেবে শিশু মুসা হত্যা থেকে বিরত থাকে।
ফেরাউন এতবছর থেকে যাকে হত্যার মানসে ইসরাঈলি সন্তানদের নির্মম হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত ছিল, আজ সেই সন্তান তার ঘরে। তার পরিবারের লালন-পালনে। যাকে হত্যার পরিকল্পনায় এত কিছু সেই আজ ফেরাউনের কোলে খেলেধুলে প্রতিপালিত হচ্ছে। এটাই আল্লাহর কুদরত। যার ইচ্ছা ব্যতীত কোন কিছুই ঘটে না।
যৌবনে মুসা হত্যার পরিকল্পনা
মুসা (আ.) রাজকীয় আদর-আপ্যায়নে প্রতিপালিত হয়ে যৌবনে পদার্পণ করলেন। সুঠামদেহী, শক্তিশালী পুরুষে পরিণত হলেন। জানতে পারনেল তিনি ইসরাঈলি। স্বজাতীর প্রতি অত্যাচার-অনাচার দেখলে তার প্রতিবাদ করতেন দৃঢ়ভাবে। একদিন দেখলেন, ফেরাউন বংশীয় একজন লোক ইসরাঈলি এক ব্যক্তিকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ইসরাঈলি ব্যক্তি মুসাকে দেখে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তাকে সাহায্যার্থে মুসা (আ.) কিবতীকে সজোরে চড় কষালেন। চড়ের প্রচণ্ডতায় সে মারা যায়। এই ঘটনা প্রকাশ পেলে ফেরাউন সভাসদদের নিয়ে দ্বিতীয়বার মুসাকে হত্যার ফরমান জারি করেন। মুসা (আ.) সেই খবর পেয়ে মিশর ত্যাগ করেন। এবারও ফেরাউন তাকে ধরতে ও মারতে ব্যর্থ হয়। কেননা, আল্লাহ যাকে মরতে দেবেন না, দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাকে মারতে পারবে না।
ফেরাউনের দরবারে নবী মুসা (আ.)
মিশর থেকে পালায়ন করে মুসা (আ.) মাদায়েনে গমন করেন। সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। প্রত্যাবর্তনকালে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন। আল্লাহর পয়গাম নিয়ে ফেরাউনের কাছে আসার প্রত্যাদেশ পান। তিনি ফেরাউনকে আল্লাহর একত্ববাদের পয়গাম পৌঁছান। কিন্তু ফেরাউন তা মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নিজেকে বড় রব বলে দাবি করে। কোরআনে এসেছে- সে (ফেরাউন) বলল, আমিই তোমাদের শ্রেষ্ঠ রব (সুরা নাযিয়াত : ২৪)। যখন ফেরাউন কোনোভাবেই আল্লাহকে মানতে চাইল না। তখন মুসা (আ.) তাকে বললেন, বনি ইসরাঈলকে আমার সঙ্গে যেতে দেও। কিন্তু সে এতেও রাজি হলো না।
নবী মুসাসহ বনি ইসরাঈলকে হত্যার পরিকল্পনা
আল্লাহর আদেশে মুসা (আ.) বনি ইসরাঈলকে নিয়ে বের হলেন মিশর ত্যাগের উদ্দেশ্যে। এই খবরে ফেরাউনও সৈন্য-সামান্ত নিয়ে মুসাসহ সবাইকে হত্যা করতে পিছু নেয়। নীলনদের তীরে দু’দলের সাক্ষাৎ হলে, বনি ইসরাঈল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। মুসা (আ.) আল্লাহর আদেশে লাঠির আঘাতে নদীর বুকে রাস্তা সৃষ্টি করেন। যা দিয়ে বনি ইসরাঈল নীলনদ অতিক্রম করে। অহংকারী ফেরাউন আল্লাহর তৈরি রাস্তাকে নিজের তৈরি বলে দাবি করে, সৈন্যদের চলতে বলেন। মাঝ দরিয়ায় পৌঁছলে আল্লাহর হুকুমে পানি মিলে যায়। রাস্তা অদৃশ্য হয়ে যায়। ফলে সবাই সমুদ্রে ডুবে মারা যায়। ধ্বংস হয় ফেরাউনের। অন্যকে মারতে এসে সে নিজেই মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। আল্লাহর অবাধ্য ফেরাউন আল্লাহর শিকারে পরিণত হয়। কথায় আছে, আল্লাহ ছাড় দেন; কিন্তু ছেড়ে দেন না।
স্বজাতির প্রতি ইউনুস (আ.) এর পয়গাম
হজরত ইউনুস (আ.) আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী। দিনরাত অক্লান্তভাবে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছিয়ে দিলেন স্বজাতির কাছে। কিন্তু তারা তাকে মিথ্যুক বলে বিতাড়িত করলেন। তিনি তাদের আল্লাহর আজাবের কথা স্মরণ করে দিলেন। তাতেও তাদের অন্তর বিগলিত হলো না। ঈমান আনল না। আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাবের দিন নির্ধারিত হলে, ইউনুস (আ.) সেই এলাকা ত্যাগ করলেন এবং সমুদ্র পারাপারের জন্য নৌযানে চড়ে বসলেন। নির্দিষ্ট সময়ে আজাবের চিহ্ন প্রকাশ পেলে তার জাতি তাকে খুঁজতে থাকে তার প্রতি ঈমান আনার জন্য। তাকে না পেয়ে তার সকলেই একটি মাঠে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কাছে অনুণয়-বিনয় করলে, আল্লাহ তা কবুল করেন এবং তাদের থেকে আজাবকে হটিয়ে নেন। যার বর্ণনা কোরআনে এভাবে এসেছে- সুতারাং কোনো জনপদ কেন এমন হলো না, যা ঈমান এনেছে অতঃপর তার সে ঈমান গ্রহণ হয়েছে কল্যাণকর? তবে ইউনুসের সম্প্রদায় কথা আলাদা। তারা যখন ঈমান আনে, তখন আমি তুলে নেই তাদের ওপর থেকে অপমানজনক আজাব (সুরা ইউনুস : ৯৮)।
মাছের পেটে ইউনুস (আ.)
মাঝ সমুদ্রে ঝড় উঠলে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। সেই সময়ের লোকদের বিশ্বাস ছিল। কোনো দাস যদি তার মালিকের অনুমতি ছাড়া পলায়ন করে তখন এমন হয়। তাকে নৌকা থেকে সমুদ্রে নিক্ষেপ না করা পর্যন্ত ঝড় থামে না। ঘোষণা করা হলো, কে এমন আছেন? ইউনুস (আ.) বুঝতে পারলেন তিনিই সেই পলাতক দাস। যিনি আল্লাহর অনুমতির আগেই নিজ এলাকা ত্যাগ করেছেন। তাই তিনি লোকদের বললেন, আমি সেই ব্যক্তি। আমাকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করুন। লোকেরা তার আচার-আচরণ ও ভদ্রতা দেখে তার কথা মানতে চাইল না।
তাই তারা লটারির আশ্রয় নিলেন। পরপর তিনবার লটারি করা হলে তিনবারেই ইউনুস (আ.)-এর নাম এলো। এমতাবস্থায় তিনি নিজেই সমুদ্রে ঝাপ দিলেন। আল্লাহতায়ালা বিশালাকৃতির একটি মাছকে আদেশ করলেন ইউনুসকে গিলে ফেলতে। ঝড় উত্তাল সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত ইউনুসকে গিলে ফেলল মাছ। কিন্তু সেখানেও তার মৃত্যু হলো না। কারণ মৃত্যুর মালিক মাছকে বলে দিয়েছেন, তার গায়ে যেন আচড় না লাগে। সে তোমার খাবার না। বরং তোমার পেট তার জন্য কয়েদখানা (মাআরেফুল কোরআন : ৮৮৯)। আল্লাহ বলেন, স্মরণ করুন মাছওয়ালার কথা, যখন তিনি ক্রদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, ধারণা করেছিল আমি তাকে ধরতে সক্ষম নই। তারপর তিনি অন্ধকারের মধ্যে আহ্বান করলেন, তুমি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, তুমি নির্দোষ আমি গোনাহগার (সুরা আম্বিয়া : ৮৭)। গাছ-পালা, তরুলতা। পাখণ্ডপাখালি। জল-স্থলের প্রাণী, এমনি মৃত্যুও চেনেন তাকে। তাবেদারি করে তার হুকুমের। একমাত্র মানুষই তার অবাধ্য হওয়ার দুঃসাহসিকতা দেখায়। আল্লাহ যথাযথই বলেছেন, নিশ্চয়ই মানুষ বড্ড অকৃতজ্ঞ (সুরা হজ : ৬৬)। মুসা ও ইউনুস নবীর জীবন থেকে আমরা শিক্ষা পাই- জীবন মৃত্যু আল্লাহর হাতে। মানুষ চাইলেই কিছু করতে পারে না। সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছায় পরিচালিত। আর সত্য ও ন্যায়ের পথে সর্বকালেই বাধা আসে। ধৈর্য ও সততার সঙ্গে সে বাধা অতিক্রম করতে হয়।
লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদ্রাসা রংপুর