আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে আরব উপদ্বীপসহ সারা পৃথিবী অতিক্রম করছিল ‘আইয়ামে জাহিলিয়াত’ নামের চরম সংকটাপন্ন এক দুঃসময়। প্রায় সব অরাজকতায় পৃথিবী তখন শয়তানের লীলাভূমি, আর এই ভয়ঙ্কর পৈশাচিকতার নাগপাশ থেকে মানবতা তখন মুক্তির জন্য ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছিল একজন শান্তির দিশারি মহামানবের। যিনি এই অশান্তির কালো মেঘ সরিয়ে শান্তির আলোকোজ্জ্বল সূর্যোদয় ঘটাবেন। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট দ্বন্দ্বদীর্ণ দুঃসহ এই পৃথিবীতে আগমন করলেন সেই মহামানব, শান্তি-মুক্তি ও সামগ্রিক কল্যাণের অগ্রদূত মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)। মানবতার সেই দুঃসময়ে আল্লাহতায়ালা তাকে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’ করে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন। (সুরা আম্বিয়া : ১০৭।)।
মহানবী (সা.)-এর পুরোকর্মময় জীবন আবর্তিত হয়েছে মানবতার সার্বিক শান্তি-কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য। তাঁর শান্তি প্রতিষ্ঠার অনন্য পদক্ষেপ ও পদ্ধতিতে আরব সমাজের সব অরাজকতা দূরীভূত হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সৌহার্দণ্ডসম্প্রীতিভিত্তিক একটি অসাধারণ সমাজ গড়ে উঠেছিল। এ জন্য বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি হয়ে উঠেছেন পৃথিবীবাসীর জন্য এক অনুপম আদর্শ। আমরা এখন বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর আদর্শ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির আগ থেকেই এই বিষয়ে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন।
হিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা : তাঁর বয়স যখন ১৪ বছর তখনই তিনি দেখলেন তুচ্ছ ঘটনায় সংঘটিত হওয়া চতুর্থ ফিজার যুদ্ধের বীভৎসতা।এতে তাঁর কোমলপ্রাণ কেঁদে উঠল। তিনি মক্কার কুরাইশদের নিয়ে আর্তমানবতার সেবা, অত্যাচারীর প্রতিরোধ, নির্যাতিতের সহযোগিতা, বিদেশি পর্যটকদের সুরক্ষা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও গোত্রে-গোত্রে সম্প্রীতি বজায় রাখার অঙ্গীকার নিয়ে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক শান্তি-সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই শান্তি-সংঘের কর্মতৎপরতায় আরবে নারী নিগ্রহ, জুলুম বন্ধ হয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা সৃষ্টি হয়েছিল।
অনিবার্য ভয়াবহযুদ্ধ বন্ধ : ৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে একবার পবিত্র কাবাগৃহে ‘হাজারে আসওয়াদ’ স্থাপনের দুর্লভ গৌরব লাভ নিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বাধার উপক্রম হলো। আরব্য সমাজে ‘আমাদের প্রিয় ও বিশ্বস্ত তথা আল-আমিন’ হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত হজরত মুহাম্মাদ (সা.) তখন তাঁর অনন্য সাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে সে অনিবার্য ধ্বংসলীলা থেকে আরবের মানুষকে মুক্তি দান করেন।
খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর স্বীকৃতি : নবুওয়াত পূর্বকালে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নবীজির কল্যাণমূলক ভূমিকা মূল্যায়নে হজরত খাদিজা (রা.) বলেছিলেন- “আল্লাহর কসম! আপনি তো এমন মানুষ, যিনি আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে থাকেন, সমাজের দুস্থ-অসহায় মানুষগুলোর ব্যয়ভার বহন করেন, নিঃস্ব-রিক্তহস্ত-উপার্জনে অক্ষম মানুষদের জন্য নিজে উপার্জন করেন, অতিথি সেবা করেন, সত্যপথ যাত্রীদের সংকটে তাদের পাশে দাঁড়ান।” ( বোখারি : ৩)।
তবে তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পরে আরব উপদ্বীপসহ সমগ্রবিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে ব্যাপক অবদান রেখেছেন। আমরা এখন সে বিষয়গুলো নিয়ে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করব।
সংঘাতবন্ধে আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তি করা : মদিনায় আদি-পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুসলিমসহ বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্র ও মতাদর্শের মানুষ ছিল। এরা জাতি-গোত্রগত প্রজন্ম পরম্পরায় প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত থাকত। এদের সবার মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা,জাতিগত বিদ্বেষ-শত্রুতা দূর করে পারস্পরিক সদ্ভাব ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৬২২/৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে সব সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করে একটি আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি-সংহতিমূলক চুক্তিপত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বাক্ষর করেন। এটিই ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত, যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ব প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তিপত্র (International magnacharta)। এই চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হয়ে সুশৃঙ্খলতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া সংঘাত এড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হোদায়বিয়ার সন্ধিতেও স্বাক্ষর করেন।
হত্যাকাণ্ড বন্ধ : জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবার প্রাণের নিরাপত্তা তিনি নিশ্চিত করেন। একটি জীবন সংহারকে সমগ্র মানবমণ্ডলী হত্যার সঙ্গে তুলনা করে কোরআনে হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি এসেছে। (সুরা মায়িদাহ : ৩২)। তাছাড়া রাসুলুল্লাহ (সা.) মানবহত্যাকে ভয়াবহ অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। (বোখারি : ৬৮৭১)।
এমনকি নিরপরাধ অমুসলিম নাগরিক হত্যাকেও কঠিন অপরাধ বলে বর্ণনা করেছেন। (বোখারি : ৩১৬৬)।
বর্ণবৈষম্য বিলোপ : সাদা-কালো, ধনী-গরিব, শাসক-শাসিতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বর্ণবৈষম্যের বিলোপ সাধন তিনি করেছেন। বংশীয় কৌলিন্য, ধন-সম্পদ বা বর্ণ নয়, তিনি মানুষের মধ্যে মর্যাদার মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন একমাত্র তাকওয়া বা আল্লাহভীতিকে। (সুরা হুজুরাত : ১৩)।
ক্রীতদাস সালমান ফারসিকে আহলে বায়তের মর্যাদা প্রদান, কাফ্রী দাস বিলালকে মসজিদে নববির মুয়াজ্জিন করা, ক্রীতদাস যায়েদকে পুত্রের মর্যাদা দেওয়া, কৃষ্ণাঙ্গ উসামাকে সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে তিনি বর্ণ বৈষম্যের অবসান ঘটান।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা : মানুষের সার্বজনীন অধিকার মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করেছেন। গবেষণায় এসেছে, পৃথিবীতে শাশ্মত ও সর্বোচ্চ মানবাধিকারের ঘোষণা সবার আগে তিনিই দিয়েছেন। বিদায় হজ্জ, মক্কাবিজয়ের ভাষণগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তাঁর ভাষণে মানবাধিকারের সব দিক সম্পর্কে তিনি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। এ মানবাধিকারের ঘোষণাগুলো ১২১৫ খ্রিষ্টাব্দের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের পিটিশন অব রাইটস, ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দের হেবিয়াসকর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার শতশত বছর আগেই তিনি দিয়েছেন।
ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শন : মহানবী (সা.) নিজে ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু ও ক্ষমাশীল। দয়া সম্পর্কে তিনি বলেছেন, যে মানুষকে দয়া করে না, আল্লাহতায়ালা তাকে দয়া করেন না। (বোখারি : ৭৩৭৬)। আর মক্কাবিজয়ের পরে তিনি ক্ষমার যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা হাজার বছরের জিঘাংসার দেয়ালকে ভেঙেচুরে ঔদার্যের সুউচ্চ মিনার সৃষ্টি করেছে।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ন্যায়বিচার করা দয়াময় আল্লাহতায়ালার কাছে তাঁর ডান দিকে নুরের মঞ্চে আসীন থাকবেন। (মুসলিম : ১৮২৭)। আরেক হাদিসে ন্যায়পরায়ণ শাসকগণ কেয়ামতের দিবসে আল্লাহতায়ালার বিশেষ ছায়ায় থাকবেন বলে উল্লেখ করেছেন। (বোখারি : ৬৬০)।
জুলুমবন্ধ : জুলুমণ্ডনিপীড়ন বন্ধে নবীজি বলেছেন, ‘তোমরা জুলুম পরিহার করো! কারণ কেয়ামতের দিন জুলুম অনেকগুলো অন্ধকার হয়ে আসবে।’ (মুসলিম : ২৫৭৮)।
নিষ্ঠুরতাপরিহারের নির্দেশনা : নিষ্ঠুরতা বন্ধে তিনি ঘোষণা করেছেন, প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার কথা ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। (বোখারি : ১১)।
দারিদ্র্য বিমোচন : দরিদ্রতা মানবজীবনের একটি বড় সমস্যা। নবীজি (সা.) দারিদ্র্যকে কুফরির সঙ্গে তুলনা করেছেন। (নাসাই : ৫৪৮৫)। কারণ, দারিদ্র্যের কশাঘাতে মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়, মানবিকবোধ লুপ্ত হয়, নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয় এবং এক সময় তাকে কুফুরির পর্যায়েও নিয়ে যেতে পারে। এ জন্য তিনি বিভিন্ন সাদাকা প্রবর্তনসহ বাজার ব্যবস্থাপনা, ভোগনিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, সুষম ব্যবসা ও বণ্টন নীতি, প্রণোদনা প্রদানসহ নানা উৎপাদনমুখী উপায়ে সফলভাবে দারিদ্র্য বিমোচন করেছেন।
নৈতিকউৎকর্ষ সাধন করে শান্তি প্রতিষ্ঠা : এছাড়া মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করে নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছেন। যাবতীয় চারিত্রিক উৎকর্ষতার বাস্তব অনুশীলনে ব্যক্তি মানস পরিবর্তন, ইবাদতের অনুশীলন, আখিরাতমুখিতা, নিবর্তনমূলক পদ্ধতি, সংশোধনমূলক প্রতিকার গ্রহণের মাধ্যমে প্রথমত. প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা, দ্বিতীয়ত. দণ্ডবিধির যথাযথ প্রয়োগ এবং তৃতীয়ত. বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নৈতিকভাবে পরিশুদ্ধ এক জাতি তৈরি করে পৃথিবীতে শান্তির দ্বার উন্মোচন করেছেন। পরিশেষে বলা যায়, শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান দিশারি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কর্মময় জীবনের যাবতীয় দিক সমগ্র মানবসভ্যতার জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠার এক অনুপম ও অনন্য আদর্শ। আল্লাহতায়ালা যার স্বীকৃতি দিয়ে বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহযাব : ২১)।
অতএব, আজকের এ দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় অশান্ত পৃথিবীতে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মহান আদর্শ যথাযথভাবে প্রয়োগ ও অনুশীলন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বিশ্ব শান্তির জন্য তাঁর জীবনাদর্শই একমাত্র পথ। নোবেলজয়ী দার্শনিক জর্জ বার্নার্ডশ’ যথার্থই বলেছিলেন : ‘মুহাম্মাদ (সা.)-এর মতো কোনো ব্যক্তি যদি আধুনিক জগতের একনায়কত্ব গ্রহণ করতেন তাহলে এমন এক উপায়ে তিনি এর সমস্যা সমাধানে সফলকাম হতেন যা পৃথিবীতে নিয়ে আসত বহু বাঞ্ছিত শান্তি ও সুখ।’
লেখক : খতিব ও মুহাদ্দিস, কুমিল্লা