ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নবীজির জন্ম পূর্বাপর আশ্চর্য ঘটনাবলি

শাহাদাত হোসাইন
নবীজির জন্ম পূর্বাপর আশ্চর্য ঘটনাবলি

মুহাম্মাদ (সা.)-এর জন্ম এবং জন্ম পূর্বাপর সংঘটিত ও প্রকাশিত অত্যাশ্চর্য বিষায়াবলি মোমেন-মুসলমানের আত্মার খোরাক। ঈমানি পথে এগিয়ে যাওয়ার মাইলস্টোন। মহানবীর জন্ম পূর্বাপর সংঘটিত এসব ঘটনাবলি দেয়, তাঁর মাহাত্ম্য ও ভবিষ্যত বরকতময় জীবন সম্পর্কে। যা দেখে আপনজন ও প্রিয়জনরা তাঁর বড়ত্বের ব্যাপারে আঁচ করতে পারছিল। যা শুনে ঐশী জ্ঞানপ্রাপ্ত ভবিষ্যত প্রবক্তারা তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির জানান দিয়েছিল। তাওরাত, ইঞ্জিলের জ্ঞানীরা দৃঢ় স্বীকারোক্তি দিয়েছিল যে, কিতাবদ্বয়ে উল্লিখিত ভবিষ্যতনবী মুহাম্মাদ তিনিই। এসব ঘটনায় আমাদের জন্য রয়েছে শিক্ষা এবং ঈমান সুদৃঢ়করণের উপাদান।

নবীজির জন্ম : নবীজি রবিউল আউয়াল মাসে সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইবনে আব্বাস বলেন, নবীজি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেন, সোমবারেই নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন, সোমবারেই হিজরত করেন এবং সোমবারেই তিনি ওয়াফাতপ্রাপ্ত হন। এক গ্রাম্য ব্যক্তি নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ, সোমবারে রোজা রাখার কারণ কী? নবীজি বললেন, এ দিনেই আমার জন্ম এবং এ দিনেই আমি নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছি (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া:২:৪৮২)। তবে জন্মতারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মতানৈক্য রয়েছে। ইবনে আব্দুল বার ও ওয়াকেদির মতে তাঁর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের দুই তারিখ। হুমাইদির মতে আট তারিখ। আর অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবনে দিহইয়ার মতে ১০ তারিখ। কারো কারো মতে ১২ তারিখ। ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক এই মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। ইবনে আবু শায়বা ১৮ তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া:২:৪৮৩)। আট তারিখ মতটিকেই অধিক শুদ্ধ ও যৌক্তিক বলে মনে করা হয়। তবে ১২ রবিউল আউয়াল মহানবীর জন্মতারিখ এ মতটি লোকপ্রচলনে খুব প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

জন্মের আগেই তাঁর আবির্ভাবের ইঙ্গিত : কোরআন এবং বিভিন্ন আসমানি কিতাব এই বিষয়ে সাক্ষ্য বহন করে যে, নবীজির দুনিয়ায় আসার সুসংবাদ সৃষ্টিলগ্নেই আল্লাহ সব নবীদের দিয়েছিলেন এবং তাদের উপস্থিতিতে নবীজি দুনিয়ায় আসলে তাঁর অনুসরণের জন্য অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন। নবীজির পৃথিবীতে পদার্পণ যখন ঘনিয়ে এলো, তখন আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন ইশারা ইঙ্গিতে দুনিয়াবাসীকে তাঁর আগমনের সুসংবাদ প্রদান করেন। আলৌকিক ঘটনার মাধ্যমে তাঁর বরকতময় আগমনের স্মারক রেখে দেন পৃথিবীর বুকে। এ যেন সূর্য উদিত হওয়ার প্রাক্কালে বিচ্ছুরিত আলোকরশ্মি। মেঘের আবরণ যাকে ঢেকে রাখার বা বাধা দেয়ার সক্ষমতা রাখে না।

ইয়ামেনের শাসক রবীআ ইবনে নাসরের স্বপ্ন : রোম সম্রাজ্যের অধীন ইয়ামেনের শাসক রবীআ একটি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেন। যার কারণে তিনি ভীত ও বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি এর ব্যাখ্যা জানতে এমন বিজ্ঞ লোকের অন্বেষণ করেন, যারা স্বপ্নের বিবরণ শোনা ছাড়াই স্বপ্নসহ ব্যাখ্যা বলতে পারবে। তখন তাকে সতিহ ও শিক নামের দু’জন জ্যোতিষীর সংবাদ দেয়া হয়। তিনি তাদের দরবারে আহ্বান করেন।

সতিহ ও শিকের ব্যাখ্যায় নবীজির আগমন : সতিহ প্রথমে এলে, বাদশাহ তাকে স্বপ্ন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। সতিহ জানান, আপনি স্বপ্নে দেখেছেন, অন্ধকার থেকে একটি জ্বলন্ত আংগরা বেরিয়ে নিম্নভূমিতে পড়ে সেখানের সবকিছুকে গ্রাস করে নেয়। বাদশাহ বলেন, আপনি সঠিক স্বপ্নই বলেছেন। অনুগ্রহ করে এখন এর ব্যাখ্যা বলুন। তিনি বলেন, আবিসিনিয়া বর্তমান ইথিওপিয়া কর্তৃক আপনার দেশ আক্রান্ত হবে এবং আপনারা পরাজিত হবেন। এটা আপনার রাজত্বের ৬০ বা ৭০ বছর পরে ঘটবে। বাদশাহ বলেন, তারা কি এখানে চিরকাল রাজত্ব করবে? তিনি বলেন, না। বরং তাদের রাজত্বের ৬০ বা ৭০ বছর পরে এডেনের ইরাম কর্তৃক তারা পরাজিত ও বহিষ্কৃত হবেন। বাদশাহ বলেন, ইরামের রাজত্ব কি চিরস্থায়ী হবে? তিনি বলেন, না। এক পূত-পবিত্র নবীর হাতে তার পতন হবে। তিনি গালিব বিন ফিহর বিন নজরের বংশধর হবেন। সৃষ্টি জগতের ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর অনুসারীদের হাতেই ক্ষমতা থাকবে। এরপর শিক দরবারে এলে সেও একই ব্যাখ্যাই দেন (সিরাতে ইবনে হিশাম:১:৪৯)। আবরাহার ইয়ামান দখল করার মাধ্যমে এর সত্যতা প্রকাশ পায়।

নবী জননী আমেনার স্বপ্ন : নবীজির সম্মানিত জননী আমেনা বলেন, নবীজিকে গর্ভধারণের পর আমি বিভিন্ন রকমের স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করি। একদিন আমি দেখলাম একজন ব্যক্তি আমাকে বলছে, তুমি মানবজাতির ত্রাণকর্তাকে গর্ভধারণ করেছ। তিনি ভূমীষ্ট হলে আল্লাহর আশ্রয় চাইবে এবং তাঁর নাম রাখবে মুহাম্মাদ। তিনি বলেন, আমি আরো দেখি-আমার গর্ভ থেকে এমন একটি আলোকরশ্মি বের হলো, যার আলোয় সুদূর সিরীয়া অঞ্চলের বুসরা শহরের প্রাসাদগুলো প্রস্ফুটিত হয়। (সিরাতে ইবনে হিশাম :১:১৫৬)।

নবী জননীর গর্ভকালীন কষ্ট মুক্তি : নবীজির জন্মকালীন আশ্চর্য বিষয়গুলোর একটি এই যে, নবী জননী আমেনা জানান, সন্তানগর্ভে থাকাকালীন মায়েদের সাধরণত যে কষ্টগুলো হয়, নবীজি গর্ভে থাকাকালীন আমি সেই সব কষ্ট থেকে মুক্ত ছিলাম। তাকে গর্ভ ধারণকালে আমি কোনো কষ্টই অনূভব করিনি (সিরাতে খাতামুল আম্বিয়া : ১২)।

জন্মের সময় সংঘটিত অত্যাশ্চর্য : যে দিন নবীজি পৃথীবিতে আগমন করেন। সে দিন খুশিতে আন্দোলিত হয়েছিল কুল-কায়েনাত। দরুদ পড়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ নিজে। সেদিন পৃথীবিতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যাতে রাজা-মহারাজাদের টনক নড়ে ওঠে। চিন্তা-পেরেশানির কারণ হয়। শয়তান ও তার অনুসারীরা বেদনায় কাতর হয়। বর্ণিত আছে, ইবলিস জীবনে চারবার ক্রন্দন করেছিলেন। আল্লাহ কর্তৃক অভিশপ্ত হওয়ার সময়। জান্নাত হতে বিতাড়িত হওয়ার সময়। নবীজির জন্মের সময় এবং সুরা ফাতিহা নাজিলের প্রাক্কালে (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া :২:৪৯১)।

নক্ষত্ররাজির নিকটবর্তী হওয়া : বর্ণিত আছে যে, জন্মের সময় নবীজি মাতৃগর্ভ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে আকাশপানে মাথা তুলে বের হয়ে আসেন। যে ঘরে নবীজির জন্ম হয়, সেই ঘরটি আলোকিত হয়ে যায় এবং নক্ষত্ররাজি মানুষের নিকটবর্তী হয়ে যায়। বায়হাকির বর্ণনায় পাওয়া যায়, কোরাইশদের প্রথা ছিল, সদ্যভূমীষ্ট সন্তানকে পাথর দ্বারা তৈরিকৃত ডেক দিয়ে পরবর্তী ভোর পর্যন্ত ঢেকে রাখা। প্রথানুযায়ী নবীজিকে ঢেকে রাখা হলে, প্রভাতে এসে দেখা গেল ডেকটি দ্বিখণ্ডিত অবস্থায় রয়েছে। আর নবীজি বিস্ফোরিত নয়নে আকাশপানে তাকিয়ে আছেন (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া :২:৪৮৯)। যে আলোয় জগৎ আলোকময় হবে, সে আলো ঢেকে রাখার নয়।

কিসরার সিংহাসন প্রকম্পিত : নবীজির জন্মের দিনে কিসরা-পারস্য সাম্রাজ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যাতে পুরো রাজ্যে হৈচৈ উঠে যায়। নবীজির জন্মের প্রাক্কালে পারস্য সম্রাটের সিংহাসন প্রকম্পিত হয়। শাহি ভবনের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে যায়। সাওয়া হৃদ শুকিয়ে যায়। সিরীয়ার ধর্মযাজক মুবিযান স্বপ্নে দেখেন কিছু উট কিছু ঘোড়াকে হাকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো তাড়া খেয়ে দজলা-টাইগ্রিস নদী অতিক্রম করে জনপদে ছড়িয়ে পড়ছে। পারস্য সম্রাট এই বিষয়গুলোর ব্যাখ্যার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়লে, তাকে জ্যোতিষী সতিহের খবর জানানো হয়। তিনি সতিহের কাছে আব্দুল মাসিহকে প্রেরণ করেন। সতিহের কাছে এলে তিনি জানান, শোন হে আব্দুল মাসিহ, যখন তেলাওয়াত বৃদ্ধি পাবে, মোটা ছড়িওয়ালা আত্মপ্রকাশ করবে, সামওয়া উপত্যাকা প্লাবিত হবে, সাওয়া হ্রদ শুকিয়ে যাবে তখন শাম আর শাম থাকবে না। ধ্বংসপ্রাপ্ত গম্বুজের সমসংখ্যক রাজা-রাণী তার কর্তৃত্ব কেড়ে নেবে। আর সেই সময়টি এসে গিয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে পরবর্তী ৪ বছরে ১০ জন রাজা পারস্যের সিংহাসনে বসেন (আল- বেদায়া ওয়ান- নেহায়া :২:৪৯৪)।

নিভে গেল হাজার বছরের অগ্নি : নবীজির জন্মের সময়ে পৃথীবির মানুষ বিভিন্ন মিথ্যা রবের ইবাদতে লিপ্ত ছিল। মানুষ মূর্তির পাশাপাশি অগ্নিপূজায় লিপ্ত ছিল। পারস্যে এমন একটি অগ্নি ছিল যার ইবাদত করত লোকেরা। সেই আগুনের পূজারিরা হাজার বছর লাগাতার তাকে প্রজ্জলিত রেখেছিলেন। নিভতে দেননি কখনো। কিন্তু নবীজির জন্মের সময় তা নিভে যায়। প্রকৃতপক্ষে যিনি এ সব মিথ্যার মূলোৎপাটন করবেন, তার আগমনের আলামত হিসেবে আল্লাহ এই ঘটনা ঘটান। তিনি দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে দেন যে, সত্য সমাগত, মিথ্যা বিদূরিত (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া :২:৪৯৪)।

নবীজির জন্ম সম্পর্কে ইয়াহুদি বণিকের সতর্কতা : মক্কায় এক ইয়াহুদি ব্যবসায়ী থাকতেন। যে দিন নবীজির জন্ম হয়, সেদিন সে কোরাইশদের মজলিসে এসে বলেন, আজকে কি তোমাদের ঘরে কোনো সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে? তারা অজ্ঞতা প্রকাশ করলে তিনি জানান, তোমরা খোঁজ নিয়ে দেখ। আজ রাতেই আখেরি নবীর জন্ম হয়েছে। তাঁর দুই কাধের মধ্যবর্তী স্থানে একটি চিহ্ন আছে। তাতে ঘোড়ার কেশের মতো একগুচ্ছ চুল আছে।

কোরাইশরা খবর নিয়ে উক্ত ইয়াহুদিকে জানালেন যে, মুহাম্মাদ নামে একটি শিশুর জন্ম হয়েছে। তিনি নবীজিকে দেখতে চান। শিশু নবীকে তার কাছে অর্পণ করা হলে নবুওয়াতের মোহর দেখে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান ফিরলে লোকেরা তাকে জিজ্ঞাসা করেন কী হয়েছে? তিনি জানান, আজ থেকে নবুওয়াতি বনি ইসরাঈল থেকে বিদায় নিল। হে কোরাইশ! তোমরা আনন্দিত হও। সুসংবাদ গ্রহণ কর। তোমারদের মধ্যে নবীর জন্ম হয়েছে। তোমাদের সহায়তায় তিনি প্রাচ্য-প্রতীচ্য জয়লাভ করবেন (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া :২:৪৯২)।

চাঁদের সঙ্গে খুনশুটি : আব্বাস (রা.) নবীজিকে বলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার নবুওয়াতের একটি নিদর্শন আমাকে ঈমান আনতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আপনি দোলনায় থাকাবস্থায় চাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং আঙুল দ্বারা ইশারা করতেন। আপনার আঙুলের ইশারায় চাঁদ এদিক সেদিক ঝুঁকে পড়ত। তখন নবীজি বললেন, চাঁদ আমার সঙ্গে কথা বলত, আমার কান্না থামানোর জন্য। আরশের নিচে সেজদা করার প্রাক্কালে আমি তার পতনের আওয়াজ শুনতে পেতাম। (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া : ২:৪৯০)।

লেখক : শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদ্রাসা রংপুর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত