ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহানবীর মাতৃভক্তি

শরিফ আহমাদ
মহানবীর মাতৃভক্তি

মহান আল্লাহর প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)। নবীজির ওপর ঈমান আনার দাবি হলো? তার জীবনযাপন, আখলাক চরিত্র ও আদর্শ সম্পর্কে অবগত হওয়া এবং আমলে পরিণত করা। আল্লাহতায়ালা নবীজি (সা.)-এর জন্য কিছু কাজ বিশেষিত করেছেন, সেগুলো ছাড়া মহানবীর জীবনের প্রত্যেকটি দিক ও অনুষঙ্গ মোমেন বান্দার জন্য অনুসরণীয়। উপকারী ও বরকতময়। মহানবীর যথাযথ অনুসরণই মূলত তার সুন্নাহ ও সিরাতের অনুসরণ। মহানবী (সা.) কোন কাজটা কীভাবে করেছেন, তা জেনে সে অনুযায়ী নিজেরাও ওই কাজটি করার চেষ্টা করা- এ মানসিকতা ও তা বাস্তবে রূপায়িত করার প্রচেষ্টাই হলো সিরাতের প্রায়োগিক চর্চা। এ নিবন্ধে আমরা আলোচনা করব মহানবী (সা.) তার মায়ের প্রতি কেমন ছিলেন? মায়ের প্রতি তার প্রেম ভালোবাসা, ভক্তি ও শ্রদ্ধার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

মহানবীর পিতামাতা

মহানবীর মাতাপিতা পূতঃপবিত্র ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন । এ সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর বক্তব্য হলো, আল্লাহতায়ালা গোত্র ও বংশগুলো বাছাই করেন এবং আমাকে সবচেয়ে ভালো বংশে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি ঘরগুলো বাছাই করেছেন এবং আমাকে সবচেয়ে ভালো ঘরে সৃষ্টি করেছেন। (তিরমিজি : ৩৬০৭)।

মহানবীর পিতা আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল মুত্তালিব আসহাবে ফিলের ২৫ বছর আগে ৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং মহানবীর জন্মের আগেই ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। বনু নাজিরে তাকে দাফন করা হয়। মহানবীর মাতা আমেনা বিনতে ওয়াহাব ছিলেন মদিনার অত্যন্ত অভিজাত বংশের মেয়ে। জন্মের পর থেকেই তিনি শিশু নবীকে পরম আদর স্নেহে আর মায়া মমতায় আগলে রাখেন। ইবনে ইসহাক (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে হাযম বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বয়স যখন ছয় বছর, তখন তাঁর মা আমেনা মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী আবওয়া নামক স্থানে ইন্তেকাল করেন। নবীজিকে সঙ্গে করে তিনি তার মাতুলালয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারা ছিলেন আদী ইবনে নাজ্জার গোত্রভুক্ত। মক্কায় প্রত্যাবর্তনের পথে তার ইন্তেকাল হয়। (আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ২/ ৫০৯, সিরাতে ইবনে হিশাম : ৪২)।

মহানবীর মাতৃভক্তি

মহানবী (সা.) মাত্র কয়েক বছর মায়ের সঙ্গ পেয়েছিলেন। তবুও তিনি তাকে খুব ভালোবাসতেন। তার জন্য ব্যাকুল হৃদয়ে কান্না করতেন। এ সম্পর্কে সিরাতের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থগুলোতে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) তার মায়ের কবর জিয়ারত করেন এবং কবরের পাশে কাঁদেন। অতঃপর বলেন, আমি আমার প্রতিপালকের কাছে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার অনুমতি চেয়েছি, আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরপর আমি তার কবর জিয়ারতের অনুমতি চেয়েছি আমাকে তা দেওয়া হয়েছে। তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা, তা মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসলিম : ৯৭৬, আবু দাউদ : ৩২৩৪)।

মহানবী (সা.) হিজরতের কয়েক বছর পর সেই পথ দিয়ে আবারও সাহাবীদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি কিছু সময়ের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলেন। সাহাবীদের সেখানে অবস্থানের নির্দেশ দিয়ে তিনি মায়ের কবর পানে গিয়ে অঝরে কাঁদতে লাগলেন। দীর্ঘক্ষণ মোনাজাত করলেন। উপস্থিত সাহাবীরাও নবীজির এ অবস্থা দেখে কান্না সংবরণ করতে পারলেন না। যারা জানতেন যে এখানে প্রিয় নবীর সম্মানিত আম্মাজানের কবর তারা তো বুঝলেনই, আর যারা জানতেন না তারা নবীজির জিয়ারত শেষে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন এটি আমার আম্মাজানের কবর। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক : ৩২৯২)। সাধারণত পিতামাতার ইন্তেকালের কয়েক মাসের মধ্যে সন্তানরা সব ভুলে যায়। অথচ মহানবী (সা.)-এর হৃদয়ে মায়ের প্রতি কত টান ছিল উল্লিখিত হাদিস দুটি থেকে তা বোঝা যায়।

ধাত্রী মায়ের প্রতি সম্মান

মহানবী (সা.)-এর আরেক মায়ের নাম বারাকাহ বিনতে সালাবা। তিনি? উম্মে আইমান নামে পরিচিত।? তিনি প্রথমদিকের একজন মুসলিম এবং মহানবীর ধাত্রী মা ছিলেন। ইমাম বোখারি (রহ.) তার অমর কীর্তি সহিহ বোখারির ৩৭৩৫ নং হাদিসের শেষাংশে বলেন, সুলাইমান ইবনে আব্দুর রহমান (রহ.) বলেন, তিনি ছিলেন মহানবীর ধাত্রী। তার সম্মান ও গুরুত্ব বোঝাতে একদা রাসুল (সা.)-ইরশাদ করেন, আমার মায়ের ইন্তেকালের পর উম্মে আয়মানই আমার মা। (তারিখে ইবনে আসাকির : ৮/৫১) ইন্তেকালের আগে রাসুল (সা.) সাহাবীদের বলেছিলেন, উম্মে আইমানের যত্ন নেবে। তিনি একমাত্র নারী যিনি আমাকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দেখেছেন। প্রিয় নবীর ওফাতের পর প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ওমর বিন খাত্তাব (রা.) কে বললেন, চলুন আমরা উম্মে আইমানের সঙ্গে দেখা করতে যাই। যেমন দেখা করতে যেতেন নবীজি (সা.)। অতঃপর উভয়ে যখন তার কাছে পৌঁছালেন, তখন তিনি (উম্মে আইমান) কেঁদে ফেললেন। তারা তাকে বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি কি জানেন না যে, আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা রাসুলের জন্য দুনিয়া থেকে অধিক উত্তম? উম্মে আইমান বললেন আমি এজন্য কাঁদছি যে আসমান থেকে অহি আসা বন্ধ হয়ে গেল। উম্মে আইমান তার এই কথার দ্বারা উভয়কেই কাঁদতে বাধ্য করলেন। ফলে তারাও তার সঙ্গে কাঁদতে লাগলেন। (মুসলিম : ২৪৫৪, ইবনে মাজাহ : ১৬৩৫)।

নবীর ভাষায় মায়ের সম্মান

মহানবী (সা.) ছিলেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। তার রহমতের ছোঁয়া পেয়ে পৃথিবীর সব মা দামি হয়েছেন।? পেয়েছেন ন্যায্য অধিকার। এ সম্পর্কে অসংখ্য বর্ণনা আছে।? বিখ্যাত হাদিসটি বর্ণনা করেন হজরত আবু হুরায়রা (রা.)। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার সর্বোত্তম ব্যবহারের হকদার কে? রাসুল (সা.) বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার বলল, অতঃপর কে? রাসুল (সা.) বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার বলল, অতঃপর কে? রাসুল (সা.) বললেন, তোমার মা। লোকটি আবার বলল, তারপর কে? রাসুল (সা.) বললেন, অতঃপর তোমার পিতা। (বোখারি : ৫৫১৪, মুসলিম : ৪৬২১)। পিতামাতার সেবা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এর মাধ্যমে জান্নাতের টিকিট বুকিং করা যায়। এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, নামাজ সঠিক সময়ে আদায় করা এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করা আমলগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম আমল। (বোখারি : ৫২৭ মুসলিম : ৮৫, তিরমিযি : ১৭৩)। রাসুল (সা.) আরো বলেছেন, মানুষ তার পরিবারের জন্য সাওয়াবের নিয়তে যখন খরচ করে, তখন তা হয় তার সদকাস্বরূপ। (নাসায়ি: ২৫৪৫)। আজ পৃথিবীর সব মানুষ যদি পিতামাতার খেদমতে অর্থ খরচ করে, তাহলে আর কোথাও বৃদ্ধাশ্রমের কোনো প্রয়োজন হবে না। শান্তি সুখের সৌরভে ভরে উঠবে দুনিয়া ও আখেরাত। নবীর উম্মত হিসেবে সিরাত ও মিলাদের এ মাসে আমাদের মনে রাখা উচিত নবী (সা.) বলেছেন, ‘মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।’ এ কথার সহজ অর্থ হলো, মায়ের সেবা করে তার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে জান্নাত পাওয়া যায়।

লেখক : কবি ও আলেম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত