জীবনের পূর্ণতা এবং চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার্থে যুগে যুগে মানুষ বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। হজরত ইয়াহইয়া ও হজরত ঈসা (আ.) ছাড়া সব নবী-রাসুল বিয়ে করেছেন। আল্লাহর আদেশে বিয়ে করেছেন আখেরি নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং বিয়ের পরে করেছেন অলিমা। নিম্নে এ বিষয়ক কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো।
নবীর ভাষায় অলিমার গুরুত্ব : বিয়ের পর ছেলে পক্ষ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও গরিব প্রতিবেশীদের সাধ্যানুযায়ী আপ্যায়ন করাকে অলিমা বলা হয়। অলিমা করা গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত। মহানবী (সা.) নিজেই বিয়ের অলিমা করেছেন। সাহাবায়ে কেরামকে করার তাগিদ দিয়েছেন। অলিমার দাওয়াত গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন তোমাদের কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয়, সে যেন তাতে সাড়া দেয়। যদি সে রোজাদার হয়, তাহলে সে ওখানে গিয়ে দোয়া, নামাজে রত থাকবে। আর যদি রোজাদার না হয়, তাহলে সে আহার করবে। (মুসলিম : ৩৩৮৯)। হাদিসে আরো বর্ণিত হয়েছে, হজরত আনাস (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) আব্দুর রহমান ইবনে আওফের গায়ে হলুদ রঙের চিহ্ন দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? তিনি বললেন, আমি এক খেজুর আঁটির ওজন স্বর্ণ দিয়ে একজন মহিলাকে বিবাহ করেছি। রাসুল (সা.) বললেন, আল্লাহ তোমার বিবাহে বরকত দান করুন। একটি ছাগল দ্বারা হলেও তুমি অলিমা করো। (বোখারি : ৫১৫৫)।
মহানবীর বিয়ের অলিমা : মহানবী (সা.) চতুর্থ হিজরি মতান্তরে তৃতীয় হিজরিতে মদিনায় হজরত জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)কে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন নবীর ফুফুর কন্যা ও পালক পুত্র জায়েদ ইবনে হারেসা (রা.)-এর সাবেক স্ত্রী। মনোমালিন্য তাদের বিচ্ছেদের প্রধান কারণ। মহানবী (সা.) জয়নাব (রা.)কে সান্ত¦নার জন্য বিয়ে করতে ইচ্ছা পোষণ করলেও আরবের লোকের কটূ কথার ভয়ে বিরত থাকেন। কেননা, তখন পালক পুত্রকে নিজের ঔরষজাত পুত্র সন্তানের বরাবর মনে করা হত। কিন্তু কুপ্রথা বিলুপ্ত করে দেওয়া ইসলামের অপরিহার্য দায়িত্ব। এজন্য কোরআনের আয়াত নাজিল হলো, আপনি কি লোকদের ভয় করছেন? অথচ আল্লাহকেই একমাত্র ভয় করা উচিত। (সুরা আহযাব : ৩৭)। স্বয়ং আল্লাহর নির্দেশে এ বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিলুপ্ত হয় আরবের কুপ্রথা। ঐতিহাসিক এই বিয়ের অলিমার আয়োজন বড় পরিসরে করা হয়। আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) তার এক সহধর্মিণীর সঙ্গে বাসর ঘরের ব্যবস্থা করলেন এবং অলিমার দাওয়াত দেয়ার জন্য আমাকে পাঠালেন। (বোখারি : ৪৭৯৬)। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে আরও একটি দীর্ঘ বর্ণনা এসেছে। এখানে মেহমানের প্রতি মেজবানের দায়িত্ববোধের শিক্ষা আছে। নবীজি (সা.)-এর লাজুকতার বিষয়টিও? উঠে এসেছে। তিনি বলেন, যখন মহানবী (সা.) মদিনায় আসেন, তখন আমার বয়স ১০ বছর ছিল। আমার মা, চাচি ও ফুফুরা আমাকে মহানবীর খাদেম হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। এরপর আমি ১০ বছরকাল ধরে তার খেদমত করি। যখন মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকাল হয়, তখন আমার বয়স ২০ বছর। আমি পর্দা সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বেশি জানি। পর্দা সম্পর্কীয় প্রাথমিক আয়াতগুলো জয়নাব বিনতে জাহাশের সঙ্গে মহানবীর বাসর রাত যাপনের সময় অবতীর্ণ হয়। সেদিন সকালবেলা রাসুল (সা.) দুলহা ছিলেন এবং লোকদের অলিমার দাওয়াত করলেন। সুতরাং তারা এসে খানা খেলেন। কিছু সংখ্যক ছাড়া সবাই চলে গেলেন। তারা দীর্ঘক্ষণ মহানবীর সঙ্গে কাটালেন। তারপর মহানবী উঠে বাইরে গেলেন। আমি তার পিছু পিছু চলে এলাম। যাতে করে অন্যরাও বের হয়ে আসে। মহানবী সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। এমনকি তিনি আয়েশা (রা.)-এর কক্ষের দ্বারপ্রান্তে গেলেন। এরপরে বাকি লোকগুলো হয়তো চলে গেছে এ কথা ভেবে তিনি ফিরে এলেন। আমি তার সঙ্গে ফিরে এলাম। মহানবী (সা.) জয়নাবের কক্ষে প্রবেশ করে দেখতে পেলেন যে, লোকগুলো বসে আছে। চলে যায়নি। সুতরাং নবীজি (সা.) পুনরায় বাইরে বের হলেন এবং আমি তার সঙ্গে এলাম। যখন আমরা হজরত আয়েশা (রা.)-এর কক্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছলাম, তিনি ভাবলেন যে, লোকগুলো চলে গিয়েছে। তিনি ফিরে এলেন। আমিও তার সঙ্গে ফিরে এসে দেখলাম যে, লোকগুলো চলে গেছে। এরপর মহানবী (সা.) আমার ও তার মাঝখানে একটি পর্দা টেনে দিলেন। এ সময় পর্দার আয়াত অবতীর্ণ হলো।
(বোখারী : ৪৭৯২)। হজরত জয়নাব বিনতে জাহাশের অলিমার মতো বড় অনুষ্ঠান আর কোনো উম্মুল মোমিনদের বেলায় করা হয়নি। এই অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিতে গিয়ে হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) আরো বলেন, মহানবী (সা.) দাওয়াত করা সব মেহমানকে গোশত-রুটি, তৃপ্তিসহকারে খাওয়ান?। (বোখারি : ৪৭৯৪)।
আরেকটি বিয়ের অলিমা : সপ্তম হিজরিতে খাইবার যুদ্ধে ইহুদিরা পরাজয় বরণ করে। মুসলমানদের হাতে প্রচুর গনিমতের মালের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হওয়া বিখ্যাত ধনী হোয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা হজরত সুফিয়া (রা.) কেও যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে নিয়ে আসা হয়। সাহাবায়ে কেরামের পরামর্শে রাসুল (সা.) সদ্য বিধবা হওয়া হজরত সুফিয়া বিনতে হোয়াই (রা.)কে মুক্ত করে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করে নেন। এ সম্পর্কে হজরত আনাস সূত্রে হাদিসে এসেছে, তিনি বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) হজরত সুফিয়া (রা.)কে আজাদ করে বিয়ে করেন এবং এই আজাদ করাকেই তার মোহরানা নির্দিষ্ট করেন এবং হাইস বা একপ্রকার সুস্বাদু হালুয়ার দ্বারা অলিমার ব্যবস্থা করেন। (বোখারি : ৪৭৯৫)। হজরত আনাস (রা.) আরো বলেন, খাইবার থেকে ফিরে আসার সময় নবী (সা.) খাইবার ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থলে তিন দিন অবস্থান করেন। সেখানে হজরত সুফিয়া (রা.) কে নিয়ে আসা হলো। তিনি অলিমার ব্যবস্থা করলেন। আর আমি মুসলিমদের মাঝে তার অলিমার দাওয়াত করলাম। এই অলিমায় রুটি বা গোশত কিছুই হলো না। এই অলিমার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) চামড়ার দস্তরখান বিছানোর আদেশ করলেন। অতঃপর এই দস্তরখানের উপর খেজুর, পনির ও ঘি ঢেলে দেওয়া হলো। (বোখারি : ৫৩৮৭, মেশকাত : ৩২১৪)।
কনের বাড়ি অনুষ্ঠান সুন্নাহ নয় : আজকাল ছেলের বাড়িতে অলিমার পরিবর্তে মেয়ের বাড়িতে ভোজনের গুরুত্ব দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে মেয়ে পক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। এগুলো সুন্নাহবিরোধী প্রথা। এগুলো পরিহার করা প্রয়োজন। সুন্নাহের আলোকে জীবন গড়ার প্রত্যাশা হোক সবার। মনে রাখতে হবে, কনে পক্ষ ছেলে পক্ষকে তাদের স্বাভাবিক সামর্থ্যরে বাইরে গিয়ে কিছু করতে হয়, যে আয়োজন বা অনুষ্ঠানে, সে আয়োজন তাদের মনের খুশিতে হয় না। হয় দায় সারতে, সমাজে মুখ বাঁচাতে। এসব আয়োজন চাপে পড়ে বা সম্মান বাঁচানোর ভয়ে হলে তা স্পষ্ট হারাম ও পাপ। এ পাপের দায় বরপক্ষ কখনো এড়াতে পারবে না। তাই সুন্নাহ মোতাবেক বিয়ের জন্য, বিয়ে বরকতময় হওয়ার জন্য রাসুলের সুন্নাহ ও জীবনাদর্শ অনুসরণ করা অপরিহার্য।
লেখক : কবি ও আলেম