১. কোন বিষয়ে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করছে ২. মহাসংবাদটির বিষয়ে? ৩. যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে। ৪. কখনো না, শিগগিরই তারা জানতে পারবে। ৫. আবার, কখনো না, শিগগিরই তারা জানতে পারবে। (সুরা নাবা)।
মর্ম ও শিক্ষা : সুরা নাবা হলো মক্কি সুরা। এ সুরায় ইসলামি জীবন-দর্শনের কয়েকটি মৌলিক বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। আলোচ্য আয়াতগুলোতে প্রথমেই কেয়ামতের প্রসঙ্গ এসেছে। এখানে বাতিলপন্থিদের কেয়ামতে সংশয় ও অবিশ্বাসের উল্লেখ করে কেয়ামত ও আখিরাতের অনিবার্যতা ও অকাট্যতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বাতিলপন্থিদের কেয়ামতে অবিশ্বাস : সুরাটির প্রথমেই কেয়ামত সম্পর্কে বাতিলপন্থিদের সংশয় ও অবিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। তারা কেয়ামত সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করে এবং প্রশ্ন করে। অর্থাৎ তারা কেয়ামতে অবিশ্বাস করে এবং সন্দেহ করে। আসলে নাস্তিক, কাফির এবং বাতিলপন্থিদের বিভিন্ন দল কেয়ামত ও আখেরাতে অবিশ্বাস করে। তাদের কেউ কেউ মনে করে আল্লাহর অস্তিত্বই নেই। সুতরাং কেয়ামতের প্রশ্নই উঠে না। আবার কেউ কেউ মনে করে মৃত্যুর পর মানব দেহ যখন মাটিতে মিশে যায়, তখন তাকে পুনরুত্থিত করা সম্ভব নয়। এভাবে নানা ধরনের কারণ দেখিয়ে অনেকে কেয়ামত ও আখেরাতকে অস্বীকার করে।
বাতিলপন্থিদের কেয়ামতে অবিশ্বাসের স্বরূপ : নাস্তিক, কাফির ও অনেক বাতিলপন্থি দল মনে করে এ দুনিয়ার জীবনই শেষ, এরপর আর কোনো জীবন নেই। এ জীবনের কোনো লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই। কাজেই জবাবদিহি বা হিসাবের প্রশ্নই উঠে না। আসলে জবাবদিহির চেতনা থাকলে মানুষ যথেচ্ছা জীবন পরিচালিত করতে পারে না। তারা অনৈতিক, অসামাজিক, অশ্লীল ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনে লিপ্ত হতে পারে না। সুতরাং যেসব বাতিলপন্থি প্রবৃত্তির অনুসরণে আদর্শহীন জীবন পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাদের জবাবদিহি ও আখেরাতকে অস্বীকার করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তাই তারা পুনর্জীবন, পুনরুত্থান, কেয়ামত ও আখেরাতকে অস্বীকার করে।
কেয়ামত-বিশ্বাসকে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা : যখন রাসুল (সা.) তৎকালীন মক্কা ও আরবে কেয়ামত ও আখেরাতে বিশ্বাসের মাধ্যমে জবাবদিহির চেতনা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করলেন, তখন তৎকালীন বাতিলপন্থিরা মনে করল, মানুষ যদি এ যৌক্তিক বিশ্বাসটাকে গ্রহণ করে তা হলে সত্যের দল ভারী হবে এবং বাতিলের দল দুর্বল হয়ে পড়বে। সুতরাং কেউ যেনো এ বিশ্বাসকে গ্রহণ না করে, সে উদ্দেশ্যে বাতিলপন্থিরা পরস্পরের মধ্যে এ ব্যাপারে প্রশ্ন সৃষ্টি করে এবং সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। বাতিলপন্থিরা একে অপরকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেয়ামত সত্যিই হবে নাকি? যদি তা সত্যিই হয়ে থাকে, তবে কবে হবে অথবা কেন তা হচ্ছে না ইত্যাদি। এভাবে তারা নিজেদের মধ্যে কেয়ামত সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, আখেরাতে বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা করে, যেনো মানুষ কেয়ামত ও আখেরাতে ঈমান না আনে।
ইসলামি জীবন-দর্শনের মৌলিক বিশ্বাস : ইসলামি জীবন-দর্শনে এমন কতোগুলো মৌলিক বিশ্বাস আছে, যা কেয়ামত ও আখেরাতের ঈমানকে অনিবার্য করে তোলে। এ মহাজগৎ এমনিতে অস্তিত্বে আসেনি, বরং এগুলোকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সবকিছুর প্রতিপালন করেন। সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে। এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের দায়িত্ব মানুষ ও জিন জাতির উপর, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জবাবদিহি আছে। এ জবাবদিহির জন্যই কেয়ামত ও আখেরাত অনিবার্য, যেদিন সবাইকে পুনরুর্জ্জীবিত ও পুনরুত্থিত করা হবে। সেদিন প্রত্যেককে তার দুনিয়ার সব কর্মকাণ্ডের রেকর্ড আমলনামা দেয়া হবে। সে তার দায়িত্ব পালন করল কি করল না, কতটুকু করল, আর কতটুকু করল না এবং কতটুকু নিষ্ঠার সঙ্গে করল ইত্যাদি বিষয়ে চুল-চেরা হিসাব হবে কেয়ামতের মাঠে। সে বিচারের রায় অনুযায়ী প্রতিটি মানুষ ও জিন আখেরাতের অনন্তকালের জীবন পাবে। যারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছে, তারা অনন্তকালের জান্নাতে সীমাহীন শান্তির জীবন পাবে। আর যারা আল্লাহকে অস্বীকার করেছে, কেয়ামতের জবাবদিহিকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সে কারণে দায়িত্ব পালনে বিরত রয়েছে, তারা কঠিন শাস্তির স্থান জাহান্নামে অনন্তকাল ধরে জ্বলবে।
সত্যপন্থিদের প্রশ্নবানে নাজেহাল করার চেষ্টা : তাদের পরস্পরকে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য সত্যপন্থিদের প্রশ্নবানে নাজেহাল করাও হতে পারে। বাতিলপন্থিরা রাসুল (সা.) কে এবং সত্যপন্থিদের প্রশ্ন করছে, কেয়ামত কি সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে? যদি তা সত্যি হয়, তা হলে কবে হবে? এভাবে তারা নানা ধরনের প্রশ্ন ও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে চেষ্টা করে, যাতে করে মোমেনরা বিব্রত বোধ করে, আর অন্যরা আখেরাতে সন্দেহ পোষণ করে।
সত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান বাতিলের চিরায়ত আচরণ : কেয়ামত সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি করার এ চেষ্টা বাতিলপন্থিদের একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটাই হলো তাদের চিরায়ত আচরণ, যখনই কোনো সত্য পেশ করা হয়, তখনই তারা নানা অজুহাতে তাতে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করে। আর এভাবে তারা মানুষকে সত্যপথ থেকে ফিরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালায়।
কেয়ামত নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ মারাত্মক অপরাধ : কেয়ামত ও আখেরাত সম্পর্কে বাতিলপন্থিদের আচরণের বিষয়টিকে এখানে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে, তাদের এরূপ আচরণ মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়, বরং এমন একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য ঘটনার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা সত্যিই বিস্ময়ের ব্যাপার। কেয়ামত হলো এমন একটি মহাসত্য, যা নিয়ে কোনো প্রকার প্রশ্ন সৃষ্টি করা অথবা তা নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করা মারাত্মক অপরাধের কাজ।
কেয়ামতের ভয়াবহতা : কেয়ামত সম্পর্কে তৎকালীন আরবের বাতিলপন্থিদের প্রশ্ন, পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ এবং সমালোচনার প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে, তারা এক মহাসংবাদ ও অনিবার্য বিষয়ে প্রশ্ন উঠাচ্ছে। এখানে কেয়ামতের ভয়াবহতার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আসলে কেয়ামত হবে এক কঠিন ও ভয়াবহ ঘটনা।
আখেরাতে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুমকি ও ভীতিপ্রদর্শন আয়াতে কেয়ামত ও আখেরাত সম্পর্কে বাতিলপন্থিদের ধারণা ও বিশ্বাসের কঠোর সমালোচনা করে তাদের প্রতি হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কেয়ামত ও আখেরাত সম্পর্কে তারা যে ধারণা ও বিশ্বাস রাখে, তা কখনো সত্য নয়। এমন কখনো হবে না যে, তারা দুনিয়াতে যা ইচ্ছা তা করবে, আর সে সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে না এবং জবাবদিহির জন্য কেয়ামত ও আখেরাত হবে না। তাদের এসব বিচিত্র ভ্রান্ত বিশ্বাস কখনো ঠিক নয়, বরং সবই মিথ্যা এবং ভুল। তারা অচিরেই এ ভুল সম্পর্কে জানতে পারবে এবং চাক্ষুষ কেয়ামত দেখতে পাবে। আসলে মৃত্যুর সময়ই সে বুঝতে পারে, সে বাতিলের উপর ছিল এবং তার পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এরপর কেয়ামত তো আসবেই। তখন কর্মফল ভোগ করতে হবে।
জীবন সম্পর্কে বাতিলপন্থিদের ধারণা ও বিশ্বাস পরিত্যাগ করার তাগিদ : আয়াতে বাতিলপন্থিদের যে হুমকি দেয়া হয়েছে, তার অর্থ শুধু আখেরাতে বিশ্বাস নয়, বরং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হলো মানব জীবনের সববিষয়। মানব-সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর ইবাদত প্রতিষ্ঠিত করা (আল-কোরআন, ৫১:৫৬)। এ উদ্দেশ্য কতটুকু সাধন করা হলো, সে সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে এবং তার কর্মফল হিসেবে অনন্তকালের জীবনযাপন করতে হবে। কাজেই সব ধরনের বাতিল দর্শন পরিত্যাগ করে ইসলামি জীবন-দর্শন স্বীকার ও গ্রহণ করতে হবে এবং সে অনুযায়ী জীবনযাপন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও বহু গ্রন্থরচিয়তা